পুলিশের সেবার মান বাড়াতে পাঁচ বছর আগে চালুর কথা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এখনও চালু হয়নি অনলাইনে সাধারণ ডায়েরির (জিডি) প্রক্রিয়া। প্রায় দুই বছর আগে পরীক্ষামূলক (পাইলট প্রজেক্ট) শুরু হওয়া এ প্রক্রিয়া আটকে আছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে। যদিও গেল বছরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা ছিল মুজিববর্ষেই সব থানায় চালু হবে অনলাইন জিডি।

পুলিশ সদরদফতর বলছে, মুজিববর্ষে চালুর যে টাইমলাইন সে চেষ্টাই চলছে। সারাদেশে চালুর আগে অনলাইন জিডির প্রক্রিয়া পরীক্ষামূলকভাবে পৌনে দেড় বছর ধরে চলছে পাঁচ থানায়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সূত্রাপুর, কলাবাগান ও ক্যান্টনমেন্ট থানা এবং ময়মনসিংহের সদর ও ভালুকা থানায় এটি চলছে। নতুন করে পরীক্ষামূলকভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নয়টি থানায় চালু হয়েছে অনলাইন জিডির প্রক্রিয়া। 

‘এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। সুবিধা ও অসুবিধাগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। জনবল কেমন লাগবে তা পর্যালোচনা করেই চালু হবে অনলাইন জিডি’— বলছে পুলিশ সদরদফতর।

এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। সুবিধা ও অসুবিধাগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। জনবল কেমন লাগবে তা পর্যালোচনা করেই চালু হবে অনলাইন জিডি—  পুলিশ সদরদফতর

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্পের অংশ হিসেবে অনলাইন জিডি চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয় পাঁচ বছর আগে। ওই সময় (২০১৬ সাল) ডিএমপি জানিয়েছিল, তাৎক্ষণিকভাবে থানায় গিয়ে কেউ জিডি করতে ব্যর্থ হলে অনলাইনেও জিডি করা যাবে। সরাসরি পুলিশ সদরদফতরে ফ্যাক্স ও ই-মেইলে অভিযোগ জানানো যাবে। দেশের বাইরে থেকেও জিডি করা যাবে।

অনলাইন জিডি আবেদনের প্রথম ধাপ

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যিনি জিডি করবেন তার পরিচয় নিশ্চিত করতে না পারায় অনলাইনে জিডির প্রক্রিয়াটি কার্যকর হচ্ছে না।  হারিয়ে যাওয়ার মতো সাধারণ অভিযোগগুলো এ প্রক্রিয়ায় আনা সম্ভব হচ্ছে।

পুলিশ সদরদফতরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ সূত্রে জানা যায়, হুমকি, হারানো বস্তু উদ্ধারসহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে যেকোনো নাগরিক পুলিশের সহযোগিতার আশায় নিকটস্থ থানায় সাধারণ ডায়েরি বা জেনারেল ডায়েরি (জিডি) করেন। থানায় গিয়ে কীভাবে জিডি করতে হয়, তা অনেকেই জানেন না। জেনারেল ডায়েরি মানে সাধারণ বিবরণ। জিডি লেখার ক্ষেত্রে যুগোপযোগী পরিবর্তন আনা হয়েছে। ২০১৬ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রত্যেকটি থানায় সরবরাহ করা হয়েছে জিডি বুক। এর মধ্যেই শুরু হয় অনলাইন জিডির প্রক্রিয়া।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সূত্রাপুর, কলাবাগান ও ক্যান্টনমেন্ট থানা এবং ময়মনসিংহের সদর ও ভালুকা থানায় এ কার্যক্রম চলছে। নতুন করে পরীক্ষামূলকভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নয়টি থানায় চালু হয়েছে অনলাইন জিডির প্রক্রিয়া 

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘ডিজিটাল কেইস ডায়েরি’র ওপর পর্যালোচনা সভা শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, শিগগিরই চালু হচ্ছে অনলাইনে জেনারেল ডায়েরি (জিডি)। মানুষ ঘরে বসে মোবাইল বা কম্পিউটারের মাধ্যমে জিডি করতে পারবেন। শুরুতে ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’ জিডি করা যাবে। পর্যায়ক্রমে অনলাইনে সব ধরনের জিডি নেওয়ার সুবিধা সারাদেশে চালু হবে।

পুলিশ সদরদফতরের লজিস্টিক বিভাগের আইসিটি শাখা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের নভেম্বরে ময়মনসিংহ সদর ও ভালুকা থানায় এবং ডিএমপির কলাবাগান, ক্যান্টনমেন্ট ও সূত্রাপুরে পাইলট প্রজেক্টের অংশ হিসেবে অনলাইন জিডি শুরু হয়। চলতি বছরের মার্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নয়টি থানায় শুরু হয় এ প্রক্রিয়া। পুলিশের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও হেডকোয়ার্টার থেকে অনলাইন জিডিগুলো মনিটরিং করা হচ্ছে।

অনলাইন জিডি আবেদনের দ্বিতীয় ধাপ

২২ মাসে ডিএমপিতে ১১ হাজার ২৭টি অনলাইন জিডি

গত ২২ মাসে ডিএমপির সংশ্লিষ্ট থানায় অনলাইনে জিডি হয়েছে ১১ হাজার ২৭টি। মোট জিডির প্রায় ৯০ শতাংশই ‘লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড’। তবে বাতিল জিডির সংখ্যাই বেশি। এর হার প্রায় ৬০ শতাংশ।

এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডিএমপির তিন থানায় অনলাইন জিডি পরীক্ষামূলক চলছে। এটা পাইলট প্রজেক্ট। এর মাধ্যমে অনলাইন জিডির ক্ষেত্রে সুবিধা ও অসুবিধাগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। ডিএমপির সংশ্লিষ্ট বিভাগ ছাড়াও পুলিশ সদরদফতর এটি মনিটরিং করছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে পুলিশ সদরদফতর সিদ্ধান্ত নেবে।

যোগাযোগ করা হলে ময়মনসিংহ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অ্যাডমিন) খন্দকার ফজলে রাব্বি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এখানে অধিকাংশ জিডি হচ্ছে হারানোর। সংখ্যায় প্রায় ৮০ শতাংশ। কিছু নিখোঁজ ও হুমকির। পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে এর কার্যক্রম চলছে। এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার হাজারের মতো জিডি অনলাইনে নথিভুক্ত হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নয়টি থানায় ছয় মাস আগে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে অনলাইন জিডি। এখানে ভুক্তভোগী ছাড়াও থানার প্রশাসনিক জিডি হচ্ছে অনলাইনে। গেল ছয় মাসে জেলার নয় থানায় অনলাইন জিডি হয়েছে ১১ হাজার ৮৫২টি।

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কবে শুরু হবে অনলাইন জিডি— জানতে চাইলে পুলিশ সদরদফতরের ডিআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড প্লানিং) হায়দার আলী খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আপাতত বলা সম্ভব হচ্ছে না কবে শুরু হবে। পরীক্ষামূলকভাবে এটি চলছে। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। সুবিধা-অসুবিধা, কোন বিষয়ে জিডি বেশি হচ্ছে, আমলযোগ্য জিডির সংখ্যা, তদন্ত প্রক্রিয়া, জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট কেমন লাগবে— বিষয়গুলো পর্যালোচনা করতে হচ্ছে।’

অনলাইন জিডি আবেদনের তৃতীয় ধাপ

অনলাইন জিডিতে যা লাগছে

বর্তমানে পরীক্ষামূলকভাবে শুধুমাত্র ডিএমপির তিন থানা, ময়মনসিংহের দুই ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নয় থানায় এ কার্যক্রম চলছে। এর বাইরে অন্য কোনো থানায় হারানো অথবা প্রাপ্তিসংক্রান্ত জিডি অনলাইনে হচ্ছে না। এটি করতে প্রয়োজন জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, সচল মোবাইল নম্বর ও জন্ম তারিখ।

অনলাইন জিডি আবেদনের নিয়মাবলী

তিন ধাপে করা যাচ্ছে অনলাইন জিডি। প্রথমে http://gd.police.gov.bd সাইটে ঢুকতে হবে। সেখানে অনলাইনে জিডির একটি পেজ আসবে। জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, মোবাইল নম্বর ও জন্ম তারিখ লিখে সাবমিট করতে হবে। এরপর পরিচয় নিশ্চিতের জন্য এসএমএসের মাধ্যমে একটি কোড আপনার দেওয়া মোবাইল নম্বরে পাঠানো হবে।

দ্বিতীয় ধাপে নিজের জন্য নাকি অন্যের পক্ষে জিডি করবেন সেটি নির্বাচন করতে হবে। জিডির ধরন এবং কী হারিয়েছেন অথবা খুঁজে পেয়েছেন তা নির্বাচন করতে হবে। কোন জেলার কোন থানায় জিডি করতে চান তা নির্বাচন করুন, ঘটনার সময় ও স্থান লিখে ‘পরবর্তী ধাপ’ বাটনে ক্লিক করতে হবে।

সর্বশেষ অর্থাৎ তৃতীয় ধাপে আবেদনকারীর বর্তমান ঠিকানা ও ঘটনা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত বর্ণনা লিখতে হবে। জিডি সম্পর্কিত কোনো ডকুমেন্ট থাকলে সেগুলো সংযুক্ত করা যাবে। ই-মেইল অ্যাড্রেস লিখতে হবে। এরপর ‘সাবমিট’ বাটনে ক্লিক করলেই সম্পন্ন হবে অনলাইন জিডি। আবেদন সম্পন্ন হলে লগইন করে আবেদনকারী জিডির সর্বশেষ অবস্থাও জানতে পারবেন।

জেইউ/এমএআর/