প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ফাল্গুনীশপ.কমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. পাভেল হোসেনকে সহযোগীসহ আটক করেছে র‌্যাব-৪। এ সময় তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ও মাদক জব্দ করা হয়েছে।

র‍্যাব-৪ সূত্রে জানা যায়, পাভেলের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ তার কাছে কোনো ভুক্তভোগী পণ্য অথবা টাকা চাইতে অফিসে গেলে পণ্য ও টাকা না দিয়ে উল্টো শারীরিক নির্যাতন করত। সে তাদের অস্ত্র দেখিয়ে বিভিন্নভাবে ভয়ভীতিসহ তার নিজস্ব টর্চার সেলে লাঠি পেটা, বৈদ্যুতিক শকসহ অন্যান্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে অফিস থেকে তাড়িয়ে দিত।

সম্প্রতি কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত ভুক্তভোগীর সুনির্দিষ্ট অভিযোগের প্রেক্ষিতে বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার (২৫ নভেম্বর) পর্যন্ত র‌্যাব-৪ এর একটি দল রাজধানীর খিলগাঁও থানাধীন বনশ্রী থেকে অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেফতার করে। অভিযানে ফাল্গুনীশপ.কম অফিস থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, দুই রাউন্ড গুলি, ২৪ ক্যান বিয়ার, চার বোতল দেশি মদ, একটি প্রাইভেটকার, কম্পিউটার, প্রিন্টার, বিপুল পরিমাণ এন-৯৫ মাস্ক, ১০০টি ইনভয়েস, ৩০ চেক বই, ৮০টি সিল ও বিপুল পরিমাণ বিজ্ঞাপনের স্ক্রিনশট জব্দ করা হয়।

এছাড়া অভিযানে প্রতিষ্ঠানটির ওয়ার হাউজ থেকে ৪২৩ কেজি চা পাতা, ৭১৫ কেজি চাউল, ৪১২ কেজি মসুর ডাল, ২৬০ কেজি ফুলক্রিম মিল্ক, ৮টি বাই সাইকেল, ৪৫০ লিটার সয়াবিন তেল, ২১৪ লিটার সরিষার তেল, ৫০ কেজি লবণ, ১১০ কেজি হুইল পাউডার, গ্লাস ক্লিনার, হারপিক অন্যান্য সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।

গ্রেফতাররা হলেন- মো. পাভেল হোসেন (৩০), মো. সাইদুল ইসলাম (৪০), আব্দুল্লাহ আল হাসান (২৫) ও মোছা. ফারজানা আক্তার মিম (২১)।

বৃহস্পতিবার (২৫ নভেম্বর) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‌্যাব-৪-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মোজ্জাম্মেল হক।

তিনি বলেন, ফাল্গুনীশপ.কমের কারসাজির মূলহোতা গ্রেফতার মো. পাভেল হোসেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটির সিইও এবং গ্রেফতার মো. সাইদুল ইসলাম, আব্দুল্লাহ আল হাসান, এবং মোছা. ফারজানা আক্তার মিম তার অন্যতম সহযোগী। মো. পাভেল ১৯৯১ সালে গোপালগঞ্জ জেলার সদর থানা এলাকায় জন্মগ্রহণ করে। তারা আট ভাই-বোন। তার মধ্যে সে চতুর্থ। তার বাবা গোপালগঞ্জ জেলার একটি সরকারি অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। সে ২০০৭ সালে গোপালগঞ্জের স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এসএসসি, ২০০৯ সালে ঢাকার একটি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ২০১৪ সালে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। ২০০৯ সালে এইচএসসি অধ্যয়নরত অবস্থায় সে একটি অস্ত্রসহ র‌্যাবের কাছে আটক হয় এবং তার বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় একটি অস্ত্র মামলা রয়েছে। ২০১৪ সালে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রজেক্টে রাজবাড়ীতে ৩০-৪০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি শুরু করে।

তিনি বলেন, পরে পাভেল বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের একজন ঠিকাদার হিসেবে কাজ করার সময় পরিচিত একজন তাকে অনলাইন ব্যবসা করার পরিকল্পনা দেয়। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৯ সালে মো. পাভেল দিদারুল আলম, কানিজ ফাতেমা ও রহমতুল্লাহ শওকত মিলে ফাল্গুনীশপ.কম নামে একটি অনলাইন বিজনেস প্লাটফর্ম তৈরি করে। শুরুতে তারা উত্তরা এলাকায় একটি ভাড়া করা স্পেসে আউটলেট খুলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করে। ব্যবসার শুরুতেই পাভেলের অন্য অংশীদাররা তার এ গ্রাহক ঠকানোর বিষয়টি বুঝতে পারে এবং তারা তার বিরুদ্ধে থানায় জিডি করে এবং এফিডেবিট করে উকিল নোটিশ পাঠিয়ে যৌথ ব্যবসা থেকে সরে যায়। তারা এ বিষয়টি জয়েন্ট স্টক অথোরিটিকেও অবহিত করে। পরে পাভেল তাদের নামে জাল সিল ও স্বাক্ষর ব্যবহার করে গ্রাহকদের প্রতারিত করত। এমনকি তাদের নাম ব্যবহার করে যৌথনামে চেক পর্যন্ত ইস্যু করত। ২০২১ সালের মে মাসে প্রতারণার অভিযোগে কয়েকজন গ্রাহক পাভেলের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় প্রতারণার মামলা দায়ের করলে পাভেলকে সিআইডি গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পর ২১ দিন জেলে থেকে জামিনে বের হয়ে এসে পাভেল আগের চেয়েও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। কিছু গ্রাহক ভোক্তা অধিকার অধিদফতরে অভিযোগ করলে অধিদফতর একাধিকবার ফাল্গুনীশপ.কমের আউটলেট বন্ধ করে দেয়। পরে চলতি বছরের জুলাই মাসে পাভেল বনশ্রী এলাকায় ‘অরিমপো.কম’ ও ‘টেকফেমিলি.কম’ নামে নতুন অফিস স্থাপন করে। এ দুটি অফিসের আড়ালে ফাল্গুনীশপ.কমের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল পাভেল।

যেভাবে ভিকটিমদের টাকা আত্মসাৎ করত চক্রটি

র‍্যাব-৪ এর অধিনায়ক বলেন, এ প্রতারক চক্রের সদস্যরা করোনা মহামারিতে লকডাউন চলাকালে অনলাইনে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী স্বল্প মূল্যে বিক্রির চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করে। তাদের এ বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে ক্রেতারা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং বিপুল পরিমাণ অর্ডার দিতে থাকে। পরে প্রতারক প্রতিষ্ঠানটি কিছু কিছু ক্রেতাদের নিম্নমানের পণ্য আবার কিছু কিছু ক্রেতাদের কোনো পণ্য সরবরাহ না করে টাকা আত্মসাৎ করে।

চক্রটির প্রতারণার কৌশল

তিনি বলেন, প্রতারণার কৌশল হিসেবে পাভেল শুরু থেকেই তার অনলাইন শপ ‘falgunishop.bd এবং ফেসবুক পেজ ফাল্গুনীবিডির মাধ্যমে বিভিন্ন নিত্যপণ্য নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করবে বলে অনলাইনে বিজ্ঞাপন প্রচার করে ক্রেতা আকৃষ্ট করত। পরে সাধারণ লোকজন তার দেওয়া বিজ্ঞাপন দেখে স্বল্প মূলে পণ্য পাওয়ার আশায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করত। ক্রেতারা যোগাযোগ করলে সে তাদের বলে যে পণ্যের মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করতে হবে। তখন সাধারণ লোকজন তার কথা সরল মনে বিশ্বাস করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পণ্যের মূল্য চক্রের মূলহোতা পাভেলকে অগ্রিম পরিশোধ করত। টাকা পেয়ে সে ক্রেতাদের চাওয়া পণ্য না দিয়ে নিম্নমানের পণ্য পাঠিয়ে দিত আবার কিছু কিছু সময় কোনো পণ্যই পাঠাত না। পরে সে আর ওই ক্রেতার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করত না। এভাবে পাভেল ও তার সহযোগীরা দীর্ঘদিন ধরে ক্রেতাদের টাকা আত্মসাৎ করে আসছিল।

প্রতারণার আরেক কৌশল হিসেবে সে কোনো প্রকার অবগতি ছাড়া অফিসের ঠিকানা পরিবর্তন করত। যাতে প্রতারিত গ্রহকরা অফিসে এসে কোনো প্রকার অভিযোগ না করতে পারে। এছাড়া পাভেল অনলাইন ব্যবসার আড়ালে মাদক ব্যবসাও পরিচালিত করত।

মো. মোজ্জাম্মেল হক বলেন, শুরুতে তারা উত্তরা এলাকায় একটি ভাড়া স্পেসে আউটলেট খুলে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করলেও সর্বশেষ বনশ্রী এলাকায় ভাড়া স্পেসে তাদের এ কার্যক্রম চলছিল। বর্তমানে একইস্থানে তাদের দুটি ওয়ার হাউজ চালু রয়েছে। বর্তমানে পাভেলের কোম্পানিতে ১০-১২ জন কর্মচারী রয়েছে। অনলাইন শপ ফাল্গুনীশপ.কম কোনো ব্যাংক হিসাব নেই। পাভেলের চারটি বিভিন্ন ব্যাংকে নিজস্ব হিসাবে বর্তমানে প্রায় ১৫ লাখের বেশি টাকা রয়েছে। আরও জানা যায়, ২০১৯ সাল থেকে পাভেলের নিজস্ব ব্যাংক হিসাব থেকে প্রায় চার কোটির অধিক টাকা লেনদেন হয়েছে। তার নামে ফাল্গুনীশপ.কম, ফাল্গুনীশপ এবং ফাল্গুনীশপ বিডিসহ সর্বমোট ২৮টি নামসর্বস্ব কোম্পানির সন্ধান পাওয়া যায়। তবে ফাল্গুনীশপ.কম এ কোম্পানি ছাড়া বাকি ২৭টি কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

এমএসি/এসএসএইচ