ছবি : সংগৃহীত

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। আজ তার জন্মদিন। তার সম্বন্ধে নতুন প্রজন্ম খুব কমই জানে। এটা তাদের দোষ নয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি, শিক্ষাব্যবস্থা, গবেষণা, আলোচনা ও কর্মকাণ্ডে তাকে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়।

জাতীয় জাদুঘর-মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরগুলো থেকেও তার সম্বন্ধে খুব কম জানা যায়। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদকে গভীরভাবে না জানলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ও গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেও সঠিকভাবে জানা অসম্ভব।

১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই। শীতলক্ষ্যা নদী তীরবর্তী, লাল মাটির আলপনায় আঁকা, শাল-গজারি বনের বেষ্টনীতে ঘেরা শ্যামল সবুজ দরদরিয়া গ্রাম। সেই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তাজউদ্দীন আহমদ।

আরও পড়ুন : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড : বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান

ঢাকা থেকে ৮২ কিলোমিটার দূরবর্তী এই গ্রামে যে প্রতিভাবান শিশু সেদিন জন্মগ্রহণ করেছিল তার হাতেই যে একটি রাষ্ট্র ভূমিষ্ঠ হবে তা কে জানত? জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ছিলেন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার প্রেরণা। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তান কারাগারে বন্দি, তখন তার অবর্তমানে সর্বসম্মতভাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদের ওপর। 

স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে যে সরকারের নেতৃত্ব তিনি দিয়েছিলেন তার পটভূমি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পালিয়ে যাওয়ার পথে এই দেশের মানুষের স্বাধীনতা লাভের চেতনার যে উন্মেষ দেখে গিয়েছিলাম সেটাই আমাকে আমার ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে অনিবার্য সুযোগ দিয়েছিল। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা হলো, একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করা।’

যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর পদ তার জন্যে ছিল না কোনো ফুলশয্যা। তাকে প্রতিহত করতে হয়েছিল দলের ভেতরের খন্দকার মোশতাক ও শেখ ফজলুল হক মনি চক্রের স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ সরকার বিরোধী বিভিন্ন তৎপরতা ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড।

সেই সময় তাজউদ্দীনকে হত্যার প্রচেষ্টাও নেওয়া হয়েছিল। এই ষড়যন্ত্রগুলো প্রতিহত করে, এক কোটি শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভরণপোষণ, অস্ত্র-রসদের ব্যবস্থাসহ সেই যুদ্ধকালে অভূতপূর্ব জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। তার মোকাবিলা করে তিনি যেভাবে সংকট উত্তরণ করেছিলেন তা জানতে হবে নতুন প্রজন্মকে।  

তাজউদ্দীন আহমদকে গভীরভাবে না জানলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ও গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেও সঠিকভাবে জানা অসম্ভব।

পাক-মার্কিন ষড়যন্ত্র সবসময় ছিল সক্রিয়। তাজউদ্দীন দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার সাথে সমঝোতা ভিত্তিক পাকিস্তান কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত কনফেডারেশন গঠনের সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেন।

আরও পড়ুন : আওয়ামী লীগ : বহুত্ববাদ ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল

সিআই-এর নথিতে তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, তিনি হলেন বাংলাদেশের জন্য এবং পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে আপসহীন নেতা।

বাংলাদেশের গণহত্যা পরিকল্পনার দোসর জুলফিকার আলী ভুট্টো। ভুট্টো লক্ষ্য করেছিলেন তাজউদ্দীনের দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা। একাত্তরের মার্চ মাসে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা চলাকালীন সময়ে তিনি বলেছিলেন, একদিন তাজউদ্দীন হবে তাদের জন্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা।

তাজউদ্দীন আহমদ সত্যিই পাকিস্তান ও তার দোসরদের জন্য বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ান। তিনি তার বৈশ্বিক-কূটনৈতিক জ্ঞানের সম্ভারকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় যুক্ত করে পাকিস্তানকে ধরাশায়ী করেন।  

কূটনৈতিক ফ্রন্টে যুদ্ধের বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমাদের যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন যুদ্ধ করতে হয়েছিল তেমনি কূটনৈতিক ফ্রন্টেও যুদ্ধ করতে হয়েছিল আমাদের। প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শেষ করার লক্ষ্য ছিল নভেম্বর মাস। কেননা আমি জানতাম বাংলাদেশে বর্ষাকালে পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের পরাস্ত না করতে পারলে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ সফলকাম হবে না এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাও আসবে না। এছাড়া আরও বুঝেছিলাম যে ঐ সময়ের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে না যাওয়া হলে মার্কিনিরা তার সুযোগ নেবে এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধকে নিয়ে আসবে বাংলার মাটিতে। কেননা আমেরিকাকে ভিয়েতনাম থেকে সরাতেই হবে। আর এই সম্পর্কে আমরা খুবই হুঁশিয়ার ছিলাম।’

আরও পড়ুন : মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় আমাদের ভূমিকা

ভারতের স্বীকৃতি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘এমনকি যুদ্ধের দিনে সবচেয়ে বিপর্যয়ের সময়ে ভারতীয় বাহিনীকে বলেছি, শ্রীমতী গান্ধীকে বলেছি, বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে তুমি আমাদের দেশে যাবে। বন্ধু তখনই হবে যখন তুমি আমাদের স্বীকৃতি দেবে। তার আগে সার্বভৌমত্বর বন্ধুত্ব হয় না।’ 

ভুট্টো লক্ষ্য করেছিলেন তাজউদ্দীনের দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা। একাত্তরের মার্চ মাসে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা চলাকালীন সময়ে তিনি বলেছিলেন, একদিন তাজউদ্দীন হবে তাদের জন্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা।

৬ ডিসেম্বর ভারত যেদিন বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃতি দিল, দেশ বিদেশের সাংবাদিকেরা তার মনোভাব জানবার জন্যে তাকে যখন ঘিরে ধরেছে, তিনি অশ্রু সজল কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমার কাছে আপনারা এসেছেন আমার অনুভূতি জানার জন্য? যে শিশুর জন্মগ্রহণ হলো সেই শিশুর খবর আমি তার পিতার কাছে পৌঁছাতে পারিনি। আমি ধাত্রীর কাজ করেছি।’

রামের অবর্তমানে ভরত যেমন রামের পাদুকা সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্য শাসন করেছিলেন, তেমনি স্বাধীনতা যুদ্ধকে তিনি পরিচালিত করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নামেই।

বাংলাদেশের প্রথম রাজধানীর তিনি নামকরণ করেছিলেন, ‘মুজিবনগর।’ মুক্তিযুদ্ধকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্যে পাকিস্তানের হয়ে ষড়যন্ত্রকারীরা এই প্রচার চালিয়েছিল যে, ‘স্বাধীনতা চাও না মুজিবকে চাও। যদি স্বাধীনতা পেতে হয় তাহলে মুজিবকে পাবে না। আর মুজিবকে পেতে হলে স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিসর্জন দিতে হবে।’

আরও পড়ুন : রাজনৈতিক পাপের উৎস সন্ধানে

তাজউদ্দীন তার জবাবে বলেছিলেন, ‘আমরা স্বাধীনতা চাই এবং মুজিবকেও চাই। স্বাধীনতা এলেই আমরা মুজিবকে ফিরে পেতে পারি।’ হলো তাই। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন স্বাধীন দেশের মাটিতে। তারপর তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন।  

আত্মপ্রচার বিমুখ তাজউদ্দীন আহমদ তার অসাধারণ অবদানের জন্যে দাবি করেননি কোনো কৃতিত্ব। তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান ছিল বাংলাদেশের মঙ্গল ও অগ্রগতি। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকে গড়ার জন্যে তিনি অর্থনৈতিক-শিক্ষা-সমাজকল্যাণ-স্বাস্থ্য-পুনর্বাসন প্রভৃতি শাখা ও পরিকল্পনা সেল তৈরি করেছিলেন, যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থাতেই।

মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরে না পাঠিয়ে তাদের টগবগে উদ্দীপনা ও ত্যাগকে দেশ গড়ার কাজে লাগানোর জন্য পরিকল্পনা করেছিলেন জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের। দুর্ভাগ্য যে তার সব পরিকল্পনাগুলো বাতিল হয়ে যায়। অন্যান্যদের ক্ষুদ্র ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ প্রাধান্য পায়।

একটি স্বাধীন রাষ্ট্রর সৃষ্টি যেমন তার নেতৃত্বে মাত্র নয় মাসে সম্ভবপর হয়েছিল, তেমনি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকেও তিনি গড়তে পারতেন সারা বিশ্বের জন্যে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রূপে। কিন্তু সেই সময় আর সুযোগ তিনি পাননি।

আরও পড়ুন : সূর্যোদয়ের বঙ্গবন্ধু

বাংলাদেশ সরকার গঠনের দিন ১০ এপ্রিলের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতার জন্যে আমরা যে মূল্য দিয়েছি তা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের উপ-রাষ্ট্র হওয়ার জন্য নয়।’

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন একটি সবল ও স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য যাকে অন্য কোনো রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করবে না। তিনি গণমানুষের কল্যাণে যে তিনটি বাজেট নিজ হাতে প্রণয়ন করেছিলেন তা আজও বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বাজেট রূপে পরিগণিত।

তাজউদ্দীন আহমদ তার অর্ধ শতাব্দীর জীবনে যে অনন্য কীর্তির স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন তা বাংলাদেশের স্বার্থেই জানা জরুরি। তিনি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টিতে যে অসাধারণ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই ইতিহাস আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাবে স্বাধীনতার অঙ্গীকার সাম্য, সুবিচার ও মানবিক মর্যাদার আলোকিত পথে। তার জন্মদিনে এই প্রার্থনা রইল।

শারমিন আহমদ ।। তাজউদ্দীন আহমদের জ্যেষ্ঠ কন্যা