রাজধানীর বারিধারার ছোট্ট একটি কক্ষেই অ্যান্ডবি ট্রেডিং ও ওকায়ামা লিমিটেড নামে দুটি প্রতিষ্ঠান। কক্ষ ছোট হলে কী হবে, কাগজে কলমে এখানে রয়েছে অনেক বড় প্রতিষ্ঠান। আর তা দেখিয়ে ঋণের নামে প্রায় ১১৯ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এক দম্পতি।

স্বামী সুব্রত দাস। ওয়াকামা লিমিটেডের চেয়ারম্যান। আর স্ত্রী শুভ্রা রানী ঘোষ একই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। তারাই আবার অ্যান্ডবি ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী বা মালিক। তাদের ক্ষমতার উৎস আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে)  হালদার। সুব্রত দাস ছিলেন পি কে হালদারের বন্ধু। বুয়েটে তারা একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। বন্ধু হওয়ার সুবাদে পি কে হালদার তাদের বাসায় প্রায়ই আসতেন।

সম্প্রতি আদালতে ১৬৪ ধারায় শুভ্রা রানী ঘোষের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ৫ সেপ্টেম্বর থেকে তাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিমান্ডে থাকা অবস্থায় আদালতে জবানবন্দি দিতে রাজি হন শুভ্রা। তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গুলশান আনোয়ার প্রধান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে শুভ্রা রানী ঘোষ ও নাহিদা রুনাইকে। এর মধ্যে শুভ্রা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে না।

সূত্রে জানা যায়, আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে দোষ স্বীকার করে শুভ্রা রানী ঘোষ জানান, তিনি ওকায়ামা লিমিটেডের পরিচালক। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান তার স্বামী সুব্রত দাস। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন মো. তোফাজ্জল হোসেন। স্বামী সুব্রত দাস ছিলেন পি কে হালদারের বন্ধু। বুয়েটে তারা একসঙ্গে পড়াশোনা করতেন। সে সুবাদে বুয়েটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্বামীর সঙ্গে গেলে পি কে হালদারের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। স্বামীর বন্ধু হওয়ার সুবাদে পি কে হালদার তাদের বাসায় প্রায়ই আসতেন।

এই দম্পতি তাদের মালিকানাধীন অ্যান্ডবি ট্রেডিংয়ের নামে এফএএস ফাইন্যান্স লিমিটেড থেকে কোনো মর্টগেজ ছাড়াই ৩১ কোটি টাকা ঋণ নেন। প্রকৃত পক্ষে বারিধারাতে ভাড়া করা একটি রুমেই ছিল অ্যান্ডবি ট্রেডিং ও ওয়াকামা লিমিটেডের অফিস।

কোনো মর্টগেজ না দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের কর্মকর্তাদের সহায়তায় ওয়াকামা লিমিটেডের নামেও ৮৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়। এ ঋণের মধ্যে কয়েক কোটি টাকা তুলে শুভ্রা তার স্বামী সুব্রত দাসকে দিয়েছিলেন, যা তিনি পি কে হালদারের হাতে তুলে দেন। এ ঋণের বিষয়ে তার স্বামী সবকিছুই জানেন। ঋণের টাকা পি কে হালদারের বিভিন্ন কোম্পানি ও তার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির হিসাবে গেছে বলে শুভ্রা জেনেছেন।

শুভ্রা রানী ঘোষ জবানবন্দিতে আরও জানান, ওকায়ামা লিমিটেডের পরিচালক হিসেবে তিনি ভাতা পেতেন, যা তার ব্যাংক হিসাবে জমা হতো। তার স্বামী তার কাছ থেকে চেকে সই নিয়ে টাকা তুলে কী করতেন, তা তিনি জানেন না। তাদের ছেলে আমেরিকায় লেখাপড়া করে। সে সুবাদে তিনি (শুভ্রা) ও তার স্বামী সুব্রত দাস আমেরিকায় গিয়েছিলেন।

স্বামী সুব্রত দাস বর্তমানে আমেরিকায় আছে। অ্যান্ডবি ট্রেডিং ও ওয়াকামা লিমিটেড প্রতিষ্ঠান দুটি বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় লিজিং এর ঋণ পরিশোধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। বর্তমানে ঋণটি ক্লাসিফাইড বা মন্দ অবস্থায় রয়েছে। এবি ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে শুভ্রার হিসাব রয়েছে। এই দম্পতির পক্ষে ঋণের বিপরীতে এক টাকাও পরিশোধ সম্ভব নয়। ভবিষ্যতেও পরিশোধ একেবারেই অনিশ্চিত।

রাজধানীর উত্তরায় বাস করতেন শুভ্রা ও সুব্রত দম্পতি। তিন মাস আগে আমেরিকায় যান তারা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে গত ২২ মার্চ দেশে ফিরছিলেন আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের সহযোগী ও ওকায়ামা  ইন্টারন্যাশনালের পরিচালক শুভ্রা রানী ঘোষ। দেশে ফিরেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুদকের হাতে গ্রেফতার হন তিনি। তবে স্বামী সুব্রত এখনো দেশে ফেরেননি।

ভুয়া ঋণের মাধ্যমে ৮৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পি কে হালদার, ওকায়ামা ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান স্বামী সুব্রত দাস ও তার স্ত্রী শুভ্রা রানী ঘোষসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে ওই দিনই মামলা দায়ের করে দুদক। আর অ্যান্ডবি ট্রেডিংয়ের নামে নেওয়া ৩১ কোটি টাকার ঋণের বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন।

ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় প্রায় ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে দুদক। চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি দুদকের অনুরোধে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দিয়ে রেড অ্যালার্ট জারিও করে ইন্টারপোল।

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বিভিন্ন কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনেন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু ও সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে অন্তত চারটি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন।

কোম্পানিগুলো হলো, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। এসব কোম্পানি থেকে তিনি ঋণের নামে বিপুল অঙ্কের টাকা সরিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন।

ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতে দুদক এ পর্যন্ত ১৫টি মামলা করেছে। এসব মামলায় উল্লেখিত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১১০০ কোটি। এসব মামলায় এ পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮ জন আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।

আরএম/আরএইচ