‘মোগো নিজেগো মাথা গোঁজারইতো জায়গা নাই, থাহি আরেকজনের জমিতে। বড় পোলা হৃদয় ঘরামী মারা যাওয়ার পরে জমির অভাবে তারে এইখানে সমাধি দিতে পারি নাই। মোর বাপের বাড়িতে চিতা করতে হইছে। এহন মোগো কেবল একটা মাইয়া। মোরা মইরা গেলে মোগো লাশ কোম্মে রাখবে? অনেক কষ্ট কইর‌্যা এই জমি কিনছি। এহন হেই জমি এমপির কাছে বেচমু ক্যা? হের ধারে জমি বেচলে মোরা যামু কই?’

কান্নায় ভেঙে পরে কথাগুলো বলছিলেন বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলা উদয়কাঠি ইউনিয়নের তেতলা গ্রামের রতন ঘরামীর স্ত্রী মায়া ঘরামী। 

তিনি বলেন, ‘মোরা আগেও কইছি এহনো কই, জমি বেচুম না। হেরপরও এমপির লোকজন আইয়্যা কয় জমি লেইখ্যা দেতে। এমপিরে জমি লেইখ্যা না দেলে মোগো বস্তায় ভইরা নিয়া যাইবে। মোরা আতঙ্কে আছি। হেদিনের পর মোর স্বামী আর বাড়তে ফেরে নাই। কোম্মে আছে, কেমন আছে জানি না।’

বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) শাহে আলমের বিরুদ্ধে রতন ঘরামীর জমি জোর করে লিখে নেওয়ার চেষ্টার ঘটনা তদন্তে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি শনিবার (২৯ জানুয়ারি) তার বাড়িতে গেলে এসব বলেন রতন ঘরামীর স্ত্রী মায়া ঘরামী।

প্রতিবেশী মিতালী ঘরামী বলেন, সোমবার (২৪ জানুয়ারি) রাতে ইউপি সদস্য ইব্রাহিম বেপারীর নেতৃত্বে কয়েকশ লোক রতন ঘরামীর বাড়ি ঘেরাও করেন। তারা জমি লিখে দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। এমনকি রাতে যেন রতন ঘরামী কোথাও পালিয়ে যেতে না পারেন এজন্য তুহিন গাজী ও ইলিয়াস খানকে তার ঘরে রেখে যান। শেষে ৯৯৯ নম্বরে কল করলে পুলিশ এসে ওই পরিবারকে উদ্ধার করে। 

আরেক বাসিন্দা অনিল মন্ডল বলেন, রতন ঘরামীর জমি জোর করে লিখে নেওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এমপির লোকজন জানিয়েছে, এখানকার সব জমি তার লাগবে। তারা যে জমির কথা বলেন তাতে আমার বসতভিটাও আছে। এমপির যদি সব জমি লাগে তাহলে আমরা যাব কোথায়? আমরা জমি হারানোর ভয়ে আছি।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির তদন্ত টিম দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত তেতলা গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন, অভিযুক্ত ইউপি সদস্য ইব্রাহিম বেপারীসহ গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলেন। তদন্ত টিমে ছিলেন হিন্দু-বৈদ্য-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সুরঞ্জিত দত্ত লিটু, অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র দাস নিতাই, অ্যডভোকেট পঙ্কজ কুমার গুপ্ত, ছাত্র ঐক্য পরিষদ জেলা কমিটির সম্পাদক প্রিয়ংকর পাল, মহানগরের সম্পাদক আবির কুন্ডু।

সাংগঠনিক সম্পাদক সুরঞ্জিত দত্ত লিটু বলেন, এর আগে উপজেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতৃবৃন্দ পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা দুঃখজনক। আমাকে বরিশাল জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন, বানারীপাড়া উপজেলায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বৈধ কোনো কমিটি নেই। ওই রাতে (২৪ জানুয়ারি) রতন ঘরামীর জমি লিখে নেওয়ার জন্য জোর করা হয়েছে বলে সত্যতা পেয়েছি। 

অভিযুক্ত ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ইব্রাহিম বেপারী বলেন, ভয়ভীতি দেখাতে ওই রাতে রতন ঘরামীর বাসায় আমি যাইনি। এটা ৯৯৯ নম্বরে কল করার পরে যে পুলিশ সদস্যরা এসে এই পরিবারকে উদ্ধার করেছে সেই পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বললে জানতে পারবেন। জমি বিক্রির বিষয়ে রতন ঘরামী তার এক আত্মীয়ের মোবাইল নম্বর থেকে কল করে আমাকে ডেকেছিল। এজন্য গিয়েছিলাম। 

তিনি বলেন, রতন ঘরামী ৫০ শতাংশ জমি বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিউটেশন করতে গিয়ে ৩২ শতাংশ জমি পাওয়া যায়। তখন রতন ঘরামী দেখলেন তার টাকার পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এজন্য তিনি তালবাহানা শুরু করেন। 

এমপির বিরুদ্ধে অপপ্রচারের প্রতিবাদে মানববন্ধন

এদিকে বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য শাহে আলমের বিরুদ্ধে জমি দখলচেষ্টার ‘অপপ্রচার’ চালানোর প্রতিবাদে শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগ। পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র শীলের সভাপতিত্বে বিক্ষোভ পূর্ববর্তী সমাবেশে বক্তব্য দেন উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি সুব্রত লাল কুন্ডুসহ নেতৃবৃন্দ। 

বক্তারা বলেন, সংসদ সদস্য মো. শাহে আলমের অভূতপূর্ব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ঈর্ষান্বিত হয়ে দলের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা খন্দকার মোশতাকরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে প্ররোচনা দিয়ে সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে যে অপপ্রচার চালিয়েছে তা মিথ্যা ও বানোয়াট। বক্তারা আওয়ামী লীগের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেন।

প্রসঙ্গত, বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য শাহে আলমেখামার তৈরির জন্য তেতলা গ্রামে রতন ঘরামীর জমি জোর করে ক্রয়ের চেষ্টা চালান। তাতে রাজি না হলে সংসদ সদস্যের ম্যানেজার আল আমিন, ইউপি সদস্য ইব্রাহিম বেপারী, তুহিন গাজী, ইলিয়াস খানসহ বেশ কয়েকজনে সোমবার (২৪ জানুয়ারি) রাতে রতন ঘরামীর পরিবারকে জমি লিখে দেওয়ার জন্য জিম্মি করেন। ৯৯৯ নম্বরে কল করলে পুলিশ গিয়ে তাদের উদ্ধার করেন। এ অভিযোগে বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়ারি) বরিশালের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন রতন ঘরামী। মামলা তদন্তে পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর