‘কাকা আমার মা কোথায়। মা তো আমাদের সঙ্গে লঞ্চে ছিল। মাকে দেখছি না কেন। আমার মাকে এনে দাও।’ দগ্ধ অবস্থায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পোস্ট অপারেশন ইউনিটে চিকিৎসাধীন লামিয়া অনেক কষ্ট করে ধীরে ধীরে তার কাকা মো. আল-আমিনের কাছে মায়ের খোঁজ নিচ্ছিলেন।

ভাতিজি লামিয়ার মাকে খোঁজার এমন আকুল আবেদন দেখে বার বার চোখে পানি চলে আসছিল আল-আমিনের। কিন্তু ভাতিজির শারীরিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে সত্যটা লুকাচ্ছেন তিনি। ভাতিজিকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আল-আমিন বলেন, ‘তোমার মা লঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে নামার সময় পায়ে ব্যথা পেয়েছেন। তিনি ভালো আছেন, পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি আছেন। দ্রুত সুস্থ হয়ে তোমার মা তোমাকে দেখতে আসবেন।’

এ মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে নিজেই পোস্ট অপারেশন ইউনিটের সামনে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন আল-আমিন। তিনি বলেন, ‘আমি কিভাবে আমার ভাতিজিকে বলব, তার মা ও ছয় বছরের ছোট বোন লঞ্চে আগুন লাগার পর থেকে নিখোঁজ আছে।’

শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) বিকেলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পোস্ট অপারেশন ইউনিটের সামনে ঢাকা পোস্টকে এসব কথা বলেন আল-আমিন।

ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে আল-আমিনের মা মমতাজ বেগম (৭৫) ও বড় ভাই মো. ইসমাইল তার দুই মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে আল-আমিনের ভাবি ও লামিয়ার মা কল্পনা (৪৫), ছয় বছরের ভাতিজি নুসরাত নিখোঁজ রয়েছেন। আরেক ভাতিজি লামিয়া আক্তার (১৪) ও আলামিনের মা মমতাজ বেগম আগুনে দগ্ধ হয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আছেন।

আল-আমিন বলেন, আমাদের বাড়ি বরগুনা পরীরখাল এলাকায়। দুর্ঘটনার মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে মা ইসমাইল ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। ইসমাইল ভাই ঢাকায় একটা চাকরি করেন এবং সে তার পরিবার নিয়ে বাড্ডা এলাকায় থাকেন। ঘটনার দিন মা এবং ভাই যখন লঞ্চে উঠে সদরঘাট থেকে তখন তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ভাতিজি লামিয়ার স্কুলের ছুটি থাকায় তারা সবাই বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিল।

ঘটনার রাতের বর্ণনা দিয়ে আলা-আমিন বলেন, রাত প্রায় তিনটার দিকে হঠাৎ আমার ফোনে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। আমি কলটি রিসিভ করতে করতে কেটে যায়। পরে আমি কল ব্যাক বকরলে, আমার ভাই ফোন রিসিভ করে বলে, আল-আমিন বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। তোর ভাবি ও ছোট ভাতিজি নুসরাতকে খুঁজে পাচ্ছি না‌। আর মা ও তোর বড় ভাতিজি আগুনে দগ্ধ হয়েছে। আমিও পায়ে ব্যথা পেয়েছি। আমাদের বরিশাল মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছে তুই এখানে আয়।

আল-আমিন আরও বলেন, এ কথা বলে ভাই ফোন কেটে দেয়। পরের দিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার বরিশাল মেডিকেলে দেখা হয়। সেখানে গিয়ে দেখি মায়ের দুই হাত পা পুড়ে গেছে এবং ভাতিজি লামিয়ার মুখ পুড়ে গেছে। তখন ভাই আমাকে বলে যে রাতে হঠাৎ করে লঞ্চে আগুন লেগে যায়। আগুন লাগার পর আমার বড় ভাই মাকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেয়, এবং ভাতিজি লামিয়াকে নিয়ে অন্য আরেক জন লোক পানিতে ঝাঁপ দেয়। কিন্তু আমার ছোট ভাতিজি আর ভাবির কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

পরের দিন তাদের বরিশাল মেডিকেল থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। আমার মার শারীরিক অবস্থা কিছুটা ভালো। তবে ভাতিজির মুখ পুড়ে গেছে সেজন্য সে ঠিকভাবে কথা বলতে পারে না। তবে যখনই ভিতরে গিয়ে দেখা করি, সে বারবার তার মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু তার মাকে আমরা কোথায় থেকে এনে দিব। তার মা ও ছোট বোন তো নিখোঁজ রয়েছে। তখন আমি মিথ্যা সান্ত্বনা দেই, তোমার বাবার মতো তোমার মাও পায়ে ব্যথা পেয়েছি সে জন্য তাকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

আল-আমিন আরও বলেন এ ঘটনার পর থেকে ভাই পাগলের মত হয়ে গেছে। কোনো জায়গা থেকে লাশ ভেসে উঠার খবর আসলে সে সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন আল্লাই জানে ভাবি ও ভাতিজিকে খুঁজে পাবো কিনা। ছোট ভাতিজির কথা মনে হলে বারবার কান্নায় বুক ভেঙ্গে আসতেছে।

বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের ইঞ্জিনে বিস্ফোরণের পর পুরো লঞ্চে ভয়াবহ আগুন ছড়িয়ে পড়ে। লঞ্চটি ভাসতে ভাসতে পোনাবালিয়া ইউনিয়নের দেউরি এলাকার সুগন্ধা নদীর তীরে আটকে যায়। 

এ ঘটনায় ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব লোকমান হোসেন মিয়া। তিনি জানান, অগ্নিকাণ্ডে আহত ৮১ জনকে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৪৬ জনের চিকিৎসা চলছে। ১৬ জনকে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। নিহত ৪১ জনের ৩৭ জনই বরগুনার বাসিন্দা। 

এদিকে পরিচয় না পাওয়ায় ২৭ জনের লাশ খাকদোন নদীর তীরে গণকবরে দাফন করা হয়েছে। বাকি ১০ জনের লাশ শনাক্ত হওয়ায় স্বজনরা নিয়ে দাফন করেছেন।

এমএসি/আইএসএইচ