গ্রেপ্তার ফয়েজউল্লাহ, আফরিন আক্তার ও মোছা. তাসলিমা বেগম।

প্রতারণার মাধ্যমে ক্ষুদ্র আয়ের প্রায় ৩শ মানুষের অর্ধ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর শাহ আলী থেকে ‘শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতিকে তার দুই সহযোগীসহ গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।   

প্রতারণার কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক, সেলুনের কর্মচারী, মনোহারী ও ফুটপাতের দোকানদার, গৃহকর্মী ও নিম্নআয়ের মানুষদের টার্গেট করে। দৈনিক ২শ থেকে ৩শ টাকা জমা করলে ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট বা জমির স্বপ্নও দেখানো হয় তাদের।  

প্রতারণায় অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ফয়েজউল্লাহ। তার সঙ্গে আরও যে দু’জন গ্রেফতার হয়েছেন তারা হলেন- আফরিন আক্তার (২৪) ও মোছা. তাসলিমা বেগম (৩৩)। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকালের মধ্যে শাহ আলীর মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। 

গ্রেফতার তিনজন ছাড়া প্রতিষ্ঠানের আরও বেশ কয়েকজনকে আসামি করে শাহ আলী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।   

সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকালের মধ্যে শাহ আলীর মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

তাদের গ্রেপ্তারের পর আজ মঙ্গলবার এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানায় র‌্যাব। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, প্রতিষ্ঠানটি শিবপুর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি লিমিটেড হিসেবে রেজিস্টার্ড হলেও ‘শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামে প্রচার ও কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। সমিতিতে ২০ জন সদস্য অন্তর্ভুক্তির কথা উল্লেখ থাকলেও বর্তমানে ৩০০ জন সদস্য রয়েছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা যায়। প্রতিষ্ঠানের কোনো রক্ষিত জামানতও নেই।

কৌশলে সদস্য সংগ্রহ
রাজধানীর মিরপুরের বিভিন্ন বস্তি এলাকার প্রতিবন্ধী, ভিক্ষুক, সেলুনের কর্মচারী, মনোহারী ও ফুটপাতের দোকানদার, গৃহকর্মী ও নিম্ন আয়ের মানুষদের টার্গেট করে ঋণের লোভ দেখিয়ে সঞ্চয়ের নামে কোম্পানিতে বিনিয়োগ বা ডিপিএস করতে উদ্বুদ্ধ করতেন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। নানা কৌশলে প্রলুব্ধ করে এভাবে প্রতিদিন প্রায় ২৫০ গ্রাহকের কাছ থেকে সঞ্চয় সংগ্রহ করা হতো।

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক

মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকল্প প্রচার করা হতো। এসব প্রকল্পের মধ্যে ছিল- মুদারাবা ডিপোজিট স্কিম, মুদারাবা কোটিপতি বিশেষ সঞ্চয়, মুদারাবা লাখপতি ডিপোজিট স্কিম, মুদারাবা মিলিওনিয়ার ডিপোজিট স্কিম, মুদারাবা পেনশন ডিপোজিট।  

স্বল্প সময়ে ঋণের প্রলোভন 
ভুক্তভোগীদের বিভিন্নভাবে অল্প সময়ে ঋণ প্রদানের প্রলোভন দেখিয়ে শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে সঞ্চয়, বিনিয়োগ, ডিপিএস করতে প্রলুব্ধ করা হচ্ছিল। ভুক্তভোগীদের বলা হতো ১০-১৫ দিন ঠিক মতো নির্দিষ্ট হারে টাকা জমা করা হলে তারা ঋণ পাবেন। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও মাত্র দু’একজনকেই ঋণ দেওয়া হয়েছে, বাকিরা কেউ ঋণ পাননি বলে জানান মোজাম্মেল হক।    

মিরপুরের বিভিন্ন বস্তির মানুষদের টার্গেট করে ঋণের লোভ দেখিয়ে সঞ্চয়ের নামে কোম্পানিতে বিনিয়োগ বা ডিপিএস করতে উদ্বুদ্ধ করা হতো।

দৈনিক ভিত্তিতে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে সঞ্চয়, ডিপিএসের টাকা সংগ্রহ করা হতো। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হতো যদি সময় মতো সঞ্চয় বা ডিপিএসের টাকা না দেওয়া হয় তাহলে সঠিক সময়ে ঋণ পাওয়া যাবে না। এছাড়াও মেয়াদ শেষে মুনাফা কম পাওয়া যাবে ও জরিমানার ভয়-ভীতিও দেখানো হতো।    

ফ্ল্যাট-জমি দেওয়ার আশ্বাস 
মানুষকে প্রলুব্ধ করতে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যেসব কৌশল নেওয়া হয় তার একটি ছিল ফ্ল্যাট-জমি দেওয়ার আশ্বাস। বলা হতো দৈনিক মাত্র ২০০/৩০০ টাকা করে জমা করলে এক সময় ঢাকা শহরে তাদের একটি করে ফ্ল্যাট বা জমি দেওয়া হবে। 

অভিযানে ভর্তি ফরম, ঋণ গ্রহীতার ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বেশ কিছু কাগজপত্র জব্দ করা হয়। 

শুধু তাই নয়, কো-অপারেটিভ সোসাইটির পাশাপাশি ‘মাইসার ওয়েল ফেয়ার ফাউন্ডেশন’ নামে ভুয়া ও অনুমোদনবিহীন একটি প্রতিষ্ঠান খুলে প্রতারণার জাল বিস্তৃত করা হয়। 

অভিযুক্ত ফয়েজ উল্লাহর গ্রামের বাড়ি ভোলা। তিনি ভোলার স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছেন। ১৯৯২ সালে ঢাকায় এসে মিরপুরের ১৪ নম্বরে কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু করেন। ২০০৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কাফরুলের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ফিল্ড অফিসার পদে চাকরি করেন। ২০২১ সালে নিজে প্রতিষ্ঠা করেন ‘শিবপুর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতি লিমিটেড।’ পরে সমিতির নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘শিবপুর ক্ষুদ্র ঋণদান কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড।’ এ নামেই কারবার চালিয়ে আসছিলেন তিনি। 

র‌্যাব বলছে,  কোম্পানির মোট সদস্য সংখ্যা ২৫০-৩০০ জন। গত ৫ মাসে ৫০ লাখের বেশি টাকা আত্মসাৎ করেছে তারা।

মানুষকে প্রলুব্ধ করতে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যেসব কৌশল নেওয়া হয় তার একটি ছিল ফ্ল্যাট-জমি দেওয়ার আশ্বাস। 

সমিতির ব্যবস্থাপনায় সবাই পরিচিত-আত্মীয়
সমিতির সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ নিজে, সহ-সভাপতি তার বন্ধু পলাতক আসামি সিরাজুল ইসলাম, সম্পাদক তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম, যুগ্ম সম্পাদক শ্যালক আলাউদ্দিন, কোষাধ্যক্ষ ছেলে আরিফ হোসেন এবং সদস্য মো. জামিল হোসেন ওয়াদুদ তার বন্ধু। সমিতির কার্যকরি পদে সকল সদস্য তার স্ত্রী, সন্তান ও বন্ধুরা।  

জেইউ/এনএফ