ঢাকা শহরে গড়ে শব্দের মান ১০০ ডেসিবল, যা খুবই আতঙ্কের / ছবি- ঢাকা পোস্ট

শব্দ হচ্ছে শক্তিশালী একটি মাধ্যম যা আমরা একে-অপরের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যবহার করি। কোনো শব্দে মানুষের ঘুম ভাঙে, মন জুড়িয়ে যায়; আবার কোনো শব্দে দুঃখ-কষ্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই শব্দ কখনো কখনো খারাপ লাগার বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যখন তা দূষণে পরিণত হয়। যার বাস্তব উদাহরণ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। উচ্চমাত্রার দূষণের কারণে শব্দ এখানে নীরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে।

উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা আছে। সেখানে স্পষ্ট বলা আছে, কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়, কোন ধরনের শব্দ দূষণ আইনত দণ্ডনীয়। তবে এসব বিধি কেবল কাগজেই আছে। এগুলোর বাস্তবায়ন দেখা যায় না।

খোদ ঢাকা শহরে শব্দদূষণের অনেক উৎস রয়েছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি। গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, মাইকের ব্যবহার,  শিল্প ও কলকারখানার কারণে রাজধানীতে শব্দ এখন যন্ত্রণার, বেদনার, জীবনবিনাশীও!

উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিধিমালা। সেখানে স্পষ্ট বলা আছে, কোন এলাকায়, দিনের কোন সময়, কোন ধরনের শব্দ দূষণ আইনত দণ্ডনীয়। খোদ ঢাকা শহরেই শব্দদূষণের অনেক উৎস রয়েছে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি। গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, মাইকের ব্যবহার,  শিল্প ও কলকারখানার কারণে রাজধানীতে শব্দ এখন যন্ত্রণার, বেদনার, জীবনবিনাশীও
শব্দদূষণ থেকে বধিরতা ছাড়াও রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, হৃদস্পন্দনে পরিবর্তন, মানসিক রোগসহ বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা দেখা দিতে পারে / ছবি- সংগৃহীত

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শব্দদূষণ রোধে নীতিমালা বা আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলেও নীরব এ ঘাতক থেকে মুক্তির দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। নাগরিক সভ্যতার অভিশাপ হলেও এটি রোধে নেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ। উচ্চ, প্রকট বা বিকট শব্দ মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয়কে প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হৃদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, বিরক্তি প্রকাশ এবং শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বিঘ্নিত হতে পারে

শব্দ কখন ‘দূষণ’ হয়

কোনো বস্তু যদি প্রতি সেকেন্ডে ২০ বারের বেশি কিংবা ২০ হাজার বারের কম কম্পিত হয় তাহলে শব্দ সৃষ্টি হয়। বস্তুর কম্পনের ফলে পরিবৃত বাতাসের যে পর্যায়ক্রমিক ঘনীভবন (Compression) ও তনুভবন (Rarefaction) ঘটে, তা চতুর্দিকে বিস্তৃত হয়ে যে তরঙ্গ গতির সৃষ্টি হয়, তাকে শব্দ তরঙ্গ বলে। এ শব্দ তরঙ্গ কানের পর্দায় আঘাত করলে ‘শব্দ’ হিসেবে তা অনুভূত হয়।

মাত্রা অনুযায়ী শব্দ তিন ধরনের হয়ে থাকে। শব্দের তীব্রতা (কর্কশ বা কোমল), তীক্ষ্ণতা (উঁচু বা নিচু) এবং স্বর (শব্দের বিশিষ্টতা)। শব্দের তীব্রতা শব্দ তরঙ্গের দৈর্ঘ্য বা বিস্তারের ওপর নির্ভর করে। শব্দ তরঙ্গের বিস্তার সমান হলে সেই শব্দ শ্রুতিমধুর হয়। শব্দ তরঙ্গের বিস্তার ও শ্রুতির পার্থক্যে শব্দ কর্কশ হয়। কর্কশ শব্দের সঙ্গে আমাদের কান ‘অপরিচিত’ হলে শব্দ অসহ্য লাগে। শব্দের প্রভাবে জীবের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয় বলে একে ‘শব্দদূষণ' বলে।

শব্দদূষণ থেকে মুক্তি পেতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার। বনায়ন ও নীরব এলাকা বাড়ানো দরকার / ছবি- সংগৃহীত

তারতম্য ও ভিন্নতার কারণে শব্দ প্রধানত দুভাগে ভাগ করা হয়। সুরযুক্ত শব্দ (Musical Sound) ও সুরবর্জিত শব্দ (Noise)। সুরবর্জিত শব্দই দূষণের অন্যতম কারণ। যা আসলে মানুষের তৈরি একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য পরিবেশগত সমস্যা। যেমন- গাড়ির হর্ন, ইটভাঙার মেশিনের শব্দ, জেনারেটরের শব্দ, কলকারখানায় সৃষ্ট শব্দ, মিউজিকের শব্দ বা মাইকের শব্দ, ট্রেনের হুইসেলের শব্দ, বিমান ওড়ার শব্দ, পটকা ও আতশবাজির শব্দ।

শব্দের গ্রহণীয় মাত্রা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আমেরিকান স্পিচ অ্যান্ড হেয়ারিং অ্যাসোসিয়েশন (আশা) গ্রহণযোগ্য শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাদের মতে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনের বেলা ৫৫ ডেসিবল এবং রাতে ৪৫ ডেসিবল হওয়া উচিত। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডেসিবল, রাতে ৫৫ ডেসিবল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবল, রাতে ৬৫ ডেসিবলের মধ্যে শব্দমাত্রা থাকা উচিত। মেডিকেল কিংবা হাসপাতাল এলাকা হবে সাইলেন্স বা নীরব জোন। যেখানে দিনে ৫০, রাতে ৪০ ডেসিবল শব্দমাত্রা থাকা বাঞ্ছনীয়।

আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনের বেলা ৫৫ ডেসিবল এবং রাতে ৪৫ ডেসিবল হওয়া উচিত। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডেসিবল, রাতে ৫৫ ডেসিবল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবল, রাতে ৬৫ ডেসিবলের মধ্যে শব্দমাত্রা থাকা উচিত। মেডিকেল কিংবা হাসপাতাল এলাকা হবে সাইলেন্স বা নীরব জোন। যেখানে দিনে ৫০, রাতে ৪০ ডেসিবল শব্দমাত্রা থাকা বাঞ্ছনীয়

শব্দদূষণে বিরক্ত নগরবাসী

রাইড শেয়ার করেন বিল্লাল হোসেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাইড দিই। কিন্তু বিকেল হতে হতে হাঁপিয়ে উঠি। গাড়ি আর যান্ত্রিক শব্দ শুনতে শুনতে মাথা ধরে যায়। অনেক সময় মাথাব্যথা করে। তখন বিরক্ত হয়ে বাসায় ফিরি। ঢাকায় এত পরিমাণ গাড়ি আর যেভাবে হর্ন বাজে, কানভারি হয়ে ওঠা স্বাভাবিক। অসহ্য হলেও পেট তো চালাতে হবে!

শাহবাগ মোড়ের ভাসমান ব্যবসায়ী সোহাগ হোসেন বলেন, ২০ বছর ধরে এখানে ব্যবসা করি। উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে কানে সমস্যা হয়েছে। মাইগ্রেনের ব্যথা তো আছেই। এখন আস্তে বলা কোনো কথাই শুনি না। শব্দের কারণে মেজাজ খিটখিট থাকে। অনেক সময় সবকিছু অসহ্য মনে হয়। এখন মেট্রোরেলের কাজ চলছে। বায়ুদূষণের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে শব্দদূষণও।

পরিবেশ অধিদপ্তরের একার পক্ষে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি থেকে শুরু করে সবার আন্তরিক সহযোগিতা দরকার / প্রতীকী ছবি 

চাকরির কারণে প্রতিদিন মতিঝিলে যেতে হয় শাওন মিয়াকে। গাড়ির হর্নে ত্যক্ত-বিরক্ত এ চাকরিজীবীর দাবি, প্রতিদিন যে পরিমাণ গাড়ির হর্ন শুনি, এখন মাথাব্যথা ও কানের সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাসায় সন্তানদের সঙ্গেও জোরে কথা বলি। তারা ভয় পেয়ে যায়। এ সমস্যা শুধু আমার নয়, লাখো নগরবাসীর। কিন্তু এ থেকে নিস্তারের কোনো সুযোগ নাই।

রমনা ট্রাফিক জোনে দায়িত্বরত কনস্টেবল মোহাম্মদ লোকমান চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ৯/১০ ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে দায়িত্ব পালন করি। শব্দে শব্দে নিজেকে এখন যন্ত্র মনে হয়। বাসায় ফিরলেও এর প্রভাব থাকে। কানে শুধু শব্দ বাজে। মেজাজ ঠিক থাকে না। আস্তে কথা কানে যেন আসে না। যদিও এটাই নিয়তি। যেখানে যাই না কেন ডিউটি তো রাস্তাতেই। শব্দদূষণের মধ্যেই আমাদের বসবাস।

ঢাকার শব্দদূষণ এখন আতঙ্কের পর্যায়ে

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর শব্দদূষণের ওপর একটি জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। সেখানে দেখা যায়, রাজধানীর ১০টি স্থান অর্থাৎ আহসান মঞ্জিল, সংসদ ভবন এলাকা, ধানমন্ডি- ৩২, শাহবাগ, গুলশান- ২, আগারগাঁও, মিরপুর- ১০, আব্দুল্লাহপুর, মতিঝিল ও তেজগাঁও এলাকায় সপ্তাহের সাত দিনের কখনই শব্দের আদর্শমান অর্থাৎ ৫০ ডেসিবলের মধ্যে ছিল না। গড়ে ৯৯.৪ শতাংশ সময় এটি আদর্শমান অতিক্রম করেছে। আবাসিক এলাকায় ৯৩.২ শতাংশ সময় শব্দের আদর্শমান (৫৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে এবং মিশ্র এলাকার ৮৮ শতাংশ সময় আদর্শমান (৬০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে।

রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স হোক বা অন্য যেকোনো যানবাহন হোক, হর্ন নিষিদ্ধ হওয়া দরকার / ছবি- সংগৃহীত

বাণিজ্যিক এলাকায় ৬০.৪ শতাংশ সময় শব্দের আদর্শ মান (৭০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে এবং শিল্প এলাকায় শব্দের মান ১৬.৩ শতাংশ সময় আদর্শমান (৭৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে।

উত্তরার শাহজালাল অ্যাভিনিউতে শব্দমাত্রা সর্বোচ্চ ৯৩ দশমিক ৫ ডেসিবল, মিরপুর- ১ এ সর্বোচ্চ ৯৬, পল্লবীতে সর্বোচ্চ ৯১ দশমিক ৫, ধানমন্ডি বালক বিদ্যালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ১০৭ দশমিক ১, ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে সর্বোচ্চ ৯৫ দশমিক ৫, নিউ মার্কেটের সামনে ১০৫ দশমিক ১, শাহবাগে সর্বোচ্চ ৯৭ দশমিক ৩ এবং সচিবালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ৮৮ ডেসিবল পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, ঢাকা শহরে গড় শব্দের মান ১০০ ডেসিবল, যা খুবই আতঙ্কজনক

বেসরকারি সংস্থা ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ’ (ডব্লিউবিবি) ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দের মান পরিমাপ করে দেখেছে। তাদের জরিপে দেখা গেছে, উত্তরার শাহজালাল অ্যাভিনিউতে শব্দমাত্রা সর্বোচ্চ ৯৩ দশমিক ৫ ডেসিবল, মিরপুর- ১ এ সর্বোচ্চ ৯৬, পল্লবীতে সর্বোচ্চ ৯১ দশমিক ৫, ধানমন্ডি বালক বিদ্যালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ১০৭ দশমিক ১, ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে সর্বোচ্চ ৯৫ দশমিক ৫, নিউ মার্কেটের সামনে ১০৫ দশমিক ১, শাহবাগে সর্বোচ্চ ৯৭ দশমিক ৩ এবং সচিবালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ৮৮ ডেসিবল পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, ঢাকা শহরে গড় শব্দের মান ১০০ ডেসিবল, যা খুবই আতঙ্কজনক।

পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপ যা বলছে

২০১৭ সালে শব্দদূষণের ওপর জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। জরিপ কার্যক্রমের মাধ্যমে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ শহরে যথাক্রমে ৭০, ৪১, ২০, ২০, ১৫, ১৫, ১০ ও ১৫টি স্থানের শব্দের মান পরিমাপ করা হয়।

জরিপের ফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ শহরের নির্ধারিত স্থানসমূহে বিধিমালা নির্দেশিত শব্দের মান দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেশি।

বৈশ্বিক অবস্থানে তলানিতে বাংলাদেশ

যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) ২০১৯ সালে বসবাসের অযোগ্য শহরের একটি তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান নিচের দিক থেকে তিন নম্বরে। শহরগুলোর বাসযোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেসব বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে শব্দদূষণও ছিল।

শব্দদূষণের কারণ

ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ও পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপে শব্দদূষণের উৎস হিসেবে যানবাহনের হর্ন-কে প্রধানত দায়ী করা হয়েছে। এছাড়া নির্মাণকাজ, সামাজিক অনুষ্ঠান, মাইকিং, জেনারেটর ও কলকারখানা থেকে সৃষ্ট শব্দ উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

আইনে যা আছে

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন- ১৯৯৫ এর ক্ষমতাবলে ‘শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা- ২০০৬’ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড; পরবর্তীতে ফের শব্দ দূষণের অপরাধে শাস্তি ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু বাস্তবে এ আইনের তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না।

শব্দদূষণে স্বাস্থ্যঝুঁকি

শব্দদূষণ থেকে বধিরতা ছাড়াও নানা জটিল রোগ দেখা দিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, ৩০টি কঠিন রোগের কারণ ১২ রকমের পরিবেশদূষণ। যার মধ্যে শব্দদূষণ অন্যতম। শব্দদূষণের কারণে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, হৃদস্পন্দনে পরিবর্তন, হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কে অক্সিজেনের সঞ্চালন কমে যেতে পারে। ফলে শ্বাসকষ্ট, মাথাঘোরা, বমি বমিভাব বা বমি হওয়া, দিক ভুলে যাওয়া, দেহের নিয়ন্ত্রণ হারানো, মানসিক ক্ষতিসহ বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতা দেখা দিতে পারে।

হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধে চালকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন / প্রতীকী ছবি

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নাক-কান ও গলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. দেবেশ চন্দ্র তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এখানে কানের রোগী আগের তুলনায় বেড়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এ সমস্যা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

‘বাংলাদেশে উচ্চ শব্দ নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। যে কারণে বধিরতা বাড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে মানসিক সমস্যা, হার্ট অ্যাটাক ও কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের মতো সমস্যাও দেখা দিচ্ছে। কানের রোগী কমাতে উচ্চ শব্দ নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই’— বলেন এ চিকিৎসক।

কী করণীয়

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. খবির উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, শব্দের মাত্রা দিনের বেলা ৫৫ ডেসিবল, রাতে ৪৫ ডেসিবল হওয়া উচিত। বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ ডেসিবল এবং রাতে ৫৫ ডেসিবল থাকা ভালো। এর বেশি হলে তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

‘শব্দদূষণের ক্ষতিকর দিকটি আপনি তাৎক্ষণিকভাবে বুঝবেন না। এটি আস্তে আস্তে ক্ষতি করবে, আপনার শ্রবণশক্তি কমিয়ে দেবে। নিউরোলজিক্যাল ও রেসপিরেটরি সমস্যাও হবে। এজন্য এটি নিয়ন্ত্রণে আপনাকে আইন মানতে হবে। হর্ন বাজানো বন্ধ করতে হবে। চালকদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। হর্নের ব্যবহার এবং এর মাত্রা কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি ফুটপাতে যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে।’

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একাডেমিক অ্যাডভাইজার অধ্যাপক ড. গুলশান আরা লতিফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা আছে, দূষণও আছে। বরং আগের তুলনায় তা বেড়েছে। এ থেকে মানুষের হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট ও শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।

‘এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার। বনায়ন ও নীরব এলাকা বাড়ানো দরকার। রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্স হোক বা অন্য যেকোনো যানবাহন হোক, হর্নমুক্ত নগরায়ন দরকার। শব্দদূষণের মাত্রা নিয়মিত মনিটরিং করে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি।’

সব দায় পরিবেশ অধিদপ্তরের : বিআরটিএ

উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করে এমন যানবাহনের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে— জানতে চাইলে বিআরটিএ’র মুখপাত্র পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা দেখভালের মূল দায়িত্ব আসলে পরিবেশ অধিদপ্তরের। তাদের দায়িত্ব নিয়ে আমি কিছু বলতে পারি না। তবে আমরা দুটো কাজ করি। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করি। সেখানে উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করছে বা হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করা যানবাহনকে জরিমানা করি। দ্বিতীয় কাজ হলো, ফিটনেস নবায়নের সময় হাইড্রোলিক হর্ন খুলে ফেলা। তবে, এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়।

পুলিশের কাজ কী

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, শব্দদূষণের পুরো পার্ট দেখভালের দায় পরিবেশ অধিদপ্তরের। আমরা শুধু রাস্তায় চলাচলকারী যানবাহনের ফিটনেস সনদ দেখি। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার হলে বা বাজানো হলে মামলা দিই।

শব্দদূষণের হালনাগাদ তথ্যই নেই পরিবেশ অধিদপ্তরে

সর্বশেষ পাঁচ বছর আগে শব্দদূষণের ওপর জরিপ করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। এরপর আর কোনো জরিপ বা গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। তবে, নতুন করে আরেকটি জরিপের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান কর্মকর্তারা।

পরিবেশ অধিদপ্তর যা বলছে

শব্দদূষণ রোধে হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার নিষিদ্ধ এবং চালকদের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই— এমনটি মনে করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. হুমায়ুন কবীর। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আমরা নতুন করে শব্দদূষণের ওপর জরিপ চালাব। তবে, ২০১৭ সালের জরিপে যা উঠে এসেছে তা বেশ উদ্বেগজনক। এটি শুধু পরিবেশ অধিদপ্তরের একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি থেকে শুরু করে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের সবার আন্তরিক সহযোগিতা দরকার।

‘আমরা হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার বন্ধ এবং এর আমদানি নিষিদ্ধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। চালকরাই যেহেতু সড়কে উচ্চ যান্ত্রিক শব্দ সৃষ্টি করেন, সেজন্য সরকারি ও বেসরকারি চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। রাজধানীসহ সারাদেশে এ কার্যক্রম চলছে। এছাড়া, সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ ও প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে।’

‘দেশের ১০টি স্থানকে আমরা নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছি। স্থানীয় প্রশাসন এটি বাস্তবায়ন করবে। আস্তে আস্তে নীরব এলাকার পরিধি বাড়ানো হবে’— বলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক।

জেইউ/এমএআর