একাত্তরের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, নারীনেত্রী, সাহিত্যিক ও উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতি বেগম মুশতারী শফীর কফিনে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। 

বুধবার সকালে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম শহীদ মিনারে। সেখানে ফুল দিয়ে সংগ্রামী এ নারীর কফিনে শেষ শ্রদ্ধা জানান স্বজন, গুণগ্রাহী, অনুজ ও অনুসারীরা। 

শহীদ মিনারে জাতীয় পতাকা মোড়া কফিনে জানানো হয় রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আ স ম জামশেদ খন্দকারের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক বেগম মুশতারী শফীকে গার্ড অব অনার দেয় পুলিশের একটি দল। 

মুশতারী শফীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মৃতিচারণ করেন কবি আবুল মোমেন, চবি উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার, উপ-উপাচার্য বেণু কুমার দে, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা বালাগাত উল্লাহ, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু, প্রমার সভাপতি রাশেদ হাসান প্রমুখ। 

একে একে শ্রদ্ধা জানান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আবসার, নারী নেত্রী নূরজাহান খান, প্রফেসর রীতা দত্ত, নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার, লেখিকা আনোয়ারা আলম, ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী, প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার, ডা. চন্দন দাশ, শীলা দাশগুপ্ত, কবি আশীষ সেন, রাশেদ হাসান, রমেন দাশগুপ্ত, প্রণব চৌধুরী প্রমুখ। 

এছাড়াও, শ্রদ্ধা জানায় সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, উদীচী, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, প্রজন্ম, ৭১, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর , যুব ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন, সনাক, বোধন, প্রমা, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ বিভিন্ন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন।

শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো শেষে দুপুরে তার মরদেহবাহী গাড়িটি চলে যায় জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদে। সেখানে জোহরের নামাজের পর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে দুপুর ২টা ৩৫ মিনিটের দিকে চৈতন্য গলি কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।

২০ ডিসেম্বর বিকেল ৪টার দিকে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মুশতারী শফী। পরদিন রাতে তাকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। ৮৩ বছর বয়সী মুশতারী শফী দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভুগছিলেন। এছাড়া, বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগও ছিল তার। মৃত্যুকালে তিনি দুই ছেলে ও চার মেয়েসহ অসংখ্য স্বজন রেখে গেছেন।

মুশতারী শফী ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার স্বামী মোহাম্মদ শফী এবং ছোট ভাই এহসানকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। তার পরিবার একাত্তরে চট্টগ্রামে স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তিনি ওই বেতারকেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে কাজ করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি একাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়া ষাটের দশক থেকে তিনি নারী আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন জোরদার হলে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনে ভূমিকা পালনের পাশাপাশি তিনি এতে নেতৃত্বও দেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রয়াণের পর দেশজুড়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।

এছাড়া, বেগম মুশতারী শফী দীর্ঘসময় ধরে চট্টগ্রামসহ সারা দেশে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ও নাগরিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি উদীচী চট্টগ্রামের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার মুশতারী শফী দেশে প্রগতিশীল চেতনার বাতিঘর হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালনের জন্য তাকে বাংলা একাডেমি কর্তৃক ২০১৬ সালে ‘ফেলোশিপ’ দেওয়া হয়।

কেএম/আরএইচ