বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত পাঁচ ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় আরও তিনজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা প্রত্যেকেই আহসানিয়া মিশনের প্রিন্টিং প্রেসের কর্মী।

সর্বশেষ পাঁচ ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাড়াও বেশ কিছু পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপা হয় ওই প্রিন্টিং প্রেসে। আহছানউল্লাহর আইসিটি টেকনিশিয়ান মুক্তারুজ্জামান রয়েলকে প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁসের মূল হোতা দাবি করেছে ডিবি পুলিশ।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ গ্রেফতার তিনজন হলেন আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিশিয়ান ল্যাব সহকারী পারভেজ মিয়া, আহসানিয়া প্রিন্টিং প্রেসের অফিস সহকারী (পিয়ন) দেলোয়ার হোসেন ও কাটিং মাস্টার রবিউল আওয়াল।

তেজগাঁও গোয়েন্দা পুলিশের দাবি, পাঁচ ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার দুইদিন আগে পিয়ন দেলোয়ার প্রশ্নপত্র বের করার অনুরোধ করেন প্রেসের কাটিং মাস্টার রবিউলকে। পরে তিনি ল্যাব সহকারী পারভেজ মিয়ার হাতে প্রশ্নপত্র তুলে দেন। যা পরে ছড়িয়ে দেন আহছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকনিশিয়ান মুক্তারুজ্জামান রয়েল। এজন্য দেলোয়ার ও রবিউল পান এক লাখ করে টাকা।

বুধবার (১৭ নভেম্বর) এই তিনজনকে গ্রেফতার করার পর বৃহস্পতিবার তাদের আদালতে সোপর্দ করা হলে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় জড়িত থাকার ব্যাপারে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছে ডিবি তেজগাঁও বিভাগ। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় এ নিয়ে গ্রেফতারের সংখ্যা দাঁড়াল ১২ জন।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ওয়াহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে গ্রেফতার হওয়াদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য, প্রশ্ন ফাঁসের তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ওই তিনজনকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির করা হলে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে ওই তিনজন প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। এর আগে পাঁচ ব্যাংকের প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত এই চক্রের ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় আরও যাদের সংশ্লিষ্টতার তথ্য মিলেছে তাদেরও গ্রেফতারে অভিযান ও তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুষ্ঠিত ৫টি ব্যাংকের ১৫১১টি ‘অফিসার ক্যাশ’ শূন্য পদের নিয়োগ পরীক্ষা গত ৬ নভেম্বর বিকেলে অনুষ্ঠিত হয়। এরমধ্যে সোনালী ব্যাংক ১৮৩টি, জনতা ব্যাংক ৫১৬টি, অগ্রণী ব্যাংক ৫০০টি, রূপালী ব্যাংক ৫টি এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে ৭টি পদ রয়েছে। বিকেল ৩টা হতে ৪টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে প্রশ্নপত্র তৈরি ও পুরো পরীক্ষা সম্পাদনের দায়িত্বে ছিল আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

তবে এই পাঁচ ব্যাংকের অফিসার (ক্যাশ) পদে নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। ডিবি পুলিশও ফাঁস চক্রের ৯ জনকে গ্রেফতার করে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা জানানোর পর ওই পরীক্ষা বাতিল করা হয়।

সেসময় গ্রেফতাররা হলেন- প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁসের মূল হোতা আহছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি টেকনিশিয়ান মুক্তারুজ্জামান রয়েল (২৬), জনতা ব্যাংকের গুলশান শাখার অফিসার শামসুল হক শ্যামল (৩৪), রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলন (৩০), পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলন (৩৮) ও পরীক্ষার্থী স্বপন।

একই রাতে জনতা ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তা এমদাদুল হক খোকন, সোহেল রানা, ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল জাবেদ জাহিদকে গ্রেফতার করা হয়।

গত ১০ নভেম্বর ডিবি পুলিশ সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। পরপর ব্যাংকের চারটি নিয়োগ পরীক্ষাতেই প্রশ্ন ফাঁস করেছে চক্রটি। প্রথম পর্বে প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেফতারের পর ডিবি পুলিশ আরও জানায়, চক্রে জড়িত ও গ্রেফতারদের তিনজনই সরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা। জড়িত সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রশ্নপত্র প্রণয়নসহ পরীক্ষা আয়োজনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি বিভাগ থেকে প্রশ্ন ফাঁস হয়। এ পর্যন্ত চক্রটি প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁসের মাধ্যমে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৬০ কোটি টাকা।

প্রশ্নপত্র ফাঁস সম্পর্কে ডিবি পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার বলেন, পরীক্ষার আগে প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের সদস্যরা রাজধানীর বাড্ডা, বসুন্ধরা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, রূপনগর, মিরপুর, মাতুয়াইল, শেওড়াপাড়া, শেরেবাংলা নগর, পল্লবী এলাকায় বুথ বসায়। যেখানে পরীক্ষার ৫/৬ ঘণ্টা আগে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্ন ও উত্তরপত্র মুখস্থ করানো হয়। চক্রের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে প্রত্যেক বুথে ২০/৩০ জন পরীক্ষার্থীর উক্ত পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করিয়ে কেন্দ্রে প্রেরণ করে। 

মহানগর ডিবি প্রধান বলেন, আমরা এ পর্যন্ত ১১টি বুথ, চক্রের ২৫/৩০ জনের নাম এবং প্রায় ২০০ জন পরীক্ষার্থীর নাম পেয়েছি। মুক্তারুজ্জামান রয়েল প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁসের মূল হোতা। তার কাছ থেকে প্রশ্ন নিয়ে শামসুল হক শ্যামল বিভিন্ন বুথে সরবরাহ করেন। জানে আলম মিলন ও মোস্তাফিজুর রহমান পরীক্ষার্থী সংগ্রহ ও বুথ নিয়ন্ত্রণ করেন। স্বপন পরীক্ষার্থী। তিনিও প্রশ্ন ও উত্তরপত্র সংগ্রহ এবং বুথ নিয়ন্ত্রণে জড়িত। 

জেইউ/এইচকে