রাজধানীর সমস্যাগুলো কমিয়ে পরিকল্পিত শহর গড়ার লক্ষ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। চলতি মাসেই ড্যাপ গ্যাজেট আকারে প্রকাশ হবে। প্রস্তাবিত ড্যাপ ২০১৬-২০৩৫ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০২১ বাস্তবায়ন হলে ভবনের আয়তন প্রায় ৩৩ শতাংশ থেকে ৫৩ শতাংশ কমে যাবে। ফলে ফ্ল্যাটের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়বে বলে আশঙ্কা করছে আবসান খাত সংশ্লিষ্টরা।

রাজউকের উদ্যোগে প্রণীত নতুন ড্যাপে থাকছে- ভূমি পুনর্বিন্যাস, উন্নয়নস্বত্ব, প্রতিস্থাপন পন্থা, ভূমি পুনঃউন্নয়ন, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, উন্নতিসাধন ফি, স্কুল জোনিং ও ডেনসিটি জোনিং। ওয়ার্ডভিত্তিক জনঘনত্বের বিষয়ে দিকনির্দেশনাও থাকবে সংশোধিত ড্যাপে। এছাড়া সড়ক, উন্মুক্ত স্থান এবং পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্যুয়ারেজসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা সরবরাহের সামর্থ্য বিবেচনায় নতুন ভবনের উচ্চতা নির্ধারণে কাজ করছে রাজউক।

সংশোধিত ড্যাপে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে- ঢাকার চারপাশের ৫৬৬ কিলোমিটার নদীপথ সচল করা এবং এক হাজার ২৩৩ কিলোমিটার সড়ককে হাঁটার উপযোগী করা। এ পরিকল্পনায় শহরের বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে স্কুলভিত্তিক উন্নয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত ড্যাপ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজউকের অন্তর্ভুক্ত এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে মোট ৪৬৮টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। পরে জরিপ করে প্রতিটি ব্লকের জনসংখ্যার ধারণক্ষমতা, সড়ক অবকাঠামো, নাগরিক সুবিধা এবং সেখানে উন্নয়নের ধরনের ওপর ভিত্তি করে আবাসিক ভবনের উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে। রাজউকের অন্তর্ভুক্ত এলাকায় দুই হাজার ১৯৮ কিলোমিটার জলাধার সিএস রেকর্ড অনুযায়ী উদ্ধার করে সচলের সুপারিশ করা হয়েছে। একইসঙ্গে এসব এলাকাকে বিনোদন স্পটে পরিণত করারও সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে।

ড্যাপে ভূমি ব্যবহার প্রস্তাবনায় ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ৬০ শতাংশ এলাকাকে নগর ধরা হয়েছে। এতে আবাসিক এলাকা ৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ, মিশ্র ব্যবহার এলাকা (আবাসিক প্রধান) ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ, মিশ্র ব্যবহার এলাকা (আবাসিক-বাণিজ্যিক) শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ, বাণিজ্যিক এলাকা শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ, মিশ্র ব্যবহার এলাকা (বাণিজ্যিক প্রধান) ১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, মিশ্র ব্যবহার এলাকা (শিল্প প্রধান) ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক এলাকা ৪ দশমিক ১ শতাংশ, ভারী শিল্প এলাকা ১ দশমিক ৬৩ শতাংশ, পরিবহন যোগাযোগ (বিদ্যমান) ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ, পরিবহন যোগাযোগ (প্রস্তাবিত) ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ, কৃষি এলাকা ২৯ দশমিক ২২ শতাংশ, জলাশয় ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ, বনাঞ্চল ১ দশমিক ৪১ শতাংশ, উন্মুক্ত স্থান ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ রাখা হয়েছে।

পাশাপাশি ঢাকার কেন্দ্রে জনসংখ্যার চাপ কমাতে বিভিন্ন এলাকায় সুষম উন্নয়ন এবং মেট্রোপলিটন এলাকাকে বাসযোগ্য গড়ে তুলতে বিদ্যমান ধারণক্ষমতা, সড়ক অবকাঠামোর ধারণক্ষমতা, বিদ্যমান নাগরিক সুবিধার ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনায় এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব জোনিং প্রণয়ন করা হয়েছে।

সম্প্রতি প্রস্তাবিত ড্যাপ ও ঢাকা ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বিষয়ে রিয়েল এস্টেট হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রতিক্রিয়ায় সংগঠনের সভাপতি শামসুল আলামিন কাজল জানিয়েছেন, নতুন আইনে ২০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন ৫ কাঠা জমিতে ৫তলার বা ৯০০০ বর্গফুটের বেশি ভবন করা যাবে না। যা আগের নিয়মে করা যেত ৮তলা বা সাড়ে ১৩ হাজার বর্গফুট। একইভাবে ২০ ফুটের কম রাস্তা সংলগ্ন জমিতে ৩/৪তলার বেশি ভবন নির্মাণের সুযোগ থাকবে না। ফলে সীমিত জমিতে ফ্ল্যাট সংখ্যা আরও কমে যাওয়ায় আবাসন সংকট দেখা দেওয়ার পাশাপাশি ঢাকা শহরে ফ্ল্যাটের দাম ৫০ শতাংশ বেড়ে যাবে।

তিনি বলেন, প্রস্তাবিত আইন পাস হলে, সিরামিক, টাইলস, ইট, পাথর, বালিসহ আবাসন শিল্প সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ২৬৯টি শিল্পেও ধস নামবে। রিহ্যাব মনে করে, নতুন আইনের ফলে সৃষ্টি হওয়া সংকটের কারণে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়াও বাড়বে।

আবাসন ও সংশ্লিষ্ট শিল্প রক্ষা এবং রাজধানীতে স্বল্প ভাড়া ও নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই নিশ্চিত করতে প্রস্তাবিত ড্যাপ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০২১ আমূল পরিবর্তন করার দাবি জানায় রিহ্যাব।

সম্প্রতি রাজউক আয়োজিত খসড়া ড্যাপ ২০১৬-২০৩৫ চূড়ান্তকরণের লক্ষ্যে জাতীয় সেমিনারে ড্যাপ রিভিউ সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আহ্বায়ক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা কেউ সুউচ্চ ভবনের বিপক্ষে নই। এমনকি আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজেও উঁচু ভবনের পক্ষে। কিন্তু এটি করার জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা বিশেষ করে ইউটিলিটি সার্ভিস, রাস্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, খেলার মাঠ ও বিনোদন কেন্দ্রসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করে করতে হবে। পাঁচ-সাত কাঠা জমির উপর উঁচু ভবন এবং যেগুলো নিয়ে অসামঞ্জস্য রয়েছে সেগুলো নিয়ে রিভিউ করা হবে। এ পরিমাণ জায়গায় কতটুকু ভবন করা যায় সেটি আলোচনা করে ঠিক করা হবে। আমরা শহরটাকে বসবাসের অযোগ্য বানাতে পারি না।

মন্ত্রী বলেন, ঢাকা শহরকে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আবাসযোগ্য নগরীতে রূপান্তর করতে চেষ্টা করছি। সব আর্থসামাজিক শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রয়োজন, জীবনযাত্রার উন্নয়ন ও মৌলিক বিষয়গুলো এবারের ড্যাপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এলক্ষ্যে ইতোমধ্যে নগর পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, পেশাজীবী, পরিবেশবাদী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মেয়র এবং কাউন্সিলরসহ সবপক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করে তাদের পরামর্শ ও মতামত নেওয়া হয়েছে।

ড্যাপ পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, ২০৩৫ সালে ঢাকা কোন পর্যায়ে যেতে পারে সেই সব বিবেচনা করে আমরা পরিকল্পনা সাজিয়েছি। নগর বিশেষজ্ঞ, পরিকল্পনাবিদসহ সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতে আমরা ড্যাপ প্রস্তুত করেছি। আগের ড্যাপের সঙ্গে নতুন করে অনেক কিছু সংযুক্ত করা হয়েছে। আমরা আশাবাদী, শিগগিরই ড্যাপ বাস্তবায়ন হবে। কোন ওয়ার্ডে, কোন এলাকায় কত রাস্তাঘাট আছে, তার ওয়ার্কিং পেপার আমরা প্রস্তুত করেছি।

ড্যাপ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, যেভাবে জনকল্যাণ হবে, সেভাবেই ড্যাপ বাস্তবায়ন করা উচিত। সেক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত হবে না। দ্রুত ড্যাপ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং খেয়াল রাখতে হবে, কোনো কারণে যেন নাগরিক সুবিধার পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত না হয়।

এর আগে পাঁচ বছর মেয়াদি ড্যাপের মাস্টার প্ল্যান প্রথম প্রণয়ন করা হয়েছিল ২০১০ সালে। ২০১৫ সালে প্রথম ড্যাপের মেয়াদ শেষ হয়। বর্তমানে সময় বাড়িয়ে নগর উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে রাজউক। সংশোধিত নতুন ড্যাপের মেয়াদ হবে ২০ বছর।

এবার ড্যাপের খসড়া বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাতেই এটি গেজেটভুক্ত হবে। বাংলাতে এর খসড়া প্রকাশ করায় বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ সহজে মতামত ব্যক্ত করতে পেরেছেন। সবার মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে খসড়া ড্যাপের বিজ্ঞানভিত্তিক ও যৌক্তিক কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে।

এএসএস/এসএসএইচ