বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো জেলা যশোর। ১৭৮৬ সালে উপমহাদেশের প্রথম জেলা হিসেবে যশোরের যাত্রা শুরু। বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল জেলাও যশোর।
 
দেশে প্রথম ই-সেবা কেন্দ্রও স্থাপন হয় যশোরে। ই-সেবা কেন্দ্রে গিয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়ে আবেদন ও রশিদ সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট সময়ে মধ্যেই মিলছে সেবা। কোনো ভোগান্তি নেই, নেই কোনো ঘুষের লেনদেন। স্বপ্নময় এমন বাস্তবায়ন শুরু হয় যশোর জেলার হাত ধরেই।
 
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের হাতের মুঠোয় তুলে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সেবা। গ্রামে বসেই মিলছে জমির পরচা, ভূমি উন্নয়ন কর, নামজারিসহ ভূমি সেবা। এছাড়া ডিজিটাল হাজিরা, অনলাইনে জনগণের অন্তর্ভুক্তি, অনলাইনে স্কুল ম্যানেজমেন্ট, ক্ষুদে বার্তায় নোটিশ, সভা আহ্বানসহ একনিমিষেই সবকিছুর বাস্তবায়ন হচ্ছে সুপ্রাচীন এ জনপদে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গঠনের উদ্যোগ হিসেবে বর্তমান সরকারের একান্ত প্রচেষ্টায় ডিজিটাল সেবার এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছে যশোর জেলা।
 
শুধু ডিজিটাল সেবাই নয়, যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয়েছে লাখো তরুণের স্বপ্নের দ্বার।

ডিজিটাল সেবা বাস্তবায়নে অভাবনীয় সফলতা দেখানোর জন্য বিভিন্ন সময় যশোরের জেলা প্রশাসকরা ‘বর্ষসেরা জেলা প্রশাসক’সহ নানা পুরস্কার পেয়েছেন। ‘ই-এশিয়া ২০১১’ ও ‘ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড- ২০১২’ এর মধ্যে অন্যতম।


 
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উদ্যোগে ঢাকার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকদের স্বপ্নের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ দেখাতে যশোরে নিয়ে যাওয়া হয়। সরেজমিনে যশোর ঘুরে ঢাকা পোস্টের চোখে সেই স্বপ্নের বাস্তব চিত্র ধরা পড়ে।
 
জেলা ই-সেবা কেন্দ্র

জেলা প্রশাসনের প্রশাসনিক ও সেবা দেওয়ার কাজ আরও সহজ ও দক্ষতার সঙ্গে করতে জেলা ই-সেবা কেন্দ্র চালু করা হয়। এর মাধ্যমে নাগরিক বা সরকারিপত্র খুব সহজে গ্রহণ করা হচ্ছে। আবেদনসমূহ স্ক্যান করে অনলাইন নথি হিসেব সঞ্চালিত হচ্ছে। জেলার রেকর্ড রুম থেকে জমির পরচাসহ বিভিন্ন কাগজপত্রের সত্যায়িত কপি ই-সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে সরবরাহের কাজ চলমান রয়েছে।
 
ডিজিটাল সেন্টার সেবা
 
যশোর জেলায় সব ইউনিয়ন ও পৌরসভা মিলে বর্তমানে মোট ১০৪ উদ্যোক্তা কাজ করছেন। তাদের মাসে গড়ে ৫০ হাজার টাকা করে আয় হয়। গড়ে প্রায় দুই হাজার নাগরিক সেবা পান। প্রান্তিক পর্যায়ের সরকারি সব সেবা এমনকি ব্যাংকিং সেবাও এ মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে। যশোর জেলার একজন নাগরিক জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বা উপজেলার ই-সেবা কেন্দ্রে না গিয়ে বাড়ির কাছের যেকোনো ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্র অথবা পৌর ডিজিটাল কেন্দ্রে গিয়ে সেবার আবেদন করতে পারছেন। 
 
শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব 
 
যশোর জেলায় চার ভাগে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট ৯৩টি শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন কলেজে ২৭টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬১টি, মাদরাসায় তিনটি এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি ক্লাস রুম শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। 


 
৯৩টি ল্যাবের মধ্যে আটটি অভয়নগর উপজেলায়, ১১টি কেশবপুর উপজেলায়, সাতটি বাঘারপাড়া উপজেলায়, ১৯টি যশোর সদর উপজেলায়, সাতটি চৌগাছা উপজেলায়, ১৭টি মণিরামপুর উপজেলায়, ১২টি ঝিকরগাছা উপজেলায় এবং শার্শা উপজেলায় ১২টি ল্যাব রয়েছে। এসব ল্যাব জেলার আইসিটি বিষয়ক বিভিন্ন প্রোগ্রামের (যেমন- ওয়েবপোর্টাল ট্রেনিং, ই-নথি ট্রেনিং, আউটসোর্সিং বিষয়ক ট্রেনিং, প্রোগ্রামিং ট্রেনিং) ভেন্যু হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। 
 
আউটসোর্সিং

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতরের সহযোগিতায় যশোর জেলায় ১৫ দিনব্যাপী বেসিক আইসিটি, গ্রাফিক্স ডিজাইন ও ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ২০১৯ ও ২০২০ সালে মোট ১২০ জনকে এ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের প্রায় ৪০ শতাংশ অনলাইন মার্কেটপ্লেসের পাশাপাশি স্থানীয় ও দেশীয় বিভিন্ন ক্রেতাদের জন্য কাজ করছেন এবং তারা নিজেরাও অন্যদের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলছেন। এছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে লার্নিং ও আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের মাধ্যমে যশোর জেলায় ২০২০-২১ অর্থবছরে এক হাজার জনেরও বেশি প্রশিক্ষণার্থী বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তারাও অনলাইন মার্কেটপ্লেসের পাশাপাশি স্থানীয় ও দেশীয় বিভিন্ন ক্রেতাদের জন্য কাজ করছেন। তাদের অনেকের মাসিক গড় আয় এক হাজার মার্কিন ডলার বা ৮০ হাজার টাকার বেশি। 
 
প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন

আইসিটি ইকোসিস্টেমে নারীদের অংশগ্রহণ, আইসিটিকে ব্যবহার করে নারীদের সমতা-সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে এ সেক্টরে তাদের অংশগ্রহণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো, নারী উদ্যোক্তা তৈরি এবং প্রযুক্তির সহায়তায় নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্প যশোর জেলায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় ফ্রিল্যান্সার টু এন্টারপ্রেইনার, আইটি সার্ভিস প্রোভাইডার ও ওমেন কল সেন্টার এজেন্ট- এ তিন ক্যাটাগরিতে মোট ৫০০ নারীকে লেভেল-১ এ তিন মাস প্রশিক্ষণ, দুই মাসের ইন্টার্নি; লেভেল-২ এ এক মাস প্রশিক্ষণ ও ছয় মাস ইন্টার্নি এবং লেভেল-৩ এ সফলভাবে উত্তীর্ণদের দুই সপ্তাহের উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ৮০ জনেরও বেশি সফল হয়েছেন। তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বর্তমানে কর্মরত আছেন।
 
ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা

যশোর জেলায় ইনফো সরকার তৃতীয় পর্যায় প্রকল্পের আওতায় ইউনিয়ন পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দেওয়া হচ্ছে। ৯৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৩৫টিতে এনএমএস ও ওয়াইফাই রাউটার সংযুক্ত হয়েছে। ৫৬টি ইউনিয়ন বিটিসিএলের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়েছে। এ জেলায় ৩৫ জন ইউডিসিকে বিনামূল্যে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা হচ্ছে এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৩৯ গ্রাহককে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দেওয়া হচ্ছে। গ্রাম পর্যায়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গ্রাহকের সংখ্যা এখানে দিন দিন বাড়ছে।


 
শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক

২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর ১২ দশমিক ১২ একর জমিতে তৈরি শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের উদ্বোধন করা হয়। এখানে এমটিবি ভবন, বিজনেস সেন্টার ও ডরমিটরি ভবন রয়েছে। এমটিবি ভবনটি ১৫তলা বিশিষ্ট। এ ভবনে বিনিয়োগের জন্য এক লাখ ৬৮ হাজার ৬৫৫ বর্গফুটের ভাড়াযোগ্য স্থান রয়েছে। এতে চারটি লিফট, দুটি ডেডিকেটেড ফায়ার সিঁড়ি ও ২৫০ জন ধারণক্ষমতার অডিটোরিয়াম রয়েছে।

এখানে সেন্ট্রাল এসি বিশিষ্ট বিজনেস সেন্টারটি তিনতলা। এতে চারটি মিটিং রুম, তিনটি কনফারেন্স রুম, লাউঞ্জ, ডুপ্লেক্স রেস্টুরেন্ট, ৩৫০ জন ধারণক্ষমতার অডিটোরিয়াম, ২০০ জন ধারণক্ষমতার একটি ফুড কোর্ট এবং ১০০ জন ধারণক্ষমতার একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে।

ডরমিটরি ভবনটি ১২তলা বিশিষ্ট। এতে রুম সংখ্যা ৭৮টি। এর মধ্যে ৩০টি টুইন শেয়ার, ৩৬টি ডিল্যাক্স, ১২টি সুইটস রুম রয়েছে। এছাড়া রয়েছে জিমনেশিয়াম, গেম জোন ও স্টিম বাথ। পুরো পার্কের পরিচালনা ব্যবস্থাপনা ও বিপণনের দায়িত্বে রয়েছে বেসরকারি টেকসিটি বাংলাদেশ লিমিটেড।

এ পার্কে মোট বিনিয়োগকারী ৫৬ জন। এর মধ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন ৪৬ জন। ভাড়া দেওয়া স্পেসের পরিমাণ এক লাখ ৩৫ হাজার ২৮৫ বর্গফুট। পার্কে প্রায় ১৫শ থেকে দুই হাজার জনবল কর্মরত। এ পার্কে বিনিয়োগকারীরা ১০ বছরের ট্যাক্স হলিডে (কর-অবকাশ) সুবিধা পাচ্ছেন। এছাড়া কাঁচামাল ক্রয়ে শুল্কমুক্ত আমদানির সুযোগ পাচ্ছেন তারা। পার্কের ভেতরে ২০১৫ সালে তিন পেটাবাইট ক্ষমতার ডিজাস্টার রিকভারি ডাটা সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। কখনও দুর্যোগের কবলে পড়লে এ ডাটা সেন্টার থেকে সহজেই তা উদ্ধার করা সম্ভব হবে। 
 
ই-কমার্স খাত

ই-কমার্স খাতে যশোরের অনেক উদ্যোক্তা বেশ এগিয়ে আছেন। এসব উদ্যোক্তা যশোরের স্থানীয় পণ্যকে সারা দেশে ব্র্যান্ড হিসেবে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।


 
যশোরের বিখ্যাত খেজুরের গুড় বা পাটালি গুড় সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দিচ্ছে ‘দেশি ফেরিওয়ালা’ নামক ওয়েবসাইট। এখানে ১১ জন স্টাফ রয়েছেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন ১৫০ জন গাছি। ‘নকশি কাঁথা’র সঙ্গে যুক্ত আছেন ৮০ জন নারী। ‘কেনারহাট’ নামক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে যুক্ত আছেন ১০০ জন গাছি। তারাও খেজুরের গুড় বা পাটালি গুড় সরবরাহ করছে সারাদেশে।

‘গ্রামের হাট’-এর সঙ্গে যুক্ত আছেন ৫০ জন ইউডিসি (ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার) উদ্যোক্তা। স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্য এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংগ্রহ করে তা সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

যশোর জেলা প্রশাসনের একটি সফল উদ্যোগ ‘অনলাইন পশুর হাট’। গত ঈদুল আজহায় এ হাটের মাধ্যমে ১২ কোটি ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকার পশু কেনাবেচা হয়েছে। প্ল্যাটফর্মটি শুধু পশুর হাট নয়, জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য যেমন- খেজুর গুড়, ফুল, নকশি কাঁথাসহ বিভিন্ন পণ্য ভোক্তার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে।
 
‘ডিজিটাল যশোর’ বাস্তবায়নের বিষয়ে জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশের কার্যক্রম যশোর জেলা দিয়েই শুরু। ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় সব সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। আইসিটি ব্যবহার করে এখানে অনেক নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশের যে স্বপ্ন আমরা দেখছি সেখানে অংশ নিতে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন। এসব জনবল তৈরিতে আমাদের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

তিনি বলেন, দেশে সর্বপ্রথম যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারি সেবা দেওয়া শুরু হয়। বর্তমানে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে যশোরজুড়ে বিভিন্ন ডিজিটাল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ঘোষণা দেয়। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ক্ষমতায় এসে সরকার দেশে হাইটেক পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ও আইটি সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। এমন অনেক উদ্যোগ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান, বাকিগুলোর কাজ এগিয়ে চলছে।

২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে জেলা ই-সেবা কেন্দ্র চালু হওয়ার পর তথ্যপ্রযুক্তি খাতে অগ্রগতির জন্য ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যশোর জেলাকে ‘বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা’ হিসেবে ঘোষণা দেন।
 
এএসএস/এইচকে