সম্প্রতি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে দুই প্রার্থীকে বিজয়ী করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। তারা ভাড়া করা অস্ত্রে ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা চালায়। ওই সহিংসতায় দুজন নিহত ও আহত হন অর্ধশতাধিক। পরবর্তীতে ভাড়া করা অস্ত্র লুকিয়ে আত্মগোপনে চলে যায় তারা।

চট্টগ্রাম সাতকানিয়ায় সহিংসতার ঘটনায় জড়িতরা কেউ ফুল বিক্রেতা, কেউ গাড়ি চালক, কেউ রাজমিস্ত্রি, আবার কেউ জমির দালাল। নিজেদের পেশার আড়ালে তারা একেকজন ভয়ংকর সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত বলে দাবি র‌্যাবের।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সাতকানিয়ায় সহিংসতার ঘটনায় জড়িত আটজনকে আগ্নেয়াস্ত্রসহ চট্টগ্রাম মহানগরী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, বান্দরবান সদর ও ঢাকা মহানগরীর তেজকুনিপাড়া থেকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব।

মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব সদর দফতরের লিগাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।

তিনি বলেন, গত ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার খাগরিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে  অস্ত্রধারী দুষ্কৃতিকারীরা ব্যাপক সহিংসতা ও নাশকতা চালায়। ওই সহিংসতার ঘটনায় সাতকানিয়া থানায় বেশ কয়েকটি মামলা রুজু হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ বিঘ্ন ঘটায় গণমাধ্যমে সহিংসতাকারীদের চিহ্নিত করে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব সহিংসতা ও নাশকতার সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়।

এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখার তত্ত্বাবধানে র‌্যাব-২, র‌্যাব-৭ ও র‌্যাব-১৫ অভিযান পরিচালনা করে। গত সোমবার(১৪ ফেব্রুয়ারি) রাতে র‌্যাব-১৫ এর অভিযানে বান্দরবান সদর থেকে সহিংসতায় অংশগ্রহণকারী নাসির উদ্দিনকে (৩১) গ্রেপ্তার করা হয়।

পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্য মতে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় অভিযান পরিচালনা করে মো. মোরশেদ (২৬), কোরবান আলী (৩৭), মো. ইসমাঈলকে (৫৫) গ্রেপ্তার করা হয়।

তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাতকানিয়ার খাগরিয়া থেকে সহিংসতায় ব্যবহৃত ৩টি একনলা বন্দুক, ১টি দোনলা বন্দুক, ১টি ওয়ান শুটারগান, অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র ও ৪২ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। একই রাতে র‌্যাব-৭ এর অপর একটি অভিযানে চট্টগ্রাম থেকে সহিংসতায় জড়িত মো. জসিমকে (২৪) গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রামের চান্দনাইশ থেকে মো. মিন্টুকে (২৬) গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারদের দেওয়ার তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখার তত্ত্বাবধানে মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) ভোরে র‌্যাব-২ এর অভিযানে রাজধানীর তেজকুনীপাড়া এলাকা থেকে সহিংসতার নেতৃত্ব প্রদানকারী মো.কায়েস (২২) ও তার সহযোগী নুরুল আবছারকে (৩৩) গ্রেপ্তার করা হয়।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা সহিংসতার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার খাগরিয়া ইউনিয়নে সহিংসতার ঘটনায় দুজন নিহত ও অন্তত অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সাতকানিয়ার খাগরিয়া ইউনিয়নের দুটি কেন্দ্রের নির্বাচন স্থগিত করা হয়।

তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও স্থানীয়দের তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় গ্রেপ্তার মো. কায়েস গত দুই বছর যাবত চট্টগ্রামে একটি কোম্পানিতে চাকরি করে আসছেন। পাশাপাশি সাতকানিয়া উপজেলায় বিভিন্ন সময় সংঘটিত সহিংসতা ও হামলার ঘটনায় নেতৃত্ব দেন। কায়েস এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য ৩০-৪০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল পরিচালনা করতেন। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্র সংগ্রহ করে তার দলের সদস্যদের সরবরাহ করতেন।

সাতকানিয়ায় সহিংসতার ঘটনায় তার নেতৃত্বে জসিম, মোর্শেদ, মিন্টু, আবছারসহ শতাধিক সশস্ত্র সন্ত্রাসী সাতকানিয়ার খাগরিয়া ইউনিয়নে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা চালায়। সহিংসতা পরবর্তীতে তিনি ঢাকায় আত্মগোপন করেন। সাতকানিয়া থানায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি কায়েস। এর আগেও তার বিরুদ্ধে সাতকানিয়া থানায় সহিংসতার মামলা রয়েছে।

গ্রেপ্তার নাসির একটি কোম্পানির চট্টগ্রাম বন্দর শাখার কর্মচারী। তিনি ২০১১-১৩ সাল পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। পরবর্তীতে দেশে এসে ঢাকার শাহবাগে ফুল বিক্রি করতেন। তিনি সহিংসতায় সশস্ত্র দলের নেতৃত্ব দেন। সহিংসতাকালে নাসিরকে মেরুন রঙের মাফলার ও মুখে লাল-সবুজ রঙের মাস্ক পরিহিত অবস্থায় একটি একনলা বন্দুক হাতে দেখা যায়। পরবর্তীতে তিনি বান্দরবানের গহীন জঙ্গলে আত্মগোপন করেন।

গ্রেফতার আবছার ঢাকায় একটি কাভার্ড ভ্যান সমিতির ম্যানেজার। সাতকানিয়ায় কোনো সহিংসতার সম্ভাবনা দেখা দিলে তিনি এলাকায় চলে আসতেন। নির্বাচনের পূর্বে ঢাকা থেকে সাতকানিয়ায় যান এবং কায়েসের নির্দেশে সাতকানিয়ার খাগরিয়াতে সহিংসতাকালীন সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা ও নেতৃত্ব প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকায় আত্মগোপন করেন। তিনি কায়েসকেও আত্মগোপনে থাকতে সহায়তা করেন। আবছারকে ঢাকার তেজকুনীপাড়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সহিংসতার ঘটনাসহ তিনিও একাধিক মামলার আসামি।

গ্রেফতার মোরশেদ কায়েসের গ্রুপের সক্রিয় সদস্য। পেশায় সিএনজি অটোরিকশা চালক। তাকে ঘটনার দিন একটি একনলা বন্দুক হাতে সহিংসতা ও নাশকতা চালাতে দেখা যায়। সহিংসতার পর সাতকানিয়ায় আত্মগোপন করেন  তিনি।

গ্রেপ্তার জসিম খাগরিয়ার বাসিন্দা ও পেশায় রাজমিস্ত্রি হলেও চুরি, ছিনতাই এবং ডাকাতিসহ বিভিন্ন সহিংসতায় অংশ নেন। সহিংসতাকালীন একটি ছবিতে লাল জ্যাকেট পরিহিত অবস্থায় তাকে কার্তুজ/অ্যামোনিশনের একটি বস্তাসহ গ্রেপ্তার মোরশেদের পাশে দেখা যায়। সহিংসতার পর তিনি চট্টগ্রাম মহানগরীতে আত্মগোপন করেন। 

গ্রেপ্তার মিন্টু পেশায় গাড়ি চালক। তিনি গত ১৩-১৪ বছর ধরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালিয়ে আসছেন। কায়েসের নির্দেশে তিনি সহিংসতার উদ্দেশ্যে অস্ত্র পরিবহন করেন। এছাড়াও তার তত্ত্বাবধানে সহিংসতার উদ্দেশ্যে ৩০-৩৫ জন বহিরাগতকে বিভিন্ন পরিবহনের মাধ্যমে নিয়ে আসা হয়। সহিংসতাকালীন তাকে ১টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ হামলায় অংশ নিতে দেখা যায়।

গ্রেপ্তার কোরবান আলী পেশায় নিরাপত্তাকর্মী। তিনি সহিংসতাকারীদের লাঠিসোটা ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র সরবরাহ করার মাধ্যমে সহিংসতায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি সাতকানিয়ায় আত্মগোপন করেন। 

গ্রেপ্তার ইসমাঈল পেশায় জমির দালাল। আগে রংপুর থেকে তামাক সংগ্রহ করে সাতকানিয়ার বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করতেন। তিনি সাতকানিয়ার খাগরিয়া ইউনিয়নে সহিংসতায় লাঠিসোটা ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় ব্যবহৃত অস্ত্র কোথা থেকে কীভাবে আসছে জানতে চাইলে র‌্যাবের গণমাধ্যম পরিচালক বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার কায়েস বেশ কয়েকজন ব্যক্তির কাছ থেকে ভাড়ায় অস্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন বলে স্বীকার করেছেন। অস্ত্র সংগ্রহ করে কায়েস তার বিশ্বস্ত সদস্যদের সরবরাহের দায়িত্ব দেন। তারা গ্রুপের অন্য সদস্যদের বিভিন্ন সময় সহিংসতায় ব্যবহারের জন্য অস্ত্র সরবরাহ করত। কাজ শেষে তারা স্থানীয় কবরস্থান ও পুকুরপাড়সহ বিভিন্ন স্থানে সেসব অস্ত্র লুকিয়ে রাখত। তবে এবার নির্বাচনী সহিংসতার পরবর্তী পরিস্থিতির কারণে আত্মগোপন চলে যায় তারা। ভাড়া করা অস্ত্র আর ফেরত দিতে পারেননি। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

জেইউ/এসকেডি