চার বছর ধরে উড়োজাহাজ নিয়ে কাজ করছেন তরুণ এ উদ্ভাবক

ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন আশির উদ্দিন। পড়াশোনা করছেন চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের তৃতীয় সেমিস্টারে। মনের উদ্ভাবনী ক্ষুধা থেকে গত চার বছরের সাধনায় একে একে তৈরি করেছেন বিভিন্ন মডেলের নয়টি উড়োজাহাজ।

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার উপকূলীয় পুঁইছড়ি ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মাঝের পাড়ার ব্যবসায়ী শাহাব উদ্দিনের বড় ছেলে আশির উদ্দিন। এরই মধ্যে তার নানা উদ্ভাবনী কার্যক্রম সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে বেশ সমাদৃত হয়েছে।

উড়োজাহাজ ছাড়াও তিনি তৈরি করেছেন পানিতে চলার উপযোগী এয়ার বোট। তবে আশিরের স্বপ্ন বড় যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ তৈরি করা। নিজের বানানো উড়োজাহাজেই যাত্রী হওয়া।

এখন আমার তৈরি উড়োজাহাজ আকাশে ওড়ে। মানুষ দেখে খুশি হয়। একটা সময় ছিল হাসাহাসি করত সবাই। অনেকগুলো উড়োজাহাজ ওড়ানোর আগেই নষ্ট হয়ে যায়। ছোট ছোট অনেক উড়োজাহাজ নষ্ট হওয়ার পর সফলতা আসে। আগে যারা হাসাহাসি করত এখন তারা উৎসাহ দেয় আরও ভালো কিছু করার জন্য

সম্প্রতি এসব উদ্ভাবনী কাজ সম্পর্কে জানতে আশির উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত যা কিছু করেছেন সবই তার একক প্রচেষ্টায়।

উড়োজাহাজ তৈরির শুরুটা কীভাবে— জানতে চাইলে আশির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই উড়োজাহাজসহ বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন জিনিসের প্রতি আমার আগ্রহ। অন্যরা যখন মাঠে খেলাধুলা বা মোবাইলে গেমস খেলে সময় কাটাত, তখন আমি এগুলো নিয়ে পড়ে থাকতাম। বাড়ির ছাদের ওপর দিয়ে যখনই কোনো উড়োজাহাজ যেত, মনে মনে ভাবতাম; আমি যদি উড়োজাহাজ বানাতে পারতাম, আমার তৈরি উড়োজাহাজে ভ্রমণ করতে পারতাম!

এ পর্যন্ত নয়টি মডেলের উড়োজাহাজ তৈরি করেছেন আশির উদ্দিন

চার বছর ধরে উড়োজাহাজ নিয়ে কাজ করছেন তরুণ এ উদ্ভাবক। এখন পর্যন্ত নয়টি মডেলের উড়োজাহাজ তৈরি করেছেন। ড্রিম লাইনার বোয়িং ৭৮৭, ইউএস বাংলা, চেসনা, যুদ্ধবিমান এম ৩৯, মিগ ২৯, এমকিউ ড্রোন, নরমাল ড্রোন, হেলিকপ্টার ও এয়ার বোট রয়েছে তালিকায়

ওই আগ্রহ থেকেই চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে উড়োজাহাজের ওঠা-নামা দেখতাম— জানিয়ে আশির বলেন, ‘২০১৭ সাল থেকে উড়োজাহাজ তৈরির কাজ শুরু করি। পড়াশোনার পাশাপাশি যখনই সময় পেতাম তখনই কাজ করতাম। প্রথমদিকে অনেক উড়োজাহাজ ভাঙছে, ক্রাশ খাইছে। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ভুল করতে করেত একসময় আমি সফল হই। কারও কাছে প্রশিক্ষণ না নিয়ে নিজেই তৈরি করি একাধিক উড়োজাহাজ।

উড়োজাহাজ তৈরির জন্য আশির উদ্দিনের একটি ছোট ল্যাব রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন মডেলের উড়োজাহাজ, ড্রোন এমনকি এয়ার বোটও তৈরি করেছেন তিনি।

আশির উদ্দিন বলেন, ‘উড়োজাহাজ, ড্রোন বা এয়ার বোট— যাই তৈরি করি তা নিয়ে আগে বেশ চিন্তা-ভাবনা করি। এরপর কোন মডেল তৈরি করব ঠিক করার পর কাগজে তার স্কেচ আঁকি, তারপর সেটা নিয়ে কাজ শুরু করি। স্কেচ অনুযায়ী যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করে তা সংযোজনের উপযোগী করি। প্রয়োজনীয় ইলেকট্রিক্যাল কাজ শেষে যন্ত্রপাতি লাগিয়ে তার একটা কাঠামো দেওয়ার চেষ্টা করি।’

এ তরুণ উদ্ভাবক আরও বলেন, এখন আমার তৈরি উড়োজাহাজ আকাশে ওড়ে। মানুষ দেখে খুশি হয়। একটা সময় ছিল হাসাহাসি করত সবাই। অনেকগুলো উড়োজাহাজ ওড়ানোর আগেই নষ্ট হয়ে যায়। ছোট ছোট অনেক উড়োজাহাজ নষ্ট হওয়ার পর সফলতা আসে। আগে যারা হাসাহাসি করত এখন তারা উৎসাহ দেয় আরও ভালো কিছু করার জন্য।

তিন কেজি ওজনের বোয়িং-৭৮৭ ঘণ্টায় ২৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার গতিতে উড়তে সক্ষম

‘চার বছর ধরে উড়োজাহাজ নিয়ে কাজ করছি। এখন পর্যন্ত নয়টি মডেলের উড়োজাহাজ তৈরি করেছি। ড্রিম লাইনার বোয়িং ৭৮৭, ইউএস বাংলা, চেসনা, যুদ্ধবিমান এম ৩৯, মিগ ২৯, এমকিউ ড্রোন, নরমাল ড্রোন, হেলিকপ্টার ও এয়ার বোট রয়েছে তালিকায়।’

উদ্ভাবিত উড়োজাহাজগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার তৈরি ড্রিম লাইনারের ওজন সাড়ে তিন কেজি। এর আগে ইউএস বাংলার আদলে তৈরি উড়োজাহাজের ওজন ছিল আড়াই কেজির মতো। আকাশে ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট উড়তে পারত। যার সর্বোচ্চ রেঞ্জ চার কিলোমিটার, গতিবেগ ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার হবে। তিন কেজি ওজনের বোয়িং-৭৮৭ ঘণ্টায় ২৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার গতিতে উড়তে সক্ষম। রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে এগুলো আকাশে ওড়ানো হয়।’

আশির বলেন, এসব উড়োজাহাজ পরীক্ষামূলকভাবে বাড়ির আশেপাশে উড়িয়ে সফলতা পাই। তা দেখে অনেকে আমার কাছ থেকে উড়োজাহাজ বানিয়ে নেন। এমন প্রায় ৫০ থেকে ৬০টি উড়োজাহাজ বিক্রি করেছি। প্রতিটির দাম পড়েছে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে।

বিক্রির টাকায় উড়োজাহাজ তৈরির খরচ উঠে আসে কিনা— জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রাথমিক খরচ আমার পরিবারই বহন করছে। বিক্রির টাকায় পুরোটা আসে না। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় খরচ অনেক বেশি পড়ে। এ কারণে সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি। সরকারি সহায়তা পেলে দেশেই বোয়িং ৭৮৭ এর মতো উড়োজাহাজ তৈরি করা সম্ভব।’

বাঁশখালীর প্রত্যন্ত এলাকায় বসে উড়োজাহাজ, ড্রোন বা বোট তৈরির সরঞ্জাম সংগ্রহ করা ছিল কঠিন। সব যন্ত্রপাতি একসঙ্গে কিনতে পারতাম না, কারণ এগুলোর দাম খুব বেশি। একটি একটি করে সংগ্রহ করতাম। এখন তো ড্রোনের প্রচলন বেশি। উন্নত টেকনোলজির ড্রোনের যন্ত্রপাতি ঢাকায় পাওয়া যায়। সেসব যন্ত্রপাতি উড়োজাহাজের জন্য আমি কনভার্ট করেছি। ঢাকায় থাকা এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে যন্ত্রপাতিগুলো সংগ্রহ করি— বলেন তরুণ এ উদ্ভাবক।

আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী— ঢাকা পোস্টের এমন প্রশ্নের জবাবে আশির বলেন, ‘আমার হাত ধরে বাংলাদেশে একদিন ড্রিম লাইনারের মতো যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ তৈরি হবে। সেই উড়োজাহাজের যাত্রী হব আমি। এছাড়া উড়োজাহাজ তৈরির একটি প্রতিষ্ঠান খোলার স্বপ্ন আছে।’

‘বাংলাদেশে এখনও উড়োজাহাজ তৈরির কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। সরকার সহযোগিতা দিলে দেশেই আমরা উড়োজাহাজ তৈরির কারখানা তৈরি করতে পারি। বাইরে থেকে গবেষকও আনার প্রয়োজন নেই। কারণ, আমার তৈরি উড়োজাহাজগুলো আমারই গবেষণার ফল। সরকারি সহযোগিতা পেলে এটি আরও বিশদ আকারে করতে পারব।’

আশিরের উদ্ভাবিত ব্যাটারিচালিত বোটের আধুনিকায়নের কাজ চলছে

শুধু উড়োজাহাজ নয়, আশির উদ্ভাবিত ওয়াটার বোট ও ড্রোন নজর কেড়েছে সবার। ব্যাটারিচালিত বোটের আরও আধুনিকায়নের কাজ চলছে। এছাড়া তার তৈরি ড্রোন দিয়ে দুর্গম ও দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার ছবি তুলতে অথবা ফসলের ক্ষেতে কীটনাশক ছিটাতে ব্যবহার করা যাবে। ফায়ার সার্ভিসের আগুন নেভাতে, এমনকি জরুরি ওষুধ সরবরাহের কাজেও ব্যবহার করা যাবে আশির তৈরি ড্রোন।

ছেলের এমন উদ্ভাবনী কাজে উৎসাহ দেন লবণ ব্যবসায়ী বাবা মো. শাহাবুদ্দিন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই সে এসব নিয়ে পড়ে থাকত। আমরা তাকে বাধা দিতাম না। ইলেকট্রিক্যাল পণ্য খুলে নিমিষেই সে জোড়া দিতে পারত। আস্তে আস্তে সে ছোট ছোট বিমান ও রোবট তৈরিতে মনোযোগী হয়। এ ধরনের পণ্য তৈরিতে যে আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন, আমরা তা দিয়ে যাচ্ছি। তার স্বপ্ন এখন বৃহৎ পরিসরে কিছু করার। কিন্তু সেই সক্ষমতা তো আমাদের নেই। এজন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরাও চাই সে যেন যথাযথ সুযোগ-সুবিধা পাক এবং দেশের জন্য তার মেধা কাজে লাগাক।

আশির এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ উদ্ভাবন নিয়ে কথা হয় বাঁশখালী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইদুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, যেকোনো উদ্ভাবনী কাজে আমরা উৎসাহ দিই। যারাই এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত, আমরা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া চেষ্টা করি। আশির উদ্দিনের যদি কোনো সহযোগিতার দরকার হয়, প্রশাসন তার সামর্থ্যের মধ্যে সবকিছু করার চেষ্টা করবে।

কেএম/এসএম/এমএআর