দুর্নীতির লাগাম টানতে ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর দুর্নীতি দমন ব্যুরো থেকে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে সারাদেশে ২২টি সমন্বিত জেলা কার্যালয়কে কেন্দ্র করে চলছে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের কার্যক্রম।

মানুষের দোর-গোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি হটলাইন (১০৬) ও ফরেনসিক ল্যাবসহ নানা প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু অল্প সংখ্যক কার্যালয় ও সীমিত লোকবল নিয়ে ১৬ কোটির অধিক জনসংখ্যার বাংলাদেশে জনপ্রত্যাশা পূরণে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে। যে কারণে কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির পরিসর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

পরিসর বৃদ্ধির সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর কেটে গেছে প্রায় তিন বছর। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রায় দ্বিগুণ লোকবল নিয়ে দুদকের আরও ১৪টি সমন্বিত জেলা কার্যালয় স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নেওয়া সিদ্ধান্ত আজও ‘ফাইলবন্দী’ অবস্থায় পড়ে আছে।

মানুষের দোর-গোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি হটলাইন- ১০৬ ও ফরেনসিক ল্যাবসহ নানা প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু অল্প সংখ্যক কার্যালয় ও সীমিত লোকবল নিয়ে ১৬ কোটির অধিক জনসংখ্যার বাংলাদেশে জনপ্রত্যাশা পূরণে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে

সম্প্রতি শুধুমাত্র দুদকের কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয় চালুর উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও বাকিগুলোর কোনো খবর নেই। অন্যদিকে, ২০২০ সালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ২০তলা নতুন ভবনের জন্য গণপূর্ত অধিদফতর থেকে জমি বরাদ্দের বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত হলেও অদৃশ্য কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। বর্তমানে সেগুনবাগিচা- ১ এর পুরাতন একটি ভবনের অর্ধেকাংশে চলছে দুদকের প্রধান কার্যালয়ের কার্যক্রম। পাঁচতলা ভবনের পুরো অংশ বরাদ্দ না পাওয়ায় অনেকটা গাদাগাদি অবস্থায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়

দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ, ভবনটির প্রায় অর্ধেকাংশে অন্য একটি সরকারি সংস্থার কার্যালয় থাকায় করোনা মহামারির কঠিন সময়েও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করা যায়নি। ১০ বর্গফুটের ছোট একটি কক্ষে উপপরিচালক পদমর্যাদার চার থেকে পাঁচজনকে গাদাগাদি করে বসতে হয়েছে। পুরো ভবনেই প্রায় একই রূপ!

যদি নতুন কাঠামো অনুসারে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তাহলে তাদের কোথায় বসানো হবে? এভাবে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে লড়াই করা কতটুকু সম্ভব— প্রশ্ন তাদের। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের পাঁচতলা ভবনের পুরোটা বরাদ্দ পেলে স্থান বরাদ্দের সমস্যার সমাধান পাওয়া যেত— মনে করছেন দুদক কর্মকর্তারা।

দুদক সূত্রে জানা যায়, নতুন সাংগঠনিক কাঠামোতে প্রধান কার্যালয়ে দুটি নতুন অনুবিভাগ, দুটি নতুন বিভাগীয় কার্যালয়, ১৪টি নতুন জেলা কার্যালয়ে মোট দুই হাজার ১৪৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনুমোদন রয়েছে। বর্তমানে ৯৮৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত আছেন। যদিও ১৪৭ জন উপ-সহকারী পরিচালক ও ১৩২ জন সহকারী পরিচালকের নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষের দিকে রয়েছে।

পরিসর বৃদ্ধির সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর কেটে গেছে প্রায় তিন বছর। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রায় দ্বিগুণ লোকবল নিয়ে দুদকের আরও ১৪টি সমন্বিত জেলা কার্যালয় স্থাপনের কথা ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নেওয়া সিদ্ধান্ত আজও ‘ফাইলবন্দী’ অবস্থায় পড়ে আছে

দুদকের নতুন ১৪টি কার্যালয় স্থাপনের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মো. মোজাম্মেল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি অনেকবার আলোচনা করেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি অফিস সম্প্রসারণ, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ ও জনবল নিয়োগের জন্য প্রথম থেকেই বলে আসছি। তবে বিষয়গুলো সেভাবে কার্যকর করতে পারিনি। এটা আমার ব্যর্থতা হলে ব্যর্থতা। হতাশা প্রকাশ ছাড়া এ বিষয়ে আমার বলার কিছুই নেই।’

তিনি বলেন, নতুন কমিশন যেহেতু হয়েছে, এখন আমরা চেষ্টা করছি নতুন পদগুলো যত দ্রুত সম্ভব পূরণ, তাদের প্রশিক্ষিত করা এবং সম্প্রসারিত এলাকায় দুদকের কার্যালয় স্থাপনের ব্যবস্থা করা। এগুলো যদি করা যায় তাহলে আমাদের ওপর চাপ কমবে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব হবে। যদি আমরা ব্যর্থ হই তাহলে আমরা পিছিয়ে পড়ব। কারণ, এক জেলার সাধারণ মানুষ কখনই অন্য জেলায় গিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগ দেবেন না। এ প্রক্রিয়া যত সহজ ও স্বচ্ছ করা যাবে, মানুষ তত এগিয়ে আসবে।

এসএসসি পাশের সনদ জালিয়াতির অভিযোগে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিমের অভিযান / ফাইল ছবি

‘মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর আলাদা প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট আছে। আমাদেরও স্থায়ীভাবে একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রয়োজন’— মনে করেন দুদকের এ কমিশনার।

দুদকের বর্তমান অবকাঠোমো ও জনবল

২০০৪ সালের আগে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সময় দেশের ৬৪ জেলাতে ছিল কার্যালয়। দুদক প্রতিষ্ঠার পর তা গুটিয়ে ২২টি করা হয়। প্রধান কার্যালয়ে ছয়টি অনুবিভাগের আওতায় চলে দুদকের পুরো কার্যক্রম। এগুলো হলো- প্রশাসন, সংস্থাপন ও অর্থ অনুবিভাগ, অনুসন্ধান ও তদন্ত অনুবিভাগ, বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত অনুবিভাগ, প্রতিরোধ ও গবেষণা অনুবিভাগ, লিগ্যাল ও প্রসিকিউশন অনুবিভাগ এবং মানি লন্ডারিং অনুবিভাগ। তবে অনুমোদিত কাঠামোতে প্রশিক্ষণ ও তথ্যপ্রযুক্তি অনুবিভাগ এবং অনুসন্ধান ও তদন্ত- ২ অনুবিভাগ যোগ করা হয়েছে।

প্রধান কার্যালয় ছাড়া সারাদেশে দুদকের ২২টি জেলা কার্যালয় রয়েছে। এগুলো হলো- সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা- ১, সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা- ২, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়- ১, চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়- ২, রাঙ্গামাটি, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট, হবিগঞ্জ, বরিশাল, পাবনা, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, খুলনা, যশোর, কুমিল্লা, বরিশাল ও পটুয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়। যেখানে একজন চেয়ারম্যান, দুই কমিশনার, একজন সচিবসহ এক হাজার ২৭৪টি পদ রয়েছে। যদিও সেখানে কর্মরত আছেন ৯৮৭ জন। তবে অনুমোদিত জনবলে সেই সংখ্যা প্রায় দিগুণ করে দুই হাজার ১৪৬টি করা হয়েছে।

অনুমোদিত নতুন কার্যালয় ও জনবল

দেশজুড়ে দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে ১৪টি নতুন সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের অনুমোদন দেওয়া হয় ২০১৮ সালে। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর অনুষ্ঠিত কমিশনের বৈঠকে দুদকের নতুন সাংগঠনিক কাঠামোগত পরিবর্তন ও লোকবল নিয়োগের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। অনুমোদিত কার্যালয়গুলো হলো- ১. নারায়ণগঞ্জ, ২. গাজীপুর, ৩. মাদারীপুর, ৪. গোপালগঞ্জ, ৫. নওগাঁ, ৬. কিশোরগঞ্জ, ৭. জামালপুর, ৮. কুড়িগ্রাম, ৯. ঠাকুরগাঁও, ১০. চাঁদপুর, ১১. কক্সবাজার, ১২. ঝিনাইদহ, ১৩. পিরোজপুর ও ১৪. হবিগঞ্জ। এর মধ্যে শুধু কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ ও ভবন নির্মাণের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় অবস্থিত দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়

নতুন সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী আগের ছয়টি অনুবিভাগের সঙ্গে নতুন প্রশিক্ষণ ও তথ্যপ্রযুক্তি অনুবিভাগ এবং অনুসন্ধান ও তদন্ত- ২ অনুবিভাগ যোগ হয়েছে। এছাড়া দুদকের বিভিন্ন পদে এক হাজার ৬৮ জনের নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। পদভেদে জনসংখ্যার কাঠামো হলো- মহাপরিচালক পদে তিনজন, পরিচালক ১৮ জন, সিস্টেম অ্যানালিস্ট একজন, প্রোগ্রামার একজন, উপপরিচালক ১১০ জন, মেইনটেনেন্স ইঞ্জিনিয়ার একজন, সহকারী প্রোগ্রামার চারজন, সহকারী মেইনটেনেন্স ইঞ্জিনিয়ার দুজন, সহকারী পরিচালক ১৯৮ জন, মেডিকেল অফিসার একজন, প্রোটোকল অফিসার একজন, সহকারী পরিচালক (ইলেকট্রিক্যাল) দুজন, উপ-সহকারী পরিচালক ২৩৩ জন, কোর্ট পরিদর্শক ২৫ জন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা একজন, তৃতীয় শ্রেণির পদে ৩০৩ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির পদে ১৬৪ জন।

নতুন কাঠামো পাস হওয়ার পর তিন ধরনের পদে ২৮৭ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর মধ্যে সহকারী পরিচালক পদে ১৩২ জন, উপ-সহকারী পরিচালক পদে ১৪৭ জন এবং কোর্ট পরিদর্শক পদে ১৪৭ জনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এসব নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

আরএম/এমএআর/