ভাইরাল হওয়ার নেশা চেপে বসেছিল তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসানকে। এজন্য করতেন বিতর্কিত মন্তব্য। এ নেশাই শেষ পর্যন্ত কাল হলো তার। ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেওয়ার পর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশ পেয়েছেন সোমবার। আজকের (মঙ্গলবার) মধ্যেই ছাড়তে হবে প্রতিমন্ত্রীর পদ।

প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি ঢাকা পোস্টকে জানান, কারও কথাই শুনতেন না তিনি। ইচ্ছামতো চলতেন। আলোচনায় থাকতে চাইতেন। সেজন্য করতেন বিতর্কিত সব মন্তব্য।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি নিজের মতো করে চলতেন। তাকে কে বোঝাবে?

আরেক কর্মকর্তা বলেন, অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কারও কথাই কানে তুলতেন না। মন যা চায় তাই বলতেন। মন্ত্রণালয়েও তার আচরণ ছিল অত্যন্ত খারাপ।

তার বাজে আচরণ থেকে রেহাই পেতেন না মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। কারণে-অকারণে করতেন অশ্রাব্য গালাগালি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিমন্ত্রীর দফতরের সাবেক এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, তার ব্যবহার খুব খারাপ ছিল। অশোভন আচরণ কাকে বলে তার সঙ্গে কাজ না করলে বুঝবেন না। মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘তোকে লাথি মারব’।

অন্য একটি ঘটনার ব্যাপারে ওই কর্মকর্তা বলেন, আরেকজনকে ফাইল দিয়ে মারতে উঠেন তিনি। বলেন, ‘তোকে আজ শেষ করে দেব।’

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না। তিনি সীমালঙ্ঘন করেছেন। এজন্যই তার এমন পরিণতি— মনে করেন ওই কর্মকর্তা।

রাষ্ট্রধর্ম ও ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া নিয়ে বক্তব্য দিয়ে প্রথম আলোচনায় আসেন ডা. মুরাদ হাসান। গত অক্টোবরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ কোনো ধর্ম ব্যবসায়ী, মৌলবাদীদের আস্তানা হতে পারে না। যেকোনো মূল্যে ’৭২ এর সংবিধানে ফিরে যেতে হবে। বিষয়টি নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে।

এর আগে সদ্য বরখাস্ত হওয়া গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীরের ২২ লাখ টাকা মূল্যের মোটরসাইকেলে হেলমেট ছাড়া ঘুরে সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি।

সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তার ছেলে তারেক রহমান ও নাতনি জাইমা রহমানকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করেন তিনি।

প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যায়, অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের এক প্রশ্নের জবাবে হাস্যরস করতে করতে নারীদের নিয়ে অশালীন মন্তব্য করেন তিনি। এসময় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়েও আপত্তিকর মন্তব্য করতে দেখা যায় তাকে।

এরপর নারীবাদী সংগঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলে এমপি মুরাদের শাস্তির দাবি ওঠে। কয়েকটি নারী সংগঠন বিবৃতিও দিয়েছে এ বিষয়ে। এছাড়া বিএনপির পক্ষ থেকে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও নাতনি জাইমা রহমানকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।

এদিকে গত শনিবার (৪ ডিসেম্বর) একটি টিভি টকশোতে উপস্থিত বিএনপির একজন সাবেক নারী এমপিকে ‘মানসিক রোগী’ বলে অভিহিত করে তার সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়ান তিনি।

এছাড়া এক চিত্রনায়িকার সঙ্গে মুরাদ হাসানের আপত্তিকর ফোনালাপ ফাঁস হয়। মুহূর্তের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় এটি।

ভাইরাল সেই অডিওর সত্যতা নিশ্চিত করেন চিত্রনায়ক ইমন। তিনি বলেন, ‘যা শুনেছেন তাই। এটি আসলে বছরখানেক আগের ঘটনা। একটি সিনেমার মহরত অনুষ্ঠানের আগের রাতে প্রতিমন্ত্রী আমাকে ফোন করেছিলেন। বাকিটা তো আপনারা শুনেছেনই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া এবং শামসুন নাহার হলের ছাত্রলীগ নেত্রীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যও করেন এ প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘তারা শিষ্টাচারের সংজ্ঞাটা আমাদের শেখাতে চাচ্ছে। তসলিমা নাসরিনের মতো অনেক তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশে আছে, দুঃখ লাগে কোনটা জানেন? এরা আবার জয় বাংলার কথা বলে। এরা ছাত্রলীগ করছে নাকি, এরা আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে, এরা নাকি আবার নেত্রী ছিল কোনো কোনো হলে। কিন্তু রাতের বেলা এরা নিজেদের হলে থাকতেন না, ঘুমাতেন হোটেলে হোটেলে। কারণ ফাইভ স্টার হোটেলে থাকার মজা, আর রোকেয়া হল ও শামসুন নাহার হলে থাকাটা কি এক কথা? আমি এর চেয়ে বেশি বললে মিছিল শুরু হয়ে যেতে পারে। আমি আর বেশি কিছু বলব না।’

মুরাদ হাসান পেশায় চিকিৎসক ও আওয়ামী লীগপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে প্রথমে মুরাদ হাসানকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ২০১৯ সালের মে মাসে স্বাস্থ্য থেকে তাকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এসএইচআর/এসএসএইচ