স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাবের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছিলেন বরেণ্য চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। যে স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি আন্তরিকভাবে কাজ করেছিলেন, মুক্ত বাংলাদেশে ফিরে মনে গভীর আনন্দ নিয়ে সেই স্বাধীনতার রূপ তিনি দেখতে পারেননি। বাঙালিরা যেন তাদের বিজয় উপভোগ করতে না পারে এবং স্বাধীনতা পেলেও বাংলাদেশের নতুন সমাজে যেন জ্ঞান আর মুক্তচিন্তা ছড়িয়ে দেয়ার মতো আলোকিত মানুষ না থাকেন তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহচর উগ্রপন্থী এবং ধর্মান্ধ আল-বদর সদস্যরা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের কয়েক দিন আগে ঢাকা শহরে দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর সাথে সামনাসামনি লড়াইয়ে পরাজিত হয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। আর নিরস্ত্র বুদ্ধিজীবীদের কাপুরুষের মতো হত্যা করেছে পাকিস্তানিদের বাঙালি দালালরা। জহির রায়হানের বড় ভাই দেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সারকেও ধরে নিয়ে যায় আল-বদর সদস্যরা।

১৬ ডিসেম্বরের পর বুদ্ধিজীবীদের কারও কারও মৃতদেহ বিভিন্ন বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। কিন্তু শহীদুল্লাহ কায়সারের মৃতদেহ বধ্যভূমিতে ছিল না। এই প্রথিতযশা সাহিত্যিক বেঁচে আছেন না মারা গিয়েছেন তা নিয়ে তৈরি হয়েছিল অস্পষ্টতা। অস্থির আর উদ্বিগ্ন হয়ে বড় ভাইকে খুঁজছিলেন জহির রায়হান। এই বুদ্ধিজীবীদের কারা নিধন করলো তা অনুসন্ধানের জন্য তিনি সেই সময় ঢাকায় গঠন করেছিলেন একটি কমিটি। সংগ্রহ করছিলেন বিভিন্ন তথ্য। যে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে হত্যা করেছিল জহির রায়হান তাদের নির্মূল করতে চেয়েছিলেন। পশ্চিম বাংলার সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তখন ঢাকায় দেখা হয়েছিল জহির রায়হানের। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে’। তখন জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘আপনার সঙ্গে আমি একমত নই। যারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য দায়ী তারা সাময়িকভাবে গা ঢাকা দিয়েছে বটে, কিন্তু তারা বাইরে কোথাও যায়নি। এই দেশেই আছে। আবার তারা ঐক্যবদ্ধ হতে চেষ্টা করছে। আপনি ভাববেন না, সাম্প্রদায়িক শক্তি চিরদিনের মতো খতম হয়ে গিয়েছে।’

যারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য দায়ী তারা সাময়িকভাবে গা ঢাকা দিয়েছে বটে, কিন্তু তারা বাইরে কোথাও যায়নি। এই দেশেই আছে। আবার তারা ঐক্যবদ্ধ হতে চেষ্টা করছে। আপনি ভাববেন না, সাম্প্রদায়িক শক্তি চিরদিনের মতো খতম হয়ে গিয়েছে।

পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে এই কথা বলার পর জহির রায়হানও বেশিদিন বেঁচে থাকেননি। একদিন কেউ তাঁকে ফোন করে বলেছিল যে, মিরপুরে এক বাড়িতে শহীদুল্লাহ কায়সারকে আটকে রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের পক্ষে থাকা বিহারীরা বসবাস করতো মিরপুরে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের একদিন যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আর পুলিশ সদস্যরা বিহারী-অধ্যুষিত মিরপুরে গিয়েছিলেন, তখন নিখোঁজ বড় ভাইয়ের সন্ধানে জহির রায়হানও তাদের সাথে মিরপুরে গিয়েছিলেন। পুরো দলটিই সেদিন বিহারীদের অকস্মাৎ আক্রমণের শিকার হয়। প্রাণ হারান অনেক বাঙালি সেনা আর পুলিশ সদস্য। জহির রায়হানকে সেদিনের পর থেকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেমন কোনোদিন পাওয়া যায়নি শহীদুল্লাহ কায়সারকেও। কারা জহির রায়হানকে ফোন করে তাঁর ভাইয়ের মিরপুরে বন্দী থাকার কথা জানিয়েছিল, তা অজানাই থেকে গিয়েছে। ১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের অপহরণ করে হত্যা করার সাথে যুক্ত, পরবর্তীতে জহির রায়হান হত্যার সাথে জড়িত অনেকেই হয়তো শাস্তি এড়িয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িক শক্তি এই দেশেই আছে।’ বিচক্ষণ মানুষ হিসেবে তিনি পরিস্থিতির সঠিক পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী দশকগুলোতে আমরা দেখেছি সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মান্ধতার মতো অশুভ দিক বার বার পীড়িত করেছে আমাদের সমাজকে।

জরুরি একটি প্রশ্ন তাই তৈরি হয়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ আর মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় আমাদের সফলতা কি যথেষ্ট? মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হল অসাম্প্রদায়িক চেতনা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি যেমন বিদ্বেষ দেখিয়েছিল, সেই সাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি আমাদের মুক্তিযুদ্ধে আমরা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম সম্পূর্ণভাবে। সেই সাথে মুক্তিযুদ্ধ ছিল স্বৈরতান্ত্রিক সামরিক শাসন, রাজনৈতিক অন্যায়, আর অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে এক তীব্র প্রতিবাদ। কিন্তু গণযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া দেশে কয়েক বছরের মধ্যেই আবার ফিরে এসেছিল সামরিক শাসন। রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দশকে আবার প্রতিবাদী হয়েছিল ছাত্র-জনতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপূর্ণভাবে গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে যদি আমরা সফল হয়ে থাকি তাহলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী নানা দিক কেন এই সমাজে আমাদের দেখতে হয়েছে? কেন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা ব্যক্তিরাও বিভিন্ন সময় স্বাধীন বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদ পেয়েছে, এবং বহু মানুষ তা মেনেও নিয়েছে?

প্রতিক্রিয়াশীলতা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা প্রভৃতি দিক মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা দেখেছি ধর্মীয় জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান। ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান রেস্তোরায় যে তরুণরা জঙ্গি হামলা চালিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল দেশি-বিদেশি নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষদের, তারা তো তাদের মনে বহন করেছে আল-বদরদের মানসিকতা। সেই তরুণরা তো মাতৃভূমি স্বাধীন করার জন্য অসীম সাহস নিয়ে শক্তিশালী পাকিস্তানি বাহিনীর মুখোমুখি হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশে কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ টিকে থাকার কারণে কমবয়সীরা পরিণত হয়েছে ধর্মান্ধ জঙ্গিতে? স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমাদের দেখতে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে সেই দৃশ্য। একটি ধর্মান্ধ গোষ্ঠী দেশে ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করছে। মানুষ শৈল্পিক সুষমা বুঝবে না, তাদের থাকবে না ইতিহাস-জ্ঞান আর যুক্তিবোধ, এমন একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ তৈরির জন্য বহু মানুষের প্রাণের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীন করা হয়নি। এখন সমাজের দিকে তাকালে একদিকে চোখে পড়ে আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার, অন্যদিকে দেখা যায় বহু মানুষের মনে তৈরি হচ্ছে অন্ধচিন্তা আর ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা। কারণ, প্রযুক্তি সহজলভ্য হলেও তা মানুষকে চিন্তাশীল এবং ইতিহাস-সচেতন করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে কি?

হোলি আর্টিজান রেস্তোরায় যে তরুণরা জঙ্গি হামলা চালিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল দেশি-বিদেশি নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষদের, তারা তো তাদের মনে বহন করেছে আল-বদরদের মানসিকতা। ...সমাজের দিকে তাকালে একদিকে চোখে পড়ে আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার, অন্যদিকে দেখা যায় বহু মানুষের মনে তৈরি হচ্ছে অন্ধচিন্তা আর ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা।

বর্তমান সমাজে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা আর অন্ধত্ব যেমন আমরা দেখছি তেমনি বেড়েছে নারী ধর্ষণের ঘটনা, বেড়েছে কিশোর গ্যাং-এর সংখ্যা যার সদস্যরা কৈশোরেই যুক্ত হয়েছে ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে। এই কিশোররা ঠিকই ব্যবহার করছে স্মার্ট ফোন। ইউটিউব, ফেসবুক আর টেলিভিশন চ্যানেলে নানা চটকদার উপাদান তারা উপভোগ করছে। কিন্তু দেশের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের সচেতন করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ কি নেয়া হচ্ছে? কিভাবে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, কারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিল তা সম্পর্কে আদৌ কোনো ধারণা আছে এমন কমবয়সীদের? বর্তমান সময়ে খুব হতাশার সাথে লক্ষ্য করি মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক সম্পর্কে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের ধারণা অত্যন্ত কম। যদি দেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীরাই মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে খুব কম জানে, তাহলে নতুন প্রজন্মের আরও বহু কমবয়সী যারা ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করার সুযোগ পায়নি এবং যারা পড়ালেখাই করছে না মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের যথেষ্ট ধারণা আছে তা কি আশা করা যায়?

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কথা বলাই কেবল যথেষ্ট নয়। এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যেন দেশের মানুষ বিশেষ করে কমবয়সীরা যারা আগামী দিনে দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করবে তারা  মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কি তা অনুধাবন করতে পারে। ১৯৭১ সালে যে তরুণরা ঢাকা শহরে গেরিলা অপারেশন চালিয়েছিল তাদের সম্পর্কে যদি নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের জানানো হয়, যদি জানানো হয় মুক্তিসংগ্রামে দেশের অগণিত সাধারণ নারী-পুরুষের মূল্যবান অবদান সম্পর্কে তাহলে এই সময়ের কমবয়সীরা অবশ্যই মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়া মানুষদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা অনুভব করবে। বিনোদনমূলক উপাদানের অত্যধিক প্রাপ্তির কারণে আমাদের দেশে বই পড়ার অভ্যাস কমে গিয়েছে। বিভিন্ন চিন্তাশীল বই পড়ার জন্য কমবয়সীদের আগ্রহী করে তোলা অত্যন্ত জরুরি। পরিবার, স্কুল-কলেজ থেকে ছেলেমেয়েদের জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’-র মতো গুরুত্বপূর্ণ বই পড়ার জন্য উৎসাহী করতে হবে। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে কেবল মার্চ বা ডিসেম্বর মাসের কোনো বিশেষ দিনে নয়, প্রতি মাসে অন্তত একবার জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’, তারেক মাসুদ আর ক্যাথরিন মাসুদের ‘মুক্তির গান’, তানভীর মোকাম্মেলের ‘১৯৭১’ প্রভৃতি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সুনির্মিত তথ্যচিত্রগুলি দেখানো হলে গ্রামে, শহরে বহু মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ধারণা তৈরি হবে।

মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ আমাদের সমাজ আলোকিত করতে পারে। কারণ এই মূল্যবোধ, এই চেতনা রাজনৈতিক অন্যায় এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রত্যাখ্যান করে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন সমাজে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ শক্তিশালী করার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে প্রয়াসী হচ্ছি কিনা। বহু মানুষের প্রাণের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের দীপ্যমান মূল্যবোধ এই সমাজে মলিন হয়ে যাক তা কখনোই কাম্য নয়।

ড. নাদির জুনাইদ ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

naadir.junaid@gmail.com