বাঁয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ও ডানে দুদক সচিব

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ এবং প্রতিবাদে সহকর্মীদের মানববন্ধনের ঘটনায় জনমনে নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতির সুষ্ঠু সমাধান না হলে গভীর সংকট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

দুদক বলছে, কমিশনের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে এবং অব্যাহতভাবে দুদক আইন ও বিধি পরিপন্থি কাজ করার অপরাধে শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অপসারণের কোনো বিকল্প ছিল না। 

অন্যদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) মনে করছে, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মতো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন দক্ষ ও সাহসী কর্মকর্তার সুরক্ষা নিশ্চিতের পরিবর্তে কেন এভাবে অপসারণের পথ বেছে নিতে হলো, সেই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হলে দুদকের বিশ্বাসযোগ্যতা গভীর সংকটের মুখে পড়বে।

দুদক সচিবের বক্তব্য

মো. শরীফ উদ্দিনের অপসারণের বিষয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেছেন, দুর্নীতি দমন কমিশন ২০০৪ ও দুদক চাকরি বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী দুদকের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। অপসারণকৃত দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন চাকরি বিধিমালা না মেনে অব্যাহতভাবে বিধি পরিপন্থি কাজ করে যাচ্ছিলেন। 

দুদক মনে করেছে, কমিশনের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে এবং সব কর্মকর্তা যাতে সঠিকভাবে কাজ করেন, সেই বার্তা দিতে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে। এটি কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়, এটি প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি রক্ষার বিষয়। দুদক আইন ও চাকরি বিধিমালা যাতে সবাই মেনে চলে, সে লক্ষ্যেই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে সাত থেকে ১০টি অভিযোগ রয়েছে। তিনটি বিভাগীয় মামলা চলমান রয়েছে। বদলি করা হলেও তিনি কমিশনের আদেশ অমান্য করে নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেননি। এছাড়া তদন্তকালে টাকা উদ্ধার করে তা নিজ অফিসে রেখেছেন তিনি। যে বিষয়ে আদালত থেকেও অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এ কারণে কমিশন মনে করে শরীফ চাকরি বিধিমালা লঙ্ঘন করেছেন এবং অব্যাহতভাবে করছেন। সে কারণে অপসারণ ব্যতিরেকে বিকল্প উপায় ছিল না।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে দুদক সচিব বলেন, যারা মানবন্ধন করেছেন তারা আমাদের কাছে এসেছিলেন, আমরা তাদের বলেছি, আইন ও বিধি অনুযায়ী কাজ করলে ভয়ের কিছু নেই। আমি তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছি।    

টিআইবির বক্তব্য

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে এ বিষয়ে বলেন, শরীফ উদ্দিন চট্টগ্রামে কর্মরত অবস্থায় দক্ষতা ও সাহসের সঙ্গে কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণে বিশাল অঙ্কের দুর্নীতি, রোহিঙ্গা নাগরিকদের এনআইডি ও পাসপোর্ট জালিয়াতি, কর্ণফুলী গ্যাসে অনিয়মসহ বেশ কিছু আলোচিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযান ও মামলা পরিচালনায় মূল ভূমিকায় জড়িত ছিলেন। 

এসব অভিযান এবং মামলা সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের চাপের কারণেই শরীফ উদ্দিনকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা এবং সবশেষ চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্ন উঠেছে। 

একইসঙ্গে দুদকের চাকরিবিধি অনুযায়ী কোনো কর্মীকে অপসারণের এখতিয়ার দুদকের হাতে থাকতেই পারে, কিন্তু দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মতো জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন দক্ষ ও সাহসী কর্মকর্তার সুরক্ষা নিশ্চিতের পরিবর্তে কেন এভাবে অপসারণের পথ বেছে নিতে হলো, তা দুদকের নিকট থেকে জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। তাই জনমনে তৈরি হওয়া প্রশ্নের সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হলে দুর্নীতি দমনে কাজ করা সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতা গভীরতর সংকটের মুখে পড়বে।

দুদক কর্মকর্তা শরীফকে অপসারণের কারণ হিসেবে যা জানা গেল

দুদকের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে তিনটি বিভাগীয় মামলা চলমান রয়েছে, যেগুলোর কার্যক্রম শেষ হয়নি। এছাড়া সাত থেকে ১০টি অভিযোগের তদন্ত চলমান রয়েছে। মামলার তদন্তকালে উদ্ধারকৃত ৯৩ লাখ টাকা তার চট্টগ্রামের নিজ আলমারিতে পাওয়া যায়, এ নিয়ে হাইকোর্ট থেকে তিরস্কার করা হয়েছে।

অনুমতি ছাড়া অভিযান চালানো, তদন্তকালে অভিযুক্তদের ডেকে মারধর করা, অভিযোগের বিষয়ে কমিশনের শুনানিতে অবজ্ঞামূলকভাবে বক্তব্য দেওয়া এবং তাকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালী বদলি করার পরও সেখানে যোগ না দেওয়ার অভিযোগও আছে শরীফের বিরুদ্ধে। এছাড়া বদলির আদেশ স্থগিত করতে হাইকোর্টের মিথ্যা আদেশ তিনি গণমাধ্যমে সরবরাহ করেন এবং অনুসন্ধান ও তদন্তের ফাইল বুঝিয়ে দেননি।

সহকর্মীদের মানববন্ধন ও স্মারকলিপি পেশ 

এদিকে উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে অপসারণের প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার পর দুদকের সামনে মানববন্ধন করে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর আগে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বরাবর একটি স্মারকলিপি পেশ করেন তারা। যেখানে প্রায় ৩০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সই রয়েছে বলে জানা গেছে।

মানববন্ধনে উপস্থিত দুদকের উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, গতকাল আমাদের এক সহকর্মীকে ৫৪ (২) ধারায় বিধি অনুযায়ী একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা ইনভেস্টিগেশন-ইনকোয়ারি করতে গিয়ে বেশ কিছু সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। কাজ করতে গিয়ে আমাদের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। আশা করি, কমিশন যৌক্তিকতা সহকারে আমাদের সমস্যাগুলো দেখবে। আমরা যেসব সমস্যা ফেস করি, সেগুলো সচিবের কাছে জানিয়েছি। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, খুব দ্রুত আমাদের বিষয়গুলো সমাধান করবেন।

তিনি বলেন, একটি ক্রিমিনাল প্রসিডিউর বেইজড অন ইনভিজিলেশন অ্যান্ড ইনকোয়ারি চাইলেই তাড়াহুড়ো করে দেওয়া যাবে না। আমরা চাই এ  সমস্যাগুলোর সমাধান যেন তারা বুঝে শুনে দেন। আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধাসহ অন্যান্য বিষয় যেমন আমাদের নিরাপত্তা দিক।

সচিবের কাছে পেশ করা স্মারকলিপিতে প্রধান বিষয় ছিল- অসাংবিধানিকভাবে ও আদালতে বিবেচনাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী (চাকরি) বিধিমালা, ২০০৮ এর বিতর্কিত ৫৪ (২) ধারায় উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরিফ উদ্দীনকে চাকরি থেকে অপসারণের আদেশ বাতিল করা। 

স্মারকলিপিতে বলা হয়, আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মচারী হিসেবে দুর্নীতি দমন কমিশনের ভিশন-মিশন বাস্তবায়নের জন্য দুর্নীতিবাজ নির্বিশেষে আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করি। যার নজির রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন ও তার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার চলমান রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮ এর ৫৪(২) নং বিধিতে বলা হয়েছে- "এই বিধিমালায় ভিন্নরূপ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কোনো কারণ না দর্শাইয়া কোনো কর্মচারীকে নব্বই দিনের নোটিশ প্রদান করিয়া অথবা নব্বই দিনের বেতন পরিশোধ করিয়া তাহাকে চাকরি হইতে অপসারণ করিতে পারবে।" 

অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৫(২) নং অনুচ্ছেদে লেখা আছে "অনুরূপ পদে (প্রজাতন্ত্রের অসামরিক পদে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে তাহার সম্পর্কে প্রস্তাবিত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের বিরুদ্ধে কারণ দর্শাইবার যুক্তিসঙ্গত সুযোগ দান না করা পর্যন্ত তাহাকে বরখাস্ত, অপসারিত বা পদাবনমিত করা যাইবে না"।

স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী (চাকরি) বিধিমালা, ২০০৮ এর ৫৪ বিধিটি চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন নং ১৪২৪/২০১১ দায়ের করা হলে বিগত ১৭-১০-২০১১ তারিখ হাইকোর্ট বিভাগ দুদক চাকরি বিধিমালার ৫৪ বিধিকে অসাংবিধানিক হিসেবে ঘোষণা করেন। উক্ত রায়ের বিপক্ষে আপিল দায়ের করলে আপিল আদালত ১০-১১-২০১৬ তারিখে আপিল খারিজ করে হাইকোর্ট বিভাগের *৫৪ বিধি অসাংবিধানিক ঘোষণাটি বহাল রাখেন। 

অর্থাৎ, ৫৪ বিধি অনুযায়ী দুদকের কোনো কর্মচারীকে সংবিধানের ২৭/২৯/২১ ও ৪০ অনুচ্ছেদ বলে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ হিসেবে ব্যাখ্যা প্রদানের সুযোগ না দিয়ে কাউকে ৯০ দিনের বেতন দিয়ে স্থায়ী রাজস্ব খাতভুক্ত চাকরি থেকে অপসারণের অবকাশ ছিল না। কিন্তু কমিশন আপিল বিভাগের ওই সিদ্ধান্তের বিপরীতে ৩২/২০১৭ সিভিল রিভিশন দায়ের করলে একতরফা (রিটকারীর প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে) শুনানি করে গত ২৮-১১-২০২১ তারিখে হাইকোর্টের আদেশটি স্থগিত করেন এবং বিষয়টি উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। 

দুর্নীতি দমন কমিশন চাকরি বিধিমালা ২০০৮ এর ৫৪ বিধির কার্যকারিতার বিষয়টি উক্ত আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় দুদকে ২০১৪ সালে যোগদানকৃত একজন কর্মকর্তাকে কোনোরূপ আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে এবং সে কোনোরূপ অপরাধ করেছে কি না সে বিষয়টি তাকে অবহিত না করে ১৬-০২-২০২২ তারিখের স্মারক নং ৭৪৯০ মূলে ৫৪(২) বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরিফ উদ্দীনকে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়, যা অসাংবিধানিক, বে-আইনি ও সাধারণ আইনের আওতায় মানবাধিকার পরিপন্থী।

স্মারকলিপিতে বলা হয়, মো. শরিফ উদ্দীন চট্টগ্রামে দক্ষ ও পরিশ্রমী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। তিনি তার চট্টগ্রাম অফিসে কর্মরত থাকাকালীন ৫২টি মামলা দায়ের করেন। এছাড়া তিনি আদালতের বিচারার্থে ১৫টি চার্জশিট দাখিল করেন। তিনি কক্সবাজারে ভূমি অধিগ্রহণের কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা উদ্ঘাটনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। 

শরীফ উদ্দিনের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানের কারণে সংক্ষুব্ধ পক্ষগুলো বিভিন্ন সময়ে তাকে নানাভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে। ৫৪(২) বিধি প্রয়োগের মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে তাকে চাকরি থেকে অপসারণ প্রকারান্তরে দুর্নীতিবাজদের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করার সমার্থক।

এমতাবস্থায় মো. শরিফ উদ্দীন, উপসহকারী পরিচালক, দুর্নীতি দমন কমিশনের অসাংবিধানিক ও অমানবিক অপসারণ আদেশ প্রত্যাহার ও দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মচারী (চাকরি) বিধিমালা, ২০০৮ এর ৫৪(২) বিধি বাতিলপূর্বক কমিশনের কর্মকর্তাদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার অনুরোধ জানাচ্ছি।

এর আগে, বুধবার দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সই করা এক প্রজ্ঞাপনে মো. শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮-এর বিধি ৫৪ (২)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তাকে অপসারণ করার কথা বলা হয়।

চট্টগ্রাম কার্যালয়ে কর্মরত থাকাকালে বেশ কিছু বড় দুর্নীতি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মো. শরীফ উদ্দিন। এরপরই একাধিক মহলের রোষানলে পড়েন বলে অভিযোগ ওঠে। 

সর্বশেষ গত ৩০ জানুয়ারি পরিবারসহ হত্যার হুমকি পান শরীফ উদ্দিন। হুমকি পাওয়ার পর কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আইয়ুব খান চৌধুরী ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে সিসি টিভির ফুটেজসহ চট্টগ্রামের খুলশী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তিনি।

আরএম/আরএইচ