অতিরিক্ত যাত্রী বহনের জন্য এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটিতে গত মাসে (নভেম্বরে) অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ইঞ্জিন সংযোজন করা হয়। ৬৮০ হর্স পাওয়ার ইঞ্জিন পরিবর্তন করে ৭২০ হর্স পাওয়ারের জাপানি রিকন্ডিশনড ইঞ্জিন সংযোজন করা হয়। এক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। লঞ্চটিতে কর্মরত মাস্টার ও ড্রাইভারদের মধ্যে ৩ জনের জাহাজ চালানোর অনুমোদনও ছিল না।

শুধু তাই নয়, দুর্ঘটনার সময় অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ও লাইফ সেভিং সরঞ্জামও পর্যাপ্ত ছিল না। অগ্নিনিরাপত্তা পদ্ধতি, আগুন শনাক্তের যন্ত্র ও সতর্কীকরণ পদ্ধতিতেও দুর্বলতা ছিল।

ঘটনার সময় ত্রুটির কারণে লঞ্চটির ইঞ্জিনে বিকট শব্দ হচ্ছিল। চিমনি দিয়ে স্বাভাবিকভাবে ধোঁয়া বের হচ্ছিল না। সঙ্গে ছিল অস্বাভাবিক গতি। এক পর্যায়ে ইঞ্জিন রুমে বিকট শব্দে ধোঁয়ার কুণ্ডলি বের হয়। তখন পুরো লঞ্চের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ইঞ্জিন রুম থেকেই লঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। আগুন দেখার পর কাছাকাছি তীরে ভিড়িয়ে যাত্রীদের বাঁচানোর চেষ্টা না করে কর্মচারীরা সবাই পালিয়ে যায়।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং-এর পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে নির্মম অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক হতাহতের ঘটনায় লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখকে গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য জানাতে এ সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাব।

র‌্যাব কমান্ডার মঈন বলেন, দুর্ঘটনার দিন রাত আনুমানিক ৩টার দিকে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের ইঞ্জিন থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। লঞ্চটির ইঞ্জিন কক্ষ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। এক পর্যায়ে আগুন পুরো লঞ্চটিতে ছড়িয়ে পড়ে।

দুর্ঘটনার পর কাছাকাছি থাকা র‌্যাব সদস্যরা উদ্ধার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। পরে ঢাকা থেকে র‌্যাবের হেলিকপ্টার ঘটনাস্থলে পৌঁছে হতাহতদের অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়।

ঘটনার দিন র‌্যাবের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এরপর র‌্যাব মহাপরিচালক বরিশাল মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া ওই দুর্ঘটনায় আহতদের দেখতে যান।

নির্মম ওই অগ্নিদুর্ঘটনায় র‌্যাব তদন্ত শুরু করে এবং জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। ইতোমধ্যে দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

কমান্ডার মঈন বলেন, তদন্ত সংশ্লিষ্ট র‌্যাব কর্মকর্তা ও তদন্ত কমিটিসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দুর্ঘটনায় লঞ্চ কর্তৃপক্ষের অবহেলা রয়েছে। লঞ্চে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ও লাইফ সেভিং সরঞ্জাম পর্যাপ্ত ছিল না। অগ্নিনিরাপত্তা পদ্ধতি, আগুন শনাক্তের যন্ত্র ও সতর্কীকরণ পদ্ধতিতে দুর্বলতা ছিল বলে জানা যায়। লঞ্চের ইঞ্জিনের তাপমাত্রা নির্ধারণ যন্ত্র সঠিক ছিল না।

ওই ঘটনায় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-৮ ও ১০ এর অভিযানে সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) সকালে কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখকে (৫৩) গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার মো. হামজালাল শেখ ১৯৮৮ সাল থেকে দীর্ঘদিন জাপান প্রবাসী ছিলেন। তিনি ২০০০ সালে জাপান থেকে দেশে এসে একটি লঞ্চ কেনেন। বর্তমানে তার মালিকানায় ৩টি লঞ্চ রয়েছে। এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি ৪ জনের মালিকানাধীন থাকলেও তিনিই মূল মালিক (৫০ শতাংশ শেয়ার হোল্ডার) এবং সবকিছু ব্যবস্থাপনা ও নজরদারি করতেন।

গ্রেফতারের পর র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে হামজালাল শেখ জানান, অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে লঞ্চটিতে গত নভেম্বরে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন ইঞ্জিন সংযোজন করা হয়, যাতে দ্রুত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। বিলম্বে ছেড়ে গন্তব্যে আগে পৌঁছানো গেলে লঞ্চে যাত্রীর সংখ্যা বেশি পাওয়া যায়। এ লক্ষ্যে গত নভেম্বরে লঞ্চটিতে ৬৮০ হর্স পাওয়ার ইঞ্জিন পরিবর্তন করে ৭২০ হর্স পাওয়ার ইঞ্জিন সংযোজন করা হয়। কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান থেকে ইঞ্জিন পরিবর্তন করা হয়নি।

লঞ্চটির আগের ইঞ্জিন ছিল চায়নার, যেটি কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদিত ছিল। সেটি পরিবর্তন করে একজন সাধারণ মিস্ত্রির মাধ্যমে জাপানে তৈরি রিকন্ডিশনড ইঞ্জিন সংযোজন করা হয়। এক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে কারিগরি পরিদর্শন বা অনুমোদন নেয়নি। এছাড়া কোনো ট্রায়াল রান সম্পন্ন হয়নি।

গ্রেফতার হামজালাল জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানিয়েছে, লঞ্চটিতে আগুন লাগার ১০ মিনিটের মধ্যে সুপারভাইজার আনোয়ার মোবাইল ফোনে আগুন লাগার বিষয়ে অবহিত করে। কিন্তু তিনি কোনো সংস্থা বা জরুরি সেবা কোথাও বিষয়টি জানাননি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মোবাইলে যে আলাপ হয়েছে তাতে তিনি ধারণা করছেন সব ক্রুরা আগুন লাগার পর জলন্ত অবস্থায় রেখে লঞ্চটি ত্যাগ করে। ফলে মর্মান্তিক এই ঘটনা ঘটে। তিনি আরও জানান, তার ক্রুদের পরিবারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কারো হারিয়ে যাওয়া বা মৃত্যুবরণ করার কোনো তথ্য পাননি।

গ্রেফতার হওয়া লঞ্চ মালিক যাত্রাপথের সময় কমানোর ব্যাপারে ঘটনার দিন দুপুর আড়াইটা থেকে ৩টা পর্যন্ত লঞ্চের মাস্টার ও স্টাফদের নির্দেশনা দেন। ইঞ্জিন পরিবর্তনের পর এ পর্যন্ত তিনবার বিভিন্ন গন্তব্যে লঞ্চটি গমন করে।

কমান্ডার মঈন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে হামজালাল শেখ জানিয়েছেন, যাত্রীদের জন্য কোনো লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা ছিল না। শুধুমাত্র তার কর্মচারীদের জন্য ২২টি লাইফ জ্যাকেট ছিল। যাত্রীদের জন্য ১২৭টি বয়া ছিল বলে তিনি দাবি করেন। তবে অধিকাংশ বয়াই যথাস্থানে ছিল না। এছাড়া লঞ্চটির কোনো ইনস্যুরেন্স করা ছিল না।

এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, ওই লঞ্চটিতে স্টাফ ছিল ২৬ জন। ঘটনার পর মালিককে গ্রেফতার করা সম্ভব হলেও অন্যান্য মাস্টার বা স্টাফরা পলাতক। তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হলে লঞ্চে অগ্নিদুর্ঘটনার কারণ আরও পরিষ্কারভাবে জানা যাবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান মঈন বলেন, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়, ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ এ ঘটনা তদন্ত করছে। ফৌজদারি অপরাধ, গাফিলতি ও অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করছে।

গ্রেফতার হওয়া এমভি অভিযান-১০ লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন বলে জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।

উল্লেখ্য, গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি ঝালকাঠি পার হওয়ার পর সেটিতে আগুন লেগে যায়। আগুন লাগার পর লঞ্চটির স্টাফরা এটি তীরে না ভিড়িয়ে সামনের দিকে চালাতে থাকে। এতে আগুন আরও বেড়ে যায় এবং অল্প সময়ের মধ্যে গোটা লঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ৫শ যাত্রীকে বিপদের মধ্যে রেখে লঞ্চের সব স্টাফ সটকে পড়ে। এ ঘটনায় আগুনে পুড়ে এবং নদীতে ডুবে অন্তত ৪১ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক যাত্রী। এছাড়া এখনো নিখোঁজ আছেন অনেকে। ধারণা করা হচ্ছে এদের অনেকেই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আর উঠতে পারেননি। 

জেইউ/জেডএস