সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন

ধামাকার ট্রেড লাইসেন্স নেই। ছিল না ব্যবসায়িক কোনো অ্যাকাউন্টও। প্রতারণার কৌশল হিসেবে ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লি. নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে ব্যবসায়িক লেনদেন করে ধামাকা। এখন পর্যন্ত প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে ওই অ্যাকাউন্টে। গ্রাহকদের এ টাকা ফেরতের বিষয়ে র‍্যাব বলছে, সরকার আন্তরিক। গ্রাহকরা ধৈর্য ধারণ করলে টাকা ফেরতের বিষয়ে একটা ব্যবস্থা বা প্রক্রিয়া অবশ্যই হবে।

বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গ্রাহকদের টাকা ফেরতের কোনো আশা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ কথা বলেন।

এর আগে বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) ভোরে র‍্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাব-২ এর অভিযানে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকা থেকে সিরাজুল ইসলাম রানা (৩৪), ইমতিয়াজ হাসান সবুজ (৩১) ও ইব্রাহিম স্বপনকে (৩৩) গ্রেফতার করে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-২ এর সমন্বিত দল।

তিনি বলেন, গ্রাহকদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। গ্রাহকদের টাকা ফেরত ও তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও কমিটি করা হয়েছে। র‍্যাব বিশ্বাস করে ধৈর্য ধারণ করলে গ্রাহকদের বিষয়ে একটি প্রসেস হবে।

তিনি বলেন, ইভ্যালির সিইও ও চেয়ারম্যানকেও আমরা গ্রেফতার করেছি। তাদের যদি গ্রেফতার না করা হতো তাহলে অনিয়মের বিষয়ে গ্রাহকরা কোনো তথ্য পেতেন না। তাদের গ্রেফতারের কারণে অনেক গ্রাহক সচেতন হয়েছেন। 
বিভিন্ন লোভনীয় অফারের মাধ্যমে প্রলুব্ধ করে সাধারণ জনগণের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন সংস্থা ই-কমার্সের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কাঠামো নিয়ে পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান অব্যাহত রেখেছে। অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ই-কমার্সের আড়ালে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাণিজ্য ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়েছে। 

আরও পড়ুন : বাইকে ধরা, আত্মহত্যা ছাড়া পথ নেই গ্রাহকের!

গত ২৩ সেপ্টেম্বর টঙ্গী পশ্চিম থানায় এক ভুক্তভোগী প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ধামাকা শপিং ডট কমের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিওওসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এছাড়া আরও বেশকিছু ভুক্তভোগীর অভিযোগ রয়েছে। গ্রাহকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আজ (বুধবার) প্রতিষ্ঠানটির তিন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার বিভিন্ন বিষয় ও কৌশল সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। সিরাজুল ইসলাম রানা ধামাকা শপিং ডট কমের সিওও। ইমতিয়াজ হাসান সবুজ মোবাইল ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ক্যাটাগরির হেড এবং ক্যাটাগরি হেড (ইলেক্ট্রনিক্স) হিসেবে ইব্রাহীম স্বপন যুক্ত রয়েছেন।

জানা যায়, ২০১৮ সালে ধামাকা ডিজিটাল যাত্রা শুরু করে। ২০২০ থেকে ধামাকা শপিং ডট কম নামে কার্যক্রম শুরু করে। গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তরা ২০২০ থেকে এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। গত বছরের অক্টোবর থেকে প্রতিষ্ঠানটি অ্যাগ্রেসিভ স্ট্র্যাটেজি নিয়ে মাঠে নামে। ধামাকা শপিং ডট কমের কোনো অনুমোদন ও লাইসেন্স নেই; ব্যবসায়িক অ্যাকাউন্ট নেই। ব্যবসা পরিচালনায় ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে ওই  অ্যাকাউন্টে মাত্র লাখ খানেক টাকা জমা রয়েছে। বর্তমানে সেলার বকেয়া রয়েছে প্রায় ১৮০-১৯০ কোটি টাকা, কাস্টমার বকেয়া ১৫০ কোটি টাকা এবং কাস্টমার রিফান্ড চেক বকেয়া ৩৫-৪০ কোটি টাকা।

জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্তরা জানান, আর্থিক সংকটের কারণে গত কয়েক মাস ধরে প্রতিষ্ঠানের অফিস এবং ডিপো ভাড়া বকেয়া রয়েছে; পাশাপাশি জুন ২০২১ থেকে কর্মচারীদের বেতন বকেয়া রয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ধামাকা শপিং ডট কম অর্থ অন্যত্র সরিয়ে ফেলার কারণে জুলাই থেকে সকল কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

গ্রেফতার হওয়া ধামাকার তিন কর্মকর্তা

কমান্ডার মঈন বলেন, মহাখালীতে তাদের প্রধান কার্যালয় এবং তেজগাঁও বটতলা মোড়ে একটি ডেলিভারি হাব রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৬০০টি ব্যবসায়িক চেইন রয়েছে। তার মধ্যে নামীদামি প্রতিষ্ঠানের নামও উঠে এসেছে।
ধামাকা শপিং ডট কম ছাড়াও তাদের আরও কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ইনভেরিয়েন্ট টেলিকম বাংলাদেশ লিমিটেড, মাইক্রো-ট্রেড ফুড এবং বেভারেজ লিমিটেড এবং মাইক্রো-ট্রেড আইসিক্স লিমিটেড উল্লেখযোগ্য। মূলত প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য তৈরিকারক ও গ্রাহক চেইন বা নেটওয়ার্ক থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়া। এছাড়াও হোল্ড মানি প্রসেস প্ল্যান অর্থাৎ গ্রাহক ও সরবরাহকারীর টাকা আটকে রেখে অর্থ সরিয়ে ফেলা ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। বিশাল অফার, ছাড়ের ছড়াছড়ি আর নানাবিধ অফার দিয়ে সাধারণ জনগণকে প্রলুব্ধ করা হতো। 

ধামাকা শপিং ডট কমের গ্রাহক সংখ্যা ৩ লাখের বেশি। মোবাইল, টিভি, ফ্রিজ, মোটরবাইক, গৃহস্থালি পণ্য ও ফার্নিচারসহ বিভিন্ন পণ্য অফারে বিক্রি করা হতো। বিভিন্ন লোভনীয় অফারগুলোর মধ্যে সিগনেচার কার্ড ২০ থেকে ৩০ শতাংশ, ধামাকা নাইটে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত, রেগুলারে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ছাড় অন্যতম। সিগনেচার কার্ড অফারটি গত মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত পরিচালনা করা হয়। এ অফারের মাত্র ২০ শতাংশ পণ্য সরবরাহ করে অর্থ সরিয়ে গ্রাহকদের চেক প্রদান করা হয়। অতঃপর ধীরে ধীরে সকল অর্থ সরিয়ে ফেলা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, ধামাকা শপিং ডট কম ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে মূলত তারা ইনভেন্টরই জিরো মডেল এবং হোল্ড মানি প্রসেস প্ল্যান অনুসরণ করত। কয়েকটি দেশি-বিদেশি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফারের আলোকে ধামাকা শপিং ডট কম ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজি তৈরি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ইনভেস্টমেন্ট ছিল না।

জেইউ/এসকেডি