করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন মোকাবিলায় বিধিনিষেধ আরোপ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল থেকে আলোচনা শুরু হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এরইমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতর দেশব্যাপী ১৫টি নির্দেশনা দিয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও জানিয়েছেন, ওমিক্রনের বিস্তার ঠেকাতে সরকার বিধিনিষেধ নিয়ে ভাবছে। তবে অতি সংক্রামক এই ভ্যারিয়েন্টকে তুলনামূলক কম শক্তিশালী এবং বাংলাদেশে ছড়ানোর মাত্রা বিবেচনায় এখনই বিধিনিষেধ আরোপের সময় আসেনি বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

তাদের দাবি, দেশে ওমিক্রন এখনও সেভাবে বিস্তার লাভ করেনি। তাছাড়া এই ভ্যারিয়েন্ট তুলনামূলকভাবে অন্যসব ভ্যারিয়েন্ট থেকে কম শক্তিশালী। তাই আরও পর্যবেক্ষণ করে বিধিনিষেধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এদিকে, সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানও (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, এখনো ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়নি। এ অবস্থায় সংক্রমণ প্রতিরোধে আপাতত স্বাস্থ্যবিধি মানায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জার (জিআইএসএআইডি) তথ্যমতে, দেশে এখন পর্যন্ত ১০ জনের ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। গত ১১ ডিসেম্বর দেশে প্রথম দুজনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্তের কথা জানা যায়। ওই দুজন জিম্বাবুয়েফেরত বাংলাদেশি দুই নারী ক্রিকেটার ছিলেন।

এরপর গত ২৭ ডিসেম্বর একজন এবং ২৮ ডিসেম্বর আরও চারজনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্তের তথ্য আসে জিআইএসএআইডির ওয়েবসাইটে।

ওমিক্রন নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই : কারিগরি কমিটির সদস্য সচিব

দেশে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ নিয়ে এতটা ভীত বা আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছেন সরকারের করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য সচিব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ওমিক্রন নিয়ে এখন পর্যন্ত কারিগরি কমিটির কোনো প্রস্তাবনা দেওয়া হয়নি। আমরা দেখেছি যে পার্শ্ববর্তী ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশেই ওমিক্রন ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত ওমিক্রন নিয়ে কারিগরি কমিটির কোনো সভা হয়নি।

অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ওমিক্রন নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট এসে যদি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টকে সরিয়ে জায়গা দখল করে নেয়, তাহলে খুবই ভালো হবে। কারণ, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের চেয়েও মারাত্মক ও ক্ষতিকারক।

আমাদের দেশে বর্তমানে করোনা সংক্রমণ বাড়ার কারণ মূলত ওমিক্রন নয়, বরং স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা। আমরা দেখছি যে প্রচুর পরিমাণে বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে আপনারা দেখছেন লাখ লাখ মানুষ ঘুরতে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের কেউই মাস্ক পরছে না, স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এসব কারণেই দেশে সংক্রমণ বাড়ছে।

বিধিনিষেধ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো বিধিনিষেধের সময় আসেনি। অনেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার কথা বলছে, আমি মনে করি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়েও কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়নি। শুনেছি শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেবেন, এখনও বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছেন। 

কিন্তু ওমিক্রন নিয়ে ইউরোপিয়ান যেসব রিপোর্ট আর কথাবার্তা আসছে, এতে বোঝা যায় যে, ওমিক্রন নিয়ে এতোটা আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা, কারফিউ জারি করা.. এসবে সাধারণ মানুষ ভয় পেয়ে যায়। এত ভীত হওয়া বা আতঙ্কিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে ভ্যারিয়েন্টটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, বলেন অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। 

বিশিষ্ট এই ভাইরোলজিস্ট বলেন, ইউরোপে যে রকমটা হয়েছে, আমাদের দেশেও যদি এরকম হয়, তাহলে হয়ত আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেও রাখতে পারি। কিন্তু সেটা আগে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে।

ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়নি : আইইডিসিআর

দেশে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হলেও এটি এখনো ছড়ায়নি বলে জানিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর। তিনি জানান, ওমিক্রন নিয়ে এখনও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে, তবে ওমিক্রনের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়নি।

তিনি বলেন, আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে যাদের বয়স বেশি, যারা ফ্রন্টলাইন কর্মী, যাদের কমোরবিডিটি আছে ভাইরাস দুর্বল হলেও তাদেরকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করতে পারে। সেজন্য ওমিক্রন যেহেতু প্রচণ্ড সংক্রমণশীল একটি ভাইরাস, যদি বাংলাদেশে এটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায়, তাহলে কিন্তু ঘরে ঘরে রোগী হবে। আর পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর একটা বড় প্রভাব পড়বে।

ডা. আলমগীর বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে করোনা সংক্রমণ বাড়ার কারণ মূলত ওমিক্রন নয়, বরং স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা। আমরা দেখছি যে প্রচুর পরিমাণে বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে আপনারা দেখছেন লাখ লাখ মানুষ ঘুরতে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের কেউই মাস্ক পরছে না, স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। এসব কারণেই দেশে সংক্রমণ বাড়ছে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে সংক্রমণ বাড়ার পেছনে ওমিক্রনের সঙ্গে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। এখনো দেশের বিভিন্ন জায়গায় মানুষ হসপিটালাইজড হচ্ছে, সেটার সঙ্গে হয়তো ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের একটা সম্পর্ক আছে। এখনও আমরা দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের আধিপত্যই দেখছি।

ওমিক্রনের মৃদু উপসর্গ, এতটা ভয়াবহ নয় : এবিএম আবদুল্লাহ

দেশের প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওমিক্রন নিয়ে আসলে এই মুহূর্তে কিছু বলা কঠিন। পৃথিবীতে যে হারে এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে যাচ্ছে, খারাপের শঙ্কাটাই বেশি। কিন্তু আমরা আসলে এখন পর্যন্ত এতটা সিরিয়াস না। তবে আমাদেরকে অবশ্যই সিরিয়াস হতে হবে।

তিনি বলেন, এটি একটি মিউট্যান্ট ভাইরাস। যেকোনো মুহূর্তে এটি তার রূপ পরিবর্তন করতে পারে। এখনো হয়ত এর ভয়াবহ রূপ আমরা দেখতে পাইনি, কিন্তু যেকোনো মুহূর্তেই এই ভ্যারিয়েন্ট তার মারাত্মক রূপ দেখাতে শুরু করবে, তখন আমাদের কিছুই করার থাকবে না।

এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, এখন পর্যন্ত বলা হচ্ছে- ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের মৃদু উপসর্গ, এতটা ভয়াবহ না, বাসায় বসেই এর চিকিৎসা হয়, কিন্তু যেকোনো মুহূর্তেই ভাইরাসটি মিউট্যান্ট হয়ে ভয়াবহ হতে পারে। সবমিলিয়ে বলা যায়, যে হারে এই ভ্যারিয়েন্ট সারাবিশ্বে ছড়িয়ে যাচ্ছে, নতুন বছরে ওমিক্রন আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং আমাদেরকে আগে থেকেই সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে এবং টিকা নিতে হবে।

সতর্কতায় গুরুত্বারোপ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে, আমাদের দেশে যেকোনো মুহূর্তেই ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমাদেরকে এখন থেকেই কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে। যারাই দেশের বাইরে থেকে আসবে, হোক সেটা স্থল, বিমান বা নদী পথ সবাইকেই স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনতে হবে। এছাড়াও কঠোরভাবে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে।

বর্ডারগুলোতে স্কিনিং আরও জোরদার করা হয়েছে। কোয়ারেন্টাইনে যারা থাকবে, তারা যাতে বাইরে ঘোরাফেরা না করে সেজন্য সেখানে পুলিশি প্রহরা থাকবে।

ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেওয়া উচিত কি না জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, ভারতের সঙ্গে এখনি সীমান্ত বন্ধের প্রয়োজন নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় হয়নি। আমাদের দেশে এখনও সংক্রমণ পাঁচ শতাংশের নিচে আছে। উপরে উঠে গেলেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। লকডাউনেরও সময় হয়নি। পরিস্থিতি আরও পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তারপরই চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

পরিস্থিতি খারাপ হলে লকডাউনের চিন্তা মাথায় আছে : স্বাস্থ্যমন্ত্রী

এদিকে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক মঙ্গলবার (৪ জানুয়ারি) সচিবালয়ে এক সভায় জানিয়েছেন, দেশে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হলে লকডাউনের চিন্তা মাথায় আছে। মন্ত্রী বলেন, অনেকে জিজ্ঞাসা করে যে লকডাউন দেওয়া হবে কি না, পাশের দেশে তো দিয়েছে। তবে আমরা সেই চিন্তা এখনো করছি না। যদি পরিস্থিতি হাতের বাইরে যায়, সংক্রমণ অনেক বৃদ্ধি পায়; তাহলে লকডাউনের চিন্তা মাথায় আছে। 

তিনি বলেন, আমাদের বর্ডারগুলোতে স্কিনিং আরও জোরদার করা হয়েছে। কোয়ারেন্টাইনে যারা থাকবে, তারা যাতে বাইরে ঘোরাফেরা না করে সেজন্য সেখানে পুলিশি প্রহরা থাকবে। এ বিষয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে বলা হয়েছে। 

বিধিনিষেধ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, গণপরিবহনে আসন সংখ্যার অর্ধেক যাত্রী নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যানবাহনে মাস্ক ছাড়া চলাচল করা যাবে না। যারা চলাচল করবে, তাদের জরিমানার মধ্যে পড়তে হবে। রেস্টুরেন্ট-হোটেলে মাস্ক পরে যেতে হবে। মাস্ক ছাড়া গেলে দোকানদার ছাড়াও যিনি যাবেন তারও জরিমানা হবে। দোকানপাট খোলা রাখার সময়সীমা কমিয়ে রাত ১০টার পরিবর্তে রাত ৮টা পর্যন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য তাগাদা দেওয়া হয়েছে। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে ভ্যাকসিন কার্ড দেখাতে হবে।

টিআই/জেডএস