চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদী এলাকার ফাইল ছবি/ ঢাকা পোস্ট

পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে শতকরা ৬৬ ভাগ শিল্প-কারখানা নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন করে থাকে। ছাড়পত্র গ্রহণের ক্ষেত্রে শ্রেণিভেদে সর্বনিম্ন ৩৬ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৯ হাজার টাকা ঘুষ লেনদেন হয়ে থাকে।

বুধবার (৫ জানুয়ারি) পরিবেশ অধিদফতরে ‘সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মোহাম্মদ রফিকুল হাসান উপস্থিত ছিলেন। গবেষণা পরিচালনা এবং প্রতিবেদন তৈরি করেন রিসার্চ ফেলো মো. নেওয়াজুল মওলা ও শাহজাদা এম আকরাম।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগসাজশের মাধ্যমে নিয়ম-বহির্ভূত আর্থিক লেনদেন হয়। জরিপকৃত শিল্প-কারখানার শতকরা ৬৬ ভাগ পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে (যেমন অনাপত্তিপত্র পাওয়া, অবস্থানগত ছাড়পত্র পাওয়া) যোগসাজশের মাধ্যমে নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন করে থাকে। শিল্প-কারখানার পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণের ক্ষেত্রে শ্রেণিভেদে সার্বিকভাবে সর্বনিম্ন ৩৬ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৮ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত নিয়ম বহির্ভূত আর্থিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়। 

টিআইবি বলছে, জরিপকৃত শিল্প-কারখানার শতকরা ৫১ ভাগ মেয়াদোত্তীর্ণ ছাড়পত্র দিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যার শতকরা ৭০ ভাগ তথ্য সংগ্রহের সময় পর্যন্ত নবায়নের জন্য আবেদনই করেনি।

টিআইবির গবেষণায় পরিবেশ ছাড়পত্রগ্রহীতা শিল্প ইউনিট নির্বাচনে দুই পর্যায় বিশিষ্ট স্তরায়িত নমুনায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করে। প্রথম পর্যায়ে পরিবেশ ছাড়পত্র প্রদানের ৯টি বিভাগ থেকে দৈবচয়ন (লটারি) পদ্ধতিতে ২টি বিভাগ (ঢাকা মহানগর ও চট্টগ্রাম মহানগর) নির্বাচন করা হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিটি বিভাগের প্রতিটি শিল্প শ্রেণি হতে নিয়মতান্ত্রিক দৈবচয়ন পদ্ধতিতে পরিবেশ ছাড়পত্রগ্রহীতা শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হয়েছে। এভাবে মোট ৩৫৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে নির্দিষ্ট প্রশ্নমালার ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, পরিবেশ সংক্রান্ত আইনের দুর্বলতা রয়েছে এবং অন্যদিকে বিদ্যমান আইন, বিধিমালাসহ সম্পূরক আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে পরিবেশ অধিদফতর। কর্মীদের একাংশের অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বড় অংকের নিয়ম-বহির্ভূত আর্থিক লেনদেন এবং তা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ঘাটতির ফলে পরিবেশ অধিদফতরে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। অধিদফতরের কর্মীদের একাংশের সাথে পরিবেশ দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের একাংশের যোগসাজশ এবং তাদের প্রভাবের কাছে আত্মসমর্পণ করার কারণে অধিদফতরের কার্যকারিতা ব্যাহত হচ্ছে।

তিনি বলেন, একদিকে সামর্থ্যের ঘাটতি এবং অন্যদিকে সরকারের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়ে বস্তুনিষ্ঠ অবস্থান গ্রহণে ঘাটতির কারণে পরিবেশ রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে পরিবেশ অধিদফতর । 

অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে গবেষণা প্রতিবেদন বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদফতরের ‘নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ’ প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে অযৌক্তিকভাবে একই কর্মকর্তার ১০ বারসহ ১০ বছরে মোট ২৯৩ জন কর্মকর্তার বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে ভ্রমণ বাবদ অর্থ অপচয় করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের কর্মীদের একাংশের ক্ষমতা অপব্যবহার করে এবং অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জরিমানার অর্থ মওকুফ করে দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে ।পরিবেশ অধিদফতরের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনায় অন্যতম অন্তরায় হিসেবে প্রভাবশালীদের হুমকি, হস্তক্ষেপ এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মৌখিক নির্দেশনা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। 

গবেষণায় বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদফতরে জনবল সংকট রয়েছে। অধিদফতরে অনুমোদিত পদ সংখ্যা ১ হাজার ১৪১টি হলেও লোকবল আছে মাত্র ৪৬৫ জন। জনবলের ঘাটতির কারণে ছাড়পত্র প্রদানসহ অন্যান্য সেবা প্রদানে সমতা নিশ্চিত করা যায় না। যা অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে। একজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী একসাথে অনেকগুলো কাজের দায়িত্বে নিযুক্ত থাকায় কাজের মান হ্রাস পায়। 

টিআইবি তার পর্যবেক্ষণ বলেছে, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পরিবেশ অধিদফতরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হওয়া সত্ত্বেও এ খাতে তারা বরাদ্দের সম্পূর্ণ অংশ খরচ  করতে পারে না। গত পাঁচ অর্থবছরে গড় বরাদ্দ ছিল ৯৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা; পক্ষান্তরে গড় ব্যয় ছিল ৮৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দের তুলনায় ব্যয়ের হার প্রায় ৮৬ শতাংশ।  

আমলা-নির্ভরতা, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ঘাটতি, নিরীক্ষায় ঘাটতি, পেশাগত দক্ষতার ঘাটতি এবং অনেক ক্ষেত্রে সৎ সাহস ও দৃঢ়তার ঘাটতির কারণে পরিবেশ অধিদফতর একটি দুর্বল, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অনেকাংশে অক্ষম ও অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিণত হয়েছে বলেও টিআইবি মনে করে।

আরএম/এইচকে