আবির ফেরদৌস তন্ময়। বেড়ে উঠেছেন রাজধানীতে। শিক্ষাজীবন শেষ করে বেসরকারি একটি চাকরিতে প্রবেশ করেছেন কয়েক বছর হলো। বিয়েও করেছেন ঢাকাতে। দুই বছরের মাথায় ঘর আলো করে এসেছে ফুটফুটে সন্তান। সেই সন্তানও বেড়ে উঠছে এ শহরে।

সন্তান যেভাবে বেড়ে উঠছে, সেভাবেই মালিবাগ এলাকায় বেড়ে ওঠেন আবির ফেরদৌস। জন্মের আগে বাবা হামিদুর রহমান স্থায়ীভাবে ঢাকায় আসেন সাতক্ষীরা থেকে। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী, আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো ছিল। মালিবাগে নিজস্ব ফ্ল্যাটও রয়েছে। নিকট আত্মীয়দের প্রায় সবাই মালিবাগসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকাতে থাকেন।

আবির ফেরদৌসের বাবা হামিদুর রহমান বার্ধক্যজনিত কারণে কিছুদিন আগে মারা যান। তাকে ঢাকার কোনো কবরস্থানে সমাহিত করা হয়নি, নিয়ে যাওয়া হয় সাতক্ষীরায়। সেখানেই তাকে কবর দেওয়া হয়। যদিও সাতক্ষীরায় পৈত্রিক বাড়িতে আবিরের খুব বেশি যাওয়া হয় না, তবুও কেন বাবাকে সেখানে রেখে এলেন? কারণ, রাজধানীতে কবরের জায়গার সংকট। একজনের ওপর হচ্ছে আরেকজনের কবর। স্থায়ীভাবে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থাও নেই।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপে আবির ফেরদৌস তন্ময় বলেন, বাবার কবর রাজধানীতে দিতে চেয়েছিলাম, যেন প্রায়ই কবরের কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু পরে জানতে পারলাম রাজধানীতে কবরের জায়গার সংকট চলছে। প্রায় দুই বছর পরপর এক কবরেই নতুন করে আরেকজনকে কবর দেওয়া হয়।

একজনের কবরে আরেকজনের কবর দিলে তো শেষ স্মৃতিটুকুও থাকে না— উল্লেখ করে তিনি বলেন, কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে পাঁচ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত। তবে এ সুবিধা সাধারণরা পান না। লবিং করে পেলেও রয়েছে বড় অঙ্কের খরচ। সব দিক বিবেচনা করে নিজ বাড়ি সাতক্ষীরায় গিয়ে বাবাকে কবর দিয়েছি।

‘এখন খারাপ লাগে। কারণ, জীবন-জীবিকার ব্যস্ততায় সাতক্ষীরায় গিয়ে কবর জিয়ারত করা, কবরের সামনে কিছু সময় কাটানো হয়ে ওঠে না। যেহেতু রাজধানীতে কবরের জায়গার সংকট, তাই বাধ্য হয়েই সেখানে বাবার কবর দিতে হলো। তবুও এটা ভালো লাগার বিষয় যে, নিজেদের জায়গায় কবর দিয়েছি, অন্তত স্থায়ীভাবে কবরটা থাকবে। বাবার শেষ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকতে পারব, যতদিন বাঁচি’— বলেন আবির ফেরদৌস তন্ময়।

ঢাকায় প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস। বিশালসংখ্যক মানুষের এ ভূমির দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে কবরস্থানের নির্ধারিত জায়গা রয়েছে নয়টি। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় তিনটি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে ছয়টি। এসব কবরস্থানে নতুন করে আর জায়গা বাড়ানোর সুযোগ নেই।

পাশাপাশি স্থান স্বল্পতার কারণে কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থাও সীমিত। চাইলেই কবর সংরক্ষণের জন্য স্থায়ী জায়গা পাওয়া যায় না। নির্ধারিত সাধারণ জায়গায় স্বজনদের কবর দিতে হয়। নির্দিষ্ট চার্জ দিয়ে বিভিন্ন মেয়াদে কবর সংরক্ষণ করা যায়। তবে, জায়গা পর্যাপ্ত না হওয়ায় সবাই এ সুযোগ পান না। একটি সাধারণ কবর ১৮ থেকে ২০ মাস থাকে। এরপর সেখানে নতুন কারও কবর দেওয়া হয়।

টাকা খরচ করেও যে কেউ ইচ্ছা করলে কবর সংরক্ষণ করতে পারেন না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সর্বোচ্চ সুপারিশ থাকলে কেবল সংরক্ষণের সুযোগ থাকে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় থাকা কবরস্থানগুলোতে ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর মেয়াদে কবর সংরক্ষণের সীমিত সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে গুনতে হয় যথাক্রমে ৫, ১০, ১৫ ও ২০ লাখ থেকে ৪৫ লাখ টাকা পর্যন্ত

টাকা খরচ করেও যে কেউ ইচ্ছা করলে কবর সংরক্ষণ করতে পারেন না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সর্বোচ্চ সুপারিশ থাকলে কেবল সংরক্ষণের সুযোগ থাকে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় থাকা কবরস্থানগুলোতে ১০, ১৫, ২০ বা ২৫ বছর মেয়াদে কবর সংরক্ষণের সীমিত সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে গুনতে হয় যথাক্রমে ৫, ১০, ১৫ ও ২০ লাখ থেকে ৪৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।

দক্ষিণ সিটির কবরস্থানের বর্তমান অবস্থা

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন তিনটি কবরস্থান রয়েছে। সেগুলো হলো- আজিমপুর, জুরাইন (ধলপুর ও মুরাদপুর) ও  খিলগাঁও কবরস্থান। আজিমপুর কবরস্থান ৩৫ একর জায়গার ওপর। তবে, নতুন করে পাশে আড়াই একর জায়গা নিয়ে আয়তন বাড়ানো হয়েছে। এখানে কবরের ধারণক্ষমতা ২৫ হাজার। সংরক্ষিত কবর দুই হাজার ৬০০টি। নতুন অংশে সংরক্ষিত কবর দুই হাজার ৫০টি।

জুরাইন কবরস্থান (ধলপুর ও মুরাদপুর) ১৭ দশমিক ২৬ একর জায়গার ওপর। এখানে কবরের ধারণক্ষমতা ১২ হাজার। সংরক্ষিত কবর দুই হাজার ৭০০টি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনটি লাইনে প্রায় ২০০টি কবর সংরক্ষিত আছে। মুরাদপুর অংশে বর্তমানে ৪৮ শতাংশ জায়গা রয়েছে, কবর রয়েছে ৪০০টি। এখানে সংরক্ষিত কবরের জায়গা নেই। ধলপুর অংশে ৪৯ শতাংশ জায়গায় কবর রয়েছে ৫০০টি। এখানেও সংরক্ষিত কবরের কোনো জায়গা নেই।

অন্যদিকে, খিলগাঁও কবরস্থানটি পাঁচ একর জায়গার ওপর অবস্থিত। এখানে কবরের ধারণক্ষমতা প্রায় চার হাজার। এখানেও সংরক্ষিত কবরের স্থান নেই।

জানা গেছে, ঢাকার কবরস্থানগুলোতে প্রতিটি কবরের জন্য বাঁশ, চাটাই ও খননের ফি স্বজনদের বহন করতে হয়। এছাড়া প্রতি কবরের সাধারণ রেজিস্ট্রেশন ফি এক হাজার টাকা এবং সংরক্ষিত কবরে পুনঃকবর ফি ৫০ হাজার টাকা। ইজারাদারকে পরিশোধের জন্য ফি চার্ট করে দেওয়া থাকলেও নির্ধারিত খরচের বেশিসহ নতুন কবর দিতে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা খরচ করতে হয় মৃত ব্যক্তির স্বজনদের।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দায়িত্বে থাকা সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা সাইদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাধারণ কবরের জন্য আমাদের নির্ধারিত ফি এক হাজার টাকা। এর মাধ্যমে যে কেউ এসে নির্ধারিত সাধারণ জায়গায় তাদের স্বজনদের কবর দিতে পারেন। এছাড়া নির্দিষ্ট চার্জ দিয়ে বিভিন্ন বছর মেয়াদি কবর সংরক্ষণ করা যায়। তবে জায়গা পর্যাপ্ত না থাকায় সবাই এ সুযোগ নিতে পারেন না।

তিনি বলেন, একটি সাধারণ কবর ১৮ থেকে ২০ মাস থাকে। এরপর সেখানে পুনরায় কবর দেওয়া হয়। আসলে কবরের জায়গার সংকট থাকায় এমনটি করা হয়। অনেকে তাদের স্বজনদের কবর সংরক্ষণ করতে চান। যদিও আমরা এ বিষয়ে নিরুৎসাহিত করি। এ কারণেই মূলত সংরক্ষণের চার্জ দিনদিন বাড়ছে। কবরস্থানের জায়গা বাড়ানোর মতো কোনো পরিস্থিতি আসলে এ মুহূর্তে আমাদের নেই।

উত্তর সিটির কবরস্থানের সার্বিক চিত্র

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় ছয়টি কবরস্থান রয়েছে। সেগুলো হলো-  উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর কবরস্থান, উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টর কবরস্থান, বনানী কবরস্থান, খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থান, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান ও রায়ের বাজার বধ্যভূমির স্মৃতিসৌধসংলগ্ন কবরস্থান। প্রতিটিতে অগ্রিম কবর সংরক্ষণ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে। তবে, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ও স্থানপ্রাপ্যতা সাপেক্ষে এসব কবরস্থানে বিভিন্ন মেয়াদে কবর সংরক্ষণের সীমিত ব্যবস্থা রয়েছে। উত্তরের কবরস্থানগুলো সংরক্ষণের নির্ধারিত ফি পরিশোধপূর্বক ১৫ থেকে ২৫ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করা যায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত তালিকায় নামসহ যথাযথ মুক্তিযোদ্ধা সনদ দাখিল সাপেক্ষে কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে ১০ বছর ফ্রি কবর সংরক্ষণের সুবিধা দেওয়া হয়।

প্রতিটি কবরস্থানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মচারী নিযুক্ত রয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত কবরস্থানগুলো খোলা থাকে। কবরে সমাহিতকরণের জন্য বাঁশ ও চাটাই সরবরাহের লক্ষ্যে ইজারাদার নিয়োগ করা আছে। দাফনের ফি ৫০০ টাকা এবং প্রতিটি কবরস্থানে বাঁশ ও চাটাই সরবরাহের জন্য নির্ধারিত ফি দিতে হয়। যদিও নির্ধারিত ফি’র চেয়ে কয়েক গুণ বেশি অর্থাৎ ছয় থেকে সাত হাজার টাকা খরচ করতে হয় একটি মরদেহ দাফনের জন্য।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কবরস্থানগুলোতে চাইলেই কবর সংরক্ষণ করা যায় না। উচ্চ মহলের কেউ হলে বা সুপারিশের ভিত্তিতে কবর সংরক্ষণ করা যায়। তবে, সেক্ষেত্রে মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয়। উত্তরা ও বনানী কবরস্থানে ১৫ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে ২৪ লাখ টাকা এবং ২৫ বছরের জন্য সংরক্ষণ ফি লাগে ৪৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।

এছাড়া ডিএনসিসির আওতাধীন অন্যান্য কবরস্থানগুলোতে ১৫ ও ২৫ বছরের জন্য সংরক্ষণ করতে ছয় থেকে ১১ লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়। যদিও সিটি করপোরেশন জায়গার সংকটের কারণে কবর সংরক্ষণের জন্য নিরুৎসাহিত করে আসছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কবরস্থানের দায়িত্বে থাকা সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা মো. এনায়েত হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে কেউ সামান্য কিছু খরচের মাধ্যমে কবর দিতে পারেন। কবরস্থানে জায়গা কম থাকায় এখন কবর সংরক্ষণের বিষয়টি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। যাদের স্বজনদের কবর ইতোমধ্যে সংরক্ষণ করা আছে, তারা ইচ্ছা করলে সংরক্ষিত কবরের ওপর নিজ আত্মীয়দের কবর দিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আত্মীয়তার নির্দিষ্ট সম্পর্ক থাকতে হবে।

কবরস্থানের বিষয়ে কী ভাবছে ড্যাপ

ঢাকা মহানগর এলাকায় বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাপ) কবরের জায়গার বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না— জানতে চাইলে রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ড্যাপ পরিচালক আশরাফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকা শহরে জায়গার সংকটের কারণে স্বজনরা মরদেহ নিজ গ্রামে নিয়ে যান। আমরা বলেছি প্রতি ৫০ হাজার মানুষের জন্য কমপক্ষে একটি কবরস্থানের জায়গা নির্ধারণ করতে হবে। যারা আমাদের কাছে হাউজিং প্রকল্পগুলো অনুমোদন নিতে আসেন, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি আমরা নিশ্চিত করি।

তিনি বলেন, ড্যাপেও কবরস্থানের জন্য কিছু কিছু জায়গা আমরা চিহ্নিত করেছি। তবে চিহ্নিত করা জায়গা বেশির ভাগ ব্যক্তিমালিকানায়। ড্যাপের আওতায় থাকা চারটি সিটি করপোরেশন যদি সার্ভিসটি নিজেরা মেইনটেইন করে, তাহলে এ সমস্যার অনেকটা অবসান হবে। যদি তা না করা হয়, তবে অদূর ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও বড় সংকট তৈরি হবে।

কোভিড পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, যেভাবে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল, গ্রামেও মরদেহ নেওয়া যাচ্ছিল না, একে একে সিরিয়ালে রাখা হচ্ছিল; সে সময়ের কথা ভাবলেই আমরা বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারি। যদি আমরা একটি ভালো পরিকল্পনা নিতে পারি, তাহলে হয়তো কবরের জায়গার সংকট আর থাকবে না। আশেপাশে যেসব নিচু জায়গা আছে, সেগুলো অধিগ্রহণের মাধ্যমে কিছুটা ভরাট করে কবরস্থান করা যেতে পারে। কেননা সেখানে তো অবকাঠামোর বিষয়টি নেই।

নগর পরিকল্পনাবিদের ভাবনায় সমাধান যেখানে

কবরের জায়গার সংকট নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বজনদের কবরের সামনে গিয়ে মানুষ আত্মিক একটা শান্তি পায়। যখন কেউ তার স্বজনকে কবরে রেখে আসেন, তখন তাদের মূল চিন্তা থাকে কত দিন কবরটা রাখা যাবে। কিন্তু ঢাকায় জায়গার সংকটের কারণে এক কবরে দুই বছর পর নতুন কবর দেওয়া হয়। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আসলে এলাকাভিত্তিক কবরস্থান হওয়া উচিত। যেমন- প্রতিটি গ্রামে একটি করে কবরস্থান থাকে। স্বজনরা নামাজের পর, বিশেষ দিনে কবরস্থানে যান, দোয়া করেন। এভাবে তারা মানসিক শান্তি পান। তাই রাজধানীতেও এলাকাভিত্তিক কবরস্থান করা জরুরি।

‘বর্তমানে অপরিকল্পিত এ শহরের মধ্যে নতুন করে কবরস্থান তৈরি করা কঠিন। তবে সিটি করপোরেশনের যেসব নতুন ওয়ার্ড আছে, সেগুলোতে যদি বিষয়টি মানা হয় তাহলে অনেকাংশে এ সংকট দূর হবে। পাশাপাশি বেসরকারি আবাসন যারা করছেন, তাদেরও প্রকল্প এলাকায় অন্তত একটি করে কবরস্থান রাখা নিশ্চিত করতে হবে।’

কবর নিয়ে ব্যবসা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ

রাজধানীর কবরস্থানগুলো নিয়ে নানা অব্যবস্থাপনা এবং অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বনানী কবরস্থানে মায়ের কবর জিয়ারত করতে আসা লিয়াকত আলী নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী অভিযোগ করে বলেন, গত বছর আমার মাকে এখানে কবর দিই। জানি দুই বছরের মধ্যে আমার মায়ের কবরে নতুন কোনো কবর বসবে না। তারপরও ভরসা পাচ্ছি না। সামর্থ্য থাকলে কবরটা ১০ থেকে ১৫ বছরের জন্য সংরক্ষণ করতাম।

‘এখানকার লোকেরা কবর নিয়ে ব্যবসা করে। সিটি করপোরেশন থেকে এক থেকে দেড় হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু যারা লিজ নিয়েছেন, তারা আমাদের মতো লোকের কাছ থেকে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা আদায় করে নেন।’

লিয়াকত আলী বলেন, কবর দেওয়ার পর তারা দেখাশোনার কথা বলে মাসে হাজার টাকা দাবি করেন। বলেন, কবর পরিচ্ছন্ন রাখবেন। গাছ ও ঘাস লাগাবেন, পানি দেবেন। এসব কারণে প্রতি মাসে কল করে টাকা চান।

রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে বাবার কবর আছে মোরশেদ হোসেনের। তিনিও মাঝে মাঝে বাবার কবর জিয়ারত করতে আসেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কবর দিতে কমপক্ষে সাত-থেকে আট হাজার টাকা লাগে। ইজারাদাররা বাড়তি টাকাটা নেন। এছাড়া পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা ফোন দিয়ে প্রতি মাসে টাকা চান। তারা সিটি করপোরেশনের নিয়োগপ্রাপ্ত নন, ইজারাদারদের লোক। মাসে মাসে টাকা না দিলে দেখা যায় কবর অপরিষ্কার অবস্থায় আছে।

বনানী কবরস্থানে পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন আব্দুস সোবহান। জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে কেউ এখানে এসে কবর দিতে পারেন। কবরের রেট ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা নির্ধারণ করা আছে, এটা ঠিক। কিন্তু একটা কবর খুঁড়তে কয়েকজন লোক লাগে। এছাড়া চাটাইসহ নানা জিনিস লাগে। তাই একটি নতুন কবর দিতে আমরা ছয় থেকে সাত হাজার টাকা নিই।

‘আমরা এসব কবর দেখভাল করি, পরিষ্কার রাখি। ফুল গাছ লাগাই, পানি দিই, ঘাস ছাঁটি। যাদের কবর আছে তারা আমাদের খুশি হয়ে যা দেন তা-ই রাখি। যখন তারা আসেন তখন দেন, নয়তো আমরা কল করলে বিকাশে পাঠিয়ে দেন।’

এভাবে টাকা নেওয়া উচিত কি না— জানতে চাইলে আব্দুস সোবহান বলেন, এটাই আমাদের পেশা। আমরা সারাদিন এখানে থাকি, এসব কাজ করি। মানুষের কবর পরিচ্ছন্ন রাখতে আমাদেরও ভালো লাগে। তাই স্বজনরা কেউ খুশি হয়ে মাসে ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত দেন। কেউ কেউ বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দেন। আমরা তো জোর করি না। তারাই আমাদের ফোন দিতে বলেন।

‘যত দিন পর্যন্ত কবরের ওপর নতুন কবর না বসে তত দিন কবর পরিচর্যার জন্য আমরা টাকা নিই। নতুন কবর বসলে তাদের স্বজনদের কাছ থেকে টাকা নিই, পুরোনো কবরের স্বজনদের কাছে আর কোনো টাকা দাবি করি না।’

বনানী কবরস্থানে কবর খনন ও পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন খোরশেদ আলম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, কবর খোঁড়ার জন্য সিটি করপোরেশনের নিজস্ব লোক আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত নয়, দু-একজন। তাদের দিয়ে সবসময় কবর খোঁড়া সম্ভব হয় না। এ কারণে বাইরে থেকে লোক সংগ্রহ করতে হয়। তাদের আলাদাভাবে টাকা দিতে হয়।

‘আমরা তো নিজের পকেট থেকে তাদের টাকা দিতে পারি না। এ কারণে মৃতদের স্বজনদের কাছ থেকে কিছু টাকা নিই। এছাড়া সিটি করপোরেশন থেকে বাঁশ-চাটায়ের জন্য ইজারা মূল্য নির্ধারণ আছে ১৩০ টাকা। এভাবে সব খরচ মিলিয়ে আমরা একটা চার্জ নিই। বড় বিষয় হলো, মৃত ব্যক্তির স্বজনরাই টাকা দিয়ে যান, যেন খুশি হয়ে আমরা কবরের দেখভাল করি। অনেক সময় দেখা যায় গরিব কেউ আসেন। সেক্ষেত্রে আমরা মিনিমাম চার্জটা নিই।’

এছাড়া নিয়মিত কবর পরিচ্ছন্ন রাখা, গাছ লাগান, পানি দেওয়া— এসব কাজের জন্য মৃত ব্যক্তির স্বজনরাই মাসে মাসে কিছু বকশিশ দেন। আমাদের তো অন্য কোনো কাজ নেই। এটা করেই খেতে হয়। সারাদিন কবরস্থানেই সময় কাটে আমাদের— বলেন খোরশেদ আলম।

এএসএস/আরএইচ/এমএআর/