একটি বিদেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফারের আলোকে ইভ্যালির ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি তৈরা হয়েছিল। প্রথমত ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। পরে দায়সহ কোনো প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোম্পানির কাছে বিক্রি করে লভ্যাংশ নিয়ে নেওয়া, কোম্পানির কাছে শেয়ারের অফার দিয়ে প্রলুব্ধ করে দায় চাপিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। তিন বছর পূর্ণ হলেই শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দায় চাপানোর পরিকল্পনাও নেওয়া হয়। সর্বশেষ দায় মেটাতে ‘দেউলিয়া ঘোষণার’ পরিকল্পনা করেছিলেন ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেল।

বৃহস্পতিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) ইভ্যালির সিইও মো. রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গুলশান থানায় মামলার পর বিকেলেই মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয় রাসেল দম্পতি। ওই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের পর শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে গুলশান থানায় তাদের সোপর্দ করে র‌্যাব।

তার আগে শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর কুর্মিটোলায় র‌্যাব সদরদফতরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ইভ্যালির ব্যবসায়িক কারসাজি দেশব্যাপী একটি বহুল আলোচিত বিষয়। কারসাজির মাধ্যমে লাখ লাখ গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে পণ্য ডেলিভারি না দেওয়ার বিষয়টি দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ইভ্যালি প্লাটফর্মে প্রতারিত হয় সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন লোভনীয় গগনচুম্বী অফার দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে সাধারণ জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বেশ কয়েকটি সংস্থা ইভ্যালির ব্যবসায়িক কাঠামো নিয়ে পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে।

অনিয়মের অভিযোগ উঠায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর ইভ্যালির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে। এছাড়া বিভিন্ন আলোচনায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি উঠে আসে।

এরই প্রেক্ষিতে মামলার পর ইভ্যালির সিইও মো. রাসেল (৩৭) এবং চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনকে (৩৫) গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার বিভিন্ন বিষয় ও কৌশল সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।

র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার এ পরিচালক বলেন, ইভ্যালির অন্যতম কর্ণধার গ্রেফতার মো. রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিন পরিকল্পিতভাবে একটি পরিবার নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়িক কাঠামো গড়ে তোলেন। একক সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বেচ্ছাচারিতা করার অবকাশ রয়েছে। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে। ফলে ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানের দায় বাড়তে বাড়তে বর্তমানে প্রায় অচলাবস্থায় উপনীত হয়েছে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে দায় ও গ্রাহকদের কাছে দায় নিয়ে বিচলিত প্রতিষ্ঠানটি। ইভ্যালির নেতিবাচক ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি উন্মোচিত হওয়ায় অনেক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও অর্থ লেনদেনের গেটওয়ে ইভ্যালি থেকে সরে এসেছে। এখন পর্যন্ত উত্তরণের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়নি সিইও রাসেল।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার রাসেল জানায়, ইভ্যালি ছাড়া তার আরও কয়েকটি ব্যবসায়িক প্লাটফর্ম রয়েছে সেগুলো হলো- ই-ফুড, ই-খাতা, ই-বাজার ইত্যাদি। ইভ্যালি’র ব্যবসায়িক কাঠামো শুরু হয়েছিল যৎসামান্য নিজস্ব ইনভেস্টমেন্ট দিয়ে। তার ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি ছিল তৈরিকারক ও গ্রাহক চেইন বা নেটওয়ার্ক থেকে বিপুল অর্থ তুলে নেওয়া।

কারা ইভ্যালিকে মদদ ও সহযোগিতা করেছে জানতে চাইলে র‌্যাব কর্মকর্তা কমান্ডার মঈন বলেন, অফার দিয়ে তিনি গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করেছেন। অফারে তিনি সাধারণ বা বহুল প্রচলিত পণ্যকেই টার্গেট করেন। তিনি চেয়েছিলেন মার্কেট ভ্যালু তৈরি করে দক্ষিণ এশিয়ায় পরিচিতি পাওয়া। গ্রাহকের টাকা ও লভ্যাংশের পুরোটাই তিনি এ কাজে ব্যবহার করেছেন।

দেশ ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করতে চেয়েছিলেন কি না জানতে চাইলে র‌্যাব কর্মকর্তা বলেন, একটি বিদেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফারের আলোকে ইভ্যালির ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি তৈরি করেন। প্রথমত একটি ব্রান্ড ভ্যালু তৈরির পরিকল্পনা করেন। পরে দায়সহ কোনো প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোম্পানির কাছে ইভ্যালিকে বিক্রি করে লভ্যাংশ তুলে নিতে চেয়েছেন। এ উদ্দেশে তারা বিভিন্ন দেশও ভ্রমণ করেন।

অন্যান্য পরিকল্পনার মধ্যে ছিল- বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির কাছে শেয়ারের অফার দিয়ে প্রলুব্ধ করে দায় চাপিয়ে দেওয়া। এছাড়া তিন বছর পূর্ণ হলে শেয়ার মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দায় চাপানোর পরিকল্পনা করেন। দায় মেটাতে বিভিন্ন অজুহাতে সময় বাড়ানোর আবেদন ছিল অপকৌশল মাত্র। সর্বশেষ তিনি দায় মেটাতে ব্যর্থ হলে ‘দেউলিয়া ঘোষণার’ পরিকল্পনা করেছিলেন। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে কিছু বলেননি।

ইভ্যালির সিইওর দেশের বাইরে কোনো প্রতিষ্ঠান গড়েছেন বা অর্থপাচার করেছেন কি না জানতে চাইলে র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মঈন বলেন, দেশের বাইরে তিনি প্রচারণা চালিয়েছেন অর্থলগ্নির জন্য। তবে এখনও তিনি কোনো প্রতিষ্ঠান গড়েছেন বলে তথ্য দেননি। অর্থপাচার করেছেন কি না তা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও তদন্ত করছে। তিনি অর্থপাচার করেছেন এমন তথ্যও তিনি র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানাননি।

জেইউ/এসএসএইচ