ছবি : সংগৃহীত

না, তিনি পেশাদার সাংবাদিক ছিলেন না। কিন্তু অনেক পেশাদার কলামিস্টের চাইতেও জনপ্রিয় ছিলেন।

একটি বনেদি পত্রিকায় তিনি কলাম লিখতেন, কিন্তু সেই পত্রিকাটি নিয়মিত তাকে সম্মানী পরিশোধ করতে পারতো না, তাই তিনি সেখানে কলাম লেখা বন্ধ করে দেন। সেই পত্রিকার পাঠক আরেক বনেদি ব্যবসায়ী বললেন, তিনিই সন্মানীর টাকাটা দেবেন, কিন্তু মহিউদ্দিন আহমদ যাতে নিয়মিত কলামটি চালিয়ে যান। 

এমনই ছিল তার জনপ্রিয়তা। বলছিলাম সদ্য প্রয়াত কলামিস্ট, কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমদের কথা।

প্রায় পনের বছর আগে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে তার জীবন আশংকা দেখা দিয়েছিল। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করতে গিয়ে জানা গেল লিভার সিরোসিসের কথা। চিকিৎসা নিয়ে ফিরলেন বটে, সুস্থ হলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি বিদায় নিলেন।

উজ্জ্বল তার কূটনৈতিক জীবন। গল্প করতেন লাহোরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে তার শিক্ষা জীবনের কথা নিয়ে। পূর্ববঙ্গ যখন মুক্তির দাবিতে উত্তাল, সে সময়ে তিনি পড়তে গেছেন পাকিস্তানের পশ্চিম অংশে। একাডেমিতে তখন ছাত্রদের জন্য তিন বেলা রুটির ব্যবস্থা। ছাত্র মহিউদ্দিন গোঁ ধরলেন একবেলা ভাত দিতে হবে। কর্তৃপক্ষের ‘না’। 

তিনি ধরলেন ভিন্ন পথ। ক্যান্টিনের ম্যানেজার কর্তৃপক্ষকে জানালেন সমস্যার
কথা। এই ছেলেতো প্রতিবেলায় ১২ থেকে ১৪টি রুটি খায়, অথচ বরাদ্দ ২টি। শেষে হার মানল কতৃপক্ষ, ভাতের ব্যবস্থা হলো তার জন্য। ১২/১৪টি রুটির চাইতে একবেলা ভাত বরং ভালো।

পেশাদার কূটনীতিক হিসেবে লন্ডনে পোস্টিং উত্তাল ১৯৭১-এ । বয়সে তরুণ, মাথায় বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথম লগ্নেই ইউরোপের পাকিস্তান

দূতাবাসগুলোতে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকদের মধ্যে মহিউদ্দিন আহমেদই  প্রথম পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেন। 

লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিবের পদ ছেড়ে দিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সার্বক্ষণিক কাজ করেছেন। লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে এক সমাবেশে মহিউদ্দিন আহমেদ পাকিস্তানের পক্ষত্যাগের সাহসী ঘোষণা দেন।  

বৃটেনে প্রবাসীদের যে মুক্তিযুদ্ধ আন্দোলন তার সাথে যুক্ত হন ওতপ্রোতভাবে। পালন করেন নানা দায়িত্ব।

১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যেদিন পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফেরার পথে যাত্রাবিরতি করেন লন্ডনে, সেদিন এই তরুণ কূটনীতিক অত্যন্ত দৃশ্যমানভাবে দায়িত্বপালন করেন বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানানো ও সাংবাদিক সন্মেলনসহ নানা আয়োজনে।

বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানানোর উদ্যোগ নিলে এই বিদেশি বন্ধুদের বাছাই করার কমিটিতে কাজ করেছেন বিপুল উৎসাহ নিয়ে। সরকারের এই উদ্যোগ দেশকে বিদেশিদের কাছে কতটা উচ্চতায় নিয়ে গেছে সে কথা বলতেন নানাভাবে।

তিনি চাকরি হারান বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়। কারণ, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মিশনে বঙ্গবন্ধুর ছবি নামিয়ে ফেলার নির্দেশ মানেননি। 

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চাকরি ফিরে পান, পররাষ্ট্র সচিব হন, ফরেন সার্ভিস একাডেমির মহাপরিচালক হন। তরুণ কূটনীতিকরা যাতে বাংলাদেশ, বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে তাদের কাজে ধারণ করতে পারেন, সে জন্য দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের তিনি এই একাডেমির সাথে সম্পৃক্ত করেছিলেন।

দেশটি ঠিক মতো চলছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন করতেন, হতাশ হতেন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে চারপাশের অনেক লোকের অযোগ্যতা বা গাফিলতি দেখে। বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপসহীন এই কূটনীতিককে দেখেছি এক মার্কিন সাংবাদিকের মুখের ওপর সাহস নিয়ে কথা বলতে। সেই সাংবাদিকের ভুল তথ্য তাকে উত্তেজিত করেছিল।

চাকরিচ্যুত থাকা অবস্থায় তার নিত্যদিনের সারথী ছিলেন সংবাদ সম্পাদক বজলুর রহমান। বজলুর রহমানই তাকে উদ্বুদ্ধ করেন কূটনীতি আর রাজনীতির মিশেলে কলাম লেখার জন্য। মহিউদ্দিন আহমদ দ্রুততম সময়ে সফল ও জনপ্রিয় হন শুধু কলাম লিখে।

উদাহরণ ও রেফারেন্স দিতে তার ছিল অফুরন্ত ভাণ্ডার। আড্ডায় যেমন উচ্চকণ্ঠ ও উচ্চহাসির, লেখাতেও সে রকমই। দীর্ঘ কলাম লিখতেন নিজ হাতে। পরে দেশের প্রায় সব বড় কাগজেই লিখেছেন তিনি।

খেতে এবং খাওয়াতে দুটোতেই তৃপ্তি ছিল তার। নানা রকম মানুষের সাথে সখ্য ছিল। তাই বাসায় দাওয়াত দিলে কাকে কাকে দাওয়াত দিয়েছেন একটি তালিকা পাঠাতেন। এই বাহুল্য কাজটি কেন জানতে চাইলে মহিউদ্দিন ভাই বলতেন: এটি বাহুল্য নয় বরং সংগত, এক সঙ্গে খাওয়া মানে শুধু খাওয়া নয়, নির্মল আনন্দও। আপনি যদি আমন্ত্রিত কারও সাথে বসতে বা খেতে স্বচ্ছন্দবোধ না করেন সে জন্যই তালিকাটা জানানো। কাউকে নিয়ে আপনার আপত্তি জানলে হয় তাকে বা আপনাকে বাদ দিয়ে পরিবেশটা সহজ রাখা যায়।

এ রকম হাজারটা স্মৃতি তার সাথে। সংবাদ মাধ্যম নিয়ে আমার আগ্রহের কথা তিনি জানতেন। তিনিও দুনিয়ার এ সংক্রান্ত খবর রাখতেন। আমি রুয়ান্ডা যাবো শুনে বললেন: ওদের জেনোসাইড মেমোরিয়ালে গেলে দেখবেন কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমও গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত। দেখলাম তাই, বিশেষত: কয়েকটি রেডিও স্টেশন কিভাবে গণহত্যায় উসকানি দিয়েছে তার বিবরণ নিয়ে বইও প্রকাশিত হয়েছে। কিনলাম, দেশে ফিরে শেয়ার করলাম।

তিনি প্রথাগত সাংবাদিক ছিলেন না, তাই তার লেখা নিজের মতো। তবে অনেক কলাম লেখকের ‘আবর্জনা’র চাইতে অতি উত্তম।

ইনকিলাবের অপসাংবাদিকতা নিয়ে তার প্রকাশিত অনন্য গ্রন্থ। তিনি অভিযোগ করে বলতেন: এই অপসাংবাদিকতার সাথে জড়িতরা আবার ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র সাংবাদিক হয় কী করে? বলতেন: প্রতিদিন অনেকগুলো কাগজ পড়ি, এমনকি যে সব কাগজ ‘অখাদ্য’ ছাপায় সেগুলোও। তাতে ধারণা জন্মায় সাংবাদিকতা সম্পর্কে। 

নিজের লেখা লিখতেন অত্যন্ত পরিশ্রম করে। কোনো কোনো লেখায় ব্যক্তিগত আক্রমণ থাকতো নাম ধরে। তিনি মনে করতেন সেটাই ঠিক। কিন্তু সম্পাদককে তো ছাপতে হয় বহু চিন্তা করে। দেখা গেল সেই অংশটুকু ফেলে দিয়ে ছাপা হয়েছে। প্রচণ্ড রাগ করতেন। এই অভিমান নিয়ে বহু সংবাদপত্রে লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন।

ভালো কাজের সাথে জড়িত থাকায় উৎসাহ ছিল শেষ দিন পর্যন্ত। এক ব্যবসায়ী অসচ্ছল মেধাবীদের সাহায্য দেবেন। মহিউদ্দিন ভাইয়ের ভক্ত সেই ব্যবসায়ী তার এই কাজে জড়িত করলেন একটি টিমকে। মহিউদ্দিন ভাইয়ের নেতৃত্বে সেই টিমে যুক্ত হলাম বদিউর রহমান, সৈয়দ আবুল মকসুদ, আব্দুল কাইয়ুম আর আমি। মেধাবীরা উজ্জীবিত হতো এদের সাহচর্য্যে।

দেশে-বিদেশে কিছু ঘটলেই অবধারিত ছিল তার ফোন। তিনিও সকালে জাগতেন, জানতেন আমার সময়। ফোন করেই বলতেন: তিনটি বিষয়ে কথা বলব, আমি তিন মিনিট আপনি তিন মিনিট। হয়তো সময় ধরে রাখা যেত না অনেক সময়। কিন্তু তার সাথে কথা বলা সবসময় ছিল উপভোগ্য ও শিক্ষণীয়।

বড় বিপদ হলো আমার একটি বইয়ের ভূমিকা লেখা নিয়ে। আমার অনুরোধ সোৎসাহে রাখলেন। কিন্তু ভূমিকার নামে লিখলেন এক বিশাল প্রবন্ধ। এতে নানাজন সম্পর্কে স্পর্শকাতর মন্তব্য। মত তার, কিন্ত বইটি আমার। আমার প্রকাশকও বিব্রত। আমি বললাম : মহিউদ্দিন ভাই, লেখাটা ছোট করতে হবে। সটান জবাব: করেন, তবে এই বিষয়গুলো ফেলা যাবে না। মহাবিপদ। নিজ দায়িত্বে কিছুটা ভারসাম্য রেখে লেখাটা সম্পাদনা করলাম। তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি, তবে আমার অনুরোধে সব হজম করেছেন।

কাকরাইলে আমাদের পড়শি ছিলেন অনেক দিন, পরে উত্তরায় হলো তার নিজের বাড়ি ‘শিউলী তলা’। মাঝে মাঝে অতিভোরে চলে আসতেন রমনায় নির্মল আড্ডার আনন্দ নিতে।

আমার শিক্ষক বাবু নগেন্দ্র চন্দ্র পালের স্মরণসভায় তাকে নিয়ে যাই নালিতাবাড়ীতে। সেই খণ্ডস্মৃতি নিয়ে কথার খই ছড়াতেন তিনি।

মাথায় কিছু ঢুকলে তার শেষ না দেখা পর্যন্ত শান্ত হতেন না তিনি। আনিস স্যার মারা যাওয়ার পর অধ্যাপক যতীন সরকারকে বাংলা একাডেমির সভাপতি পদে আনা যায় কি না। কোমর বেঁধে নামলেন তিনি, সাথে উৎসাহভরে আমিও। নীতি নির্ধারক মহলে জানানো হলো কিন্তু শেষে যতীন স্যারই সরে দাঁড়ালেন, এই বয়সে এই দায়িত্ব তিনি নিতে চান না।

বঙ্গবন্ধু ও প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার প্রখর স্মৃতি থেকে সব সময়ই তিনি স্মরণ করতেন অনেক ঘটনা, অনেকজনের নাম। তার আলোচনায় আসতো জন্মস্থান ফেনীর কথা। জীবনের শেষ দিকে খুঁজে পেয়েছিলেন বন্ধু সাংবাদিক আমিনুল ইসলাম বেদুকে।

এইতো মাত্র ক’মাস আগে বাংলা একাডেমির বার্ষিক সভায় এসেছিলেন দুজনেই, অনুষ্ঠানে বেদু ভাই অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন মহিউদ্দিন ভাই। 

আমার পুত্র-কন্যাকে নিয়ে ভাবতেন। ওরা যখন ছোট বলতেন, চলো, টাকা কিভাবে ছাপে তোমাদের দেখাতে নিয়ে যাই। তার ভাই ছিলেন সে সময় টাকশালের বড়কর্তা।

মতিয়া আপার নির্বাচনী এলাকায় ঝটিকা সফরে যাই মহিউদ্দিন আহমদের উৎসাহেই। আমারও এলাকা সেটি। কিন্তু মহিউদ্দিন ভাইয়ের কৌশল, কাউকে জানানো যাবে না, আমরা বহিরাগত পর্যবেক্ষক, সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলব, বুঝতে চাইবো সাধারণ মানুষের মনোভাব। সারাদিন নকলায় ঘোরাফেরা শেষে রাতে ঢাকায় ফেরা। 

মহিউদ্দিন ভাই মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা লিখলেন সংবাদে। মতিয়া আপার এলাকা নিয়ে লিখলেন বটে কিন্তু বার্তা দিলেন আওয়ামী লীগের সব প্রার্থীদের। মহিউদ্দিন ভাইয়ের লেখার বিষয় নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। সব লেখা বাছাই করে একটি ভালো সংকলন করা যায় নিশ্চয়ই।

সোমবার খবর পেয়ে মহিউদ্দিন ভাইয়ের নম্বরেই ফোন করি, ভাবি ধরেন, কান্নাভেজা গলায় বলেন: নাই, চলে গেছে।

মহিউদ্দিন ভাইয়ের বাছাই লেখার একটা সংকলন তার চলে যাওয়াকে কিছুটা হলেও ভুলিয়ে দিতে পারে। এ রকম একটি সংকলন নিশ্চয়ই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে অনেক দিন।  

মনজুরুল আহসান বুলবুল ।। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)

এনএফ