জাতিসংঘের মানবাধিকার সংরক্ষণ কাউন্সিলের কাছে মিয়ানমার পার্লামেন্টের ৩০০ সদস্য চিঠি লিখেছেন সে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের আহ্বান জানিয়ে। সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে শরিক হয়ে সে দেশের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। একেই বোধকরি বলা হয় ‘নিয়তির পরিহাস’। প্রকৃতির বিচার থেকে রেহাই মেলে না কারোরই।

আমাদের নদীভাঙা এই দেশের কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি অবিস্মরণীয় সংগীতের কয়েকটি পঙ্ক্তি এমন:

‘নদীর একূল ভাঙে ওকূল গড়ে
এই তো নদীর খেলা,
সকাল বেলা আমির রে ভাই
ফকির সন্ধ্যা বেলা।’

এই সত্যি, এই বাস্তবতা আমরা কেউই স্মরণ রাখি না।

অং সান সু চি। মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা। গণতন্ত্রের সুদীর্ঘ সংগ্রামে অনেক উত্থান-পতন, জেল-জুলুম সয়ে যখন ক্ষমতায় আসীন হলেন, তখন তিনিও ক্ষমতার মোহে, ক্ষমতার ভঙ্গুর দম্ভে এ সত্য ভুলে যাবেন-আমরা সেটা আশা করিনি। শুধু আমরা নই, গোটা বিশ্বই সেটা ভাবতে পারেনি। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কোনো নেতাকর্মী একটি জাতিসত্তার নির্মূলে সমর্থন করবেন, তা ছিল অচিন্তনীয়। সু চি সেই অচিন্তনীয় ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। তিনি ক্ষমতাসীন হয়ে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত গণহত্যা, ধর্ষণ, অত্যাচার, নিপীড়নকে সমর্থন করেছিলেন। তিনি তার দেশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাস্তুচ্যুত করে সেনাবাহিনীর বর্বরতাকে শুধু সমর্থনই করেননি, উপরন্তু সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাইও গেয়েছেন। তার সেদিনের ভূমিকায় বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ হয়েছিল গোটা বিশ্ব। তাতেও তার চৈতন্যোদয় ঘটেনি। তিনি তার দেশের সেনাশাসকদের মুখপাত্র হয়েছেন-সর্বজনীন মানবাধিকার, সর্বজনীন গণতন্ত্রের চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে। তার সেই অবস্থান ছিল অকল্পনীয়। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন মানবতাবাদী সংগঠন তাকে যে খেতাব ও সম্মাননা দিয়েছিল তার সংগ্রামী জীবনের স্বীকৃতি ও গৌরবের স্মারকরূপে, তার অনেকই প্রত্যাহার করে নেন তারা। তাতেও অং সান সু চির কোনো বোধোদয় ঘটেনি। তিনি উত্তরোত্তর সেনাসম্পৃক্ত, ক্ষমতামোহী এক নেত্রীর ভূমিকায় নিজেকে সীমিত বা বন্দি করেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন।

কোথায় ছিলেন তখন এই মানবতার আবেদনকারী সংসদ সদস্যরা-যখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নারীদের উপর্যুপরি ধর্ষণ করে, শিশুদের আগুনে পুড়িয়ে দশ লাখ মানুষকে বাংলাদেশে নির্বাসিত জীবনযাপনে বাধ্য করেছিল সামরিক জান্তা। তখন তারা এর বিরোধিতা করেননি।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সর্বজনীন মানবাধিকারের আর্তনাদ তাকে এক তিলও বিচলিত করেনি। তিনি তার দেশের সামরিক জান্তার পদক্ষেপকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এমনকি এ বিষয়ে জাতিসংঘের আহ্বানকেও পায়ে ঠেলতে দ্বিধা করেননি। আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়েও অস্বীকার করার প্রয়াস পেয়েছেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধকে। নিয়তির নির্মম পরিহাস হচ্ছে, আজ তা দলের সংসদ সদস্যদের সেই জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের কাছেই মানবতার জন্য আবেদন জানাতে হচ্ছে। যখন কিনা সেই সংসদ সদস্যদের সামরিক জান্তা উন্মুক্ত কারাগারে আটকে রেখেছে।

কোথায় ছিলেন তখন এই মানবতার আবেদনকারী সংসদ সদস্যরা-যখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নারীদের উপর্যুপরি ধর্ষণ করে, শিশুদের আগুনে পুড়িয়ে দশ লাখ মানুষকে বাংলাদেশে নির্বাসিত জীবনযাপনে বাধ্য করেছিল সামরিক জান্তা। তখন তারা এর বিরোধিতা করেননি।

আজ বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিক্ষোভ করছেন সু চির মুক্তির দাবিতে অথচ এই বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার অস্বীকার করে সামরিক জান্তার সমর্থনে মিছিল করেছিলেন মিয়ানমারে মাত্র কিছুদিন আগে। মহামতি গৌতম বুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে, সর্বজনীন মানবাধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে যারা কিছুদিন আগেও কুণ্ঠিত হননি আজ তাদেরই মানবাধিকার, গণতন্ত্রের পক্ষ নিয়ে এই মিছিল কি নিতান্তই পরিহাস নয়?

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত বর্বর গণহত্যা, ধর্ষণ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের পক্ষে দাঁড়ানোর ঘটনায় গোটা পৃথিবীর কাছে সু চির আরেক পরিচয় দাঁড়ায় ‘শতাব্দীর সেরা মিথ্যাবাদী’ রূপে। রোহিঙ্গাদের সেদিন বাস্তুচ্যুত করে সু চি উপলব্ধি করেননি তিনি তার নিজের গোটা জীবনের অর্জনকে বাস্তুচ্যুত করছেন, সমাহিত করছেন।

মার্কিন ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের উপলব্ধি এই-‘পালিয়ে কেউ বাঁচে না, আত্মসমর্পণ করেও না। বাঁচতে হলে বিদ্রোহ করে বাঁচতে হয়।’ হেমিংওয়ের উপলব্ধির প্রথম দুটি ঘটনাই সু চি ঘটিয়েছেন-পালিয়েছেন, আত্মসমর্পণ করেছেন। আর এই দুই প্রক্রিয়ায়ই সু চি সর্বজনীন মানবাধিকারের আন্দোলন থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন, তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন; কিন্তু শেষপর্যন্ত ‘বাঁচতে’ পারেননি। প্রকৃত সত্য এটাই।

বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিক্ষোভ করছেন সু চির মুক্তির দাবিতে অথচ এই বৌদ্ধ ভিক্ষুরাই রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার অস্বীকার করে সামরিক জান্তার সমর্থনে মিছিল করেছিলেন মিয়ানমারে মাত্র কিছুদিন আগে। সর্বজনীন মানবাধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে যারা কিছুদিন আগেও কুণ্ঠিত হননি আজ তাদেরই মানবাধিকার, গণতন্ত্রের পক্ষ নিয়ে এই মিছিল কি নিতান্তই পরিহাস নয়?

 

রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের জন্য যেমন সেদিন জাতিসংঘ এবং বিশ্ব জনমতকে দাঁড়াতে হয়েছিল তেমনি আজ সু চির জন্যও কথা বলতে হচ্ছে সেই জাতিসংঘ এবং বিশ্ব জনমতকেই। আজ ‘অধঃপতিত’ সেই সু চির জন্য মিয়ানমারের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষকেও লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে, প্রতিবাদ জানাতে হচ্ছে-এক্ষেত্রে প্রাধান্য বা মুখ্য বিষয় হচ্ছে সর্বজনীন মানবাধিকার ও গণতন্ত্র, কোনোমতেই সু চি নন।

সর্বজনীন মানবাধিকার কিংবা গণতান্ত্রিক অধিকারের কোনো খর্বাকৃত রূপ নেই। সর্বজনীন মানবাধিকারের অবিচ্ছেদ্য দাবির ক্ষেত্রে মিয়ানমারের অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের কোনো তারতম্য নেই। সর্বজনীন মানবাধিকারকে ক্ষুদ্র্রত্বের কারণে, ধর্মীয় পরিচয়ে বা স্থানিক বিবেচনায় নস্যাৎ করার চেষ্টা যে শুভ নয়, সু চির পতন থেকে সে শিক্ষা স্পষ্ট প্রতিভাত।

সর্বজনীন এই সত্যের নিরিখে আমরা মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করি মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের কারণে। আমরা গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানাই এ কারণে যে, গণতান্ত্রিক অধিকার থাকলে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম থাকে। মানবাধিকারকে অস্বীকার করে যে গণতন্ত্র, সে গণতন্ত্র সু চির নিজের কবর নিজে খোঁড়ার প্রয়াস মাত্র।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সর্বজনীন মানবাধিকার এবং মিয়ানমারের গণতন্ত্রের লড়াই আজ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ-মিয়ানমারের ঘটনাক্রম আজ আমাদের কাছে সে সত্যই তুলে ধরছে।

সাইফুল আলম ।। সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর