ছবি : সংগৃহীত

২১ তারিখ যখন ইউক্রেনের রুশপন্থী কিছুটা বিচ্ছিন্নতাবাদী দুটো এলাকা লুহানস্ক ও ডোনেৎস্ককে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন দুটো আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তখন ধরেই নেওয়া হয় যে রাশিয়া যেকোনো মুহূর্তে যুদ্ধে যাচ্ছে। ইউক্রেন সীমান্তে পুতিন অনেকদিন থেকেই সৈন্য সমাবেশ করেছেন। তাই এ ধরনের একটা আগ্রাসনবাদী যুদ্ধে পুতিন জড়িয়ে পড়তে পারেন- তা গোটা পৃথিবীই চিন্তা করছিল।

পুতিনের আপাত লক্ষ্য দেখে মনে হচ্ছে, তার আগ্রাসনের উদ্দেশ্য ডোনেৎস্ক’র ব্ল্যাক সী’র পোর্ট। দুই, তার মাথার ভেতর কাজ করছে হিটলারের একটা ধারণা। হিটলার যেমন ইউরোপ বা রাশিয়ার যে সকল এলাকায় জার্মান ভাষাভাষীরা আছে সে এলাকাগুলো জার্মানের ভেতর অন্তর্ভুক্ত করতেই আগ্রাসন চালিয়েছিলেন। তিনিও তেমনিভাবে এগিয়ে যাবেন। কিন্তু পুতিন আর যাই হোক হিটলার নন।

দুজনেই নির্বাচিত অটোক্রেট কিন্তু হিটলারের যে কারিশমা ছিল তা পুতিনের নেই। তাছাড়া হিটলারের ছিল তার নিজ দেশে জনপ্রিয়তা। বিপুল ভোটে তিনি নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন। পুতিন ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে বারবার ক্ষমতায় এসেছেন। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আর যে বিষয়টি তার আচরণের ভেতর দিয়ে বোঝা যাচ্ছে তা হলো, তিনি মনে করছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রুশ সমর্থক চেকরা যেমন সোভিয়েতের বা রুশের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল ইউক্রেনেও তেমনটি ঘটবে। 

পুতিন অবশ্য তার ভাষণে শুধু ইউক্রেনকে হুমকি দেননি, তিনি ইউক্রেনের সমর্থক সকল দেশকেই হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই যুদ্ধের ফল এমন হবে যা ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি।

এ আশাও তার খুব একটা কাজে আসবে না। কারণ, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের ভাষণ ও তার কনফিডেন্স প্রমাণ করেছে রুশ ভাষাভাষী নিয়ে তাদের কোনো সমস্যা নেই। তাছাড়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি তার নিজের ভাষার মতোই রুশ ভাষা বলতে পারেন। তাই ভাষা যে এ যুদ্ধে রুশদের কোনো বাড়তি সুবিধা দেবে না- আর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যে ভাষাকে কাজে লাগিয়ে খুব বেশি লাভ করতে পারবে- সেটা কেউ মনে করছে না। বরং রুশ আগ্রাসনের মুখে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট কিন্তু পুতিনকে বলেছেন, যুদ্ধে তারা ইউক্রেনবাসীর পিঠ দেখবে না, মুখই দেখতে পাবে। 

পুতিন অবশ্য তার ভাষণে শুধু ইউক্রেনকে হুমকি দেননি, তিনি ইউক্রেনের সমর্থক সকল দেশকেই হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই যুদ্ধের ফল এমন হবে যা ইতিহাসে আগে কখনো ঘটেনি।

পুতিন যে নিজেকে এত বড় ক্ষমতাশালী মনে করছেন এতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ, সব স্বৈরাচারই এমন মনে করে। পুতিনের ভাষার সঙ্গে পৃথিবীর তাবৎ স্বৈরাচারের ভাষা মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে কোনো পার্থক্য নেই। 

কিন্তু পুতিন যখন ইতিহাসে যে ঘটনা ঘটেনি এমন কিছু ঘটাতে চাচ্ছেন, সে সময়ে তিনি নিজ দেশের রাজনীতিতেও অনেকখানি সমস্যায় আছেন। হিটলারের সময় জার্মানে তার বিরোধী কমিউনিস্ট আর ইহুদিরা রাজনৈতিকভাবে খুব শক্তিশালী ছিল না। তাই হিটলারের ওই অর্থে কোনো বিরোধী দলকে নিজ দেশে মোকাবিলা করতে হয়নি। কিন্তু পুতিন যতই লাভালিনকে জেলে রাখুক তার সমর্থন যে দিন দিন বাড়ছে এ তো এক চরম সত্য বর্তমানের রুশ রাজনীতিতে। তাছাড়া পুতিন বৃদ্ধ সিংহ। আর তার বিরোধী যতই জেলে থাকুন তিনি তরুণ। 

অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ইউরোপে ইতালি ছাড়া আর কাউকে পাশে রাখতে পারেনি। তাছাড়া, হিটলারের সঙ্গে আপসের জন্যে চেম্বারলিন, এটলি সকলেই ব্যস্ত ছিলেন। চার্চিল আসার পরেই না আস্তে আস্তে ইউরোপে একটা ঐক্য হয়। তাও সে ঐক্য যখন হয় সে সময়ে ইউরোপ অনেকখানি ধ্বংস হয়ে গেছে।

অপরদিকে রুজভেল্টকে যুদ্ধে নামাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল চার্চিলকে। এবার দৃশ্যপট ভিন্ন। এবার ইউরোপ অনেক আগে থেকেই পুতিনের এই ইউক্রেন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ এবং তারা আগ্রাসন শুরুর আগেই যেমন গ্যাস পাইপ লাইন বন্ধ করেছে তেমনি ইংল্যান্ড অর্থনৈতিক অবরোধ দেওয়া শুরু করেছে। 

অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট যেখানে অনেক দেরিতে যুদ্ধ জোটে আসেন এবার বাইডেন বরং রুশ আগ্রাসনের গন্ধ পাওয়ার পর থেকেই ন্যাটো জোটকে সক্রিয় করার কাজে ব্যস্ত। তাই ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়ার জাপান সবাই এক সঙ্গে গিয়েই যাতে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ায় সে কাজটি অনেক আগেই শেষ করে রেখেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন। তাই রুশ আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে ন্যাটো বিমান যেমন প্রস্তুত তেমনি বাড়তি সাহায্য দিতে ইসরাইলি বিশেষ যুদ্ধ বিমান ইউক্রেনের প্রতিবেশী ইউরোপীয় রাষ্ট্রে প্রস্তুতি নিয়েই আছে। 

আর যুদ্ধের অর্থনৈতিক ধাক্কা তো আসবেই। প্রথম দিনেই সেটা এসেছে। প্রথম দিনেই তেলের ব্যারেল একশ ডলারে উঠে গেছে। আর রুশ গ্যাস লাইন বন্ধ হওয়াতে ইউরোপ গ্যাস ক্রাইসিসে পড়বে। এ সমস্যা সমাধানের জন্যে ইতিমধ্যে বাইডেন কুয়েত ও কাতারসহ কয়েকটি দেশকে রাজী করিয়েছেন তারা যেন আরও বেশি পরিমাণ তরল গ্যাস উৎপাদন করে ইউরোপে পাঠায়।

পুতিন যে নিজেকে এত বড় ক্ষমতাশালী মনে করছেন এতে অবশ্য আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ, সব স্বৈরাচারই এমন মনে করে। পুতিনের ভাষার সঙ্গে পৃথিবীর তাবৎ স্বৈরাচারের ভাষা মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে কোনো পার্থক্য নেই। 

এছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধে আক্রান্ত হলে গোটা পৃথিবী গমের ক্রাইসিসে পড়বে। কারণ, পৃথিবীর অন্যতম গম উৎপাদনকারী দেশ ইউক্রেন। এ ধাক্কা সামলানো বেশ কষ্টের। খাদ্যাভাব অন্যকিছু দিয়ে মেটানো যায় না। তবে রাশিয়ারও গমের বাজার পড়ে যাবে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ী অবরোধের পরে।

তাছাড়া ইতিমধ্যে রুবলের দাম নিচে নেমে গেছে। তাই যুদ্ধের ফল পুতিন যেমন পৃথিবীকে দেখাতে চাচ্ছেন তেমনি তার নিজেকেও দেখতে হবে। রুবলের দাম নামা, গমের বাজার হারানো সবকিছু মিলে তার নিজ দেশের অবস্থাও কিন্তু ভালো থাকবে না।
পৃথিবীর সব বড় যুদ্ধের ইতিহাস তাই বলে। তাছাড়া ২৪ ফেব্রুয়ারি যখন লেখা শেষ করছি সে সময়ে চাইনিজ নিউজ এজেন্সি ও এপির খবর অনুযায়ী ৫০ জন ইউক্রেনবাসী বাসী মারা গেছেন রুশ হামলায়। অন্যদিকে চায়নার প্রতিনিধি জাতিসংঘে এ যুদ্ধ বন্ধের পক্ষেই বলেছেন।

তাই পুতিন এ যুদ্ধে আর যাই হোক চায়নাকে পাশে পাবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, চায়নার ভবিষ্যৎ যে যুদ্ধের প্রস্তুতি তার মাঝপথে যদি সে এ যুদ্ধে নামে তাহলে তার ভবিষ্যৎই নষ্ট হবে। নিরঙ্কুশ হবে আমেরিকার জোট। এ কারণে চায়না তার ঠিক পথই বেছে নেবে। যুদ্ধ থেকে দূরে থাকবে। তারপরেও যুদ্ধ যতদিন চলবে ততদিনই যোদ্ধা, পুরুষসহ নারী ও শিশুও মারা যাবে এ যুদ্ধে- যদি যুদ্ধ চলতে থাকে সে সংখ্যা আরও বেশি হবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অনেক ঘটনা ঘটবে। সর্বোপরি রুশ কবির কথাতেই বলা যায়,

‘যে যেখানেই যুদ্ধ করুক না কেন
যার বিরুদ্ধেই ছুড়ুক গুলি
ঠিকই খালি হয় একটি মায়ের কোল।’

স্বদেশ রায় ।। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত মিডিয়া ব্যক্তিত্ব