স্মৃতির সড়কে ঘুরে আসতে ভালো লাগে। বর্তমান একঘেঁয়ে হয়ে উঠলে, হেঁটে হেঁটে ঘুরে আসি পুরাতনে। কেমন এক যাদু বাস্তবতায় ঢুকে পড়ি। বর্তমানকে ঢেকে দেয় গতকাল। চারপাশের মানুষ, সড়ক, দেয়াল কিছুই আর এখন’এ থাকে না, ফিরে আসে তখন। যেমন এখন ২০২১ এ মনে পড়ছে ২০০৬ সালের কথা।

ক্ষমতায় চারদলীয় জোট সরকার। ক্ষমতা উপভোগের তুঙ্গে তারা। দশদিকে তাদের সাফল্যের তোপধ্বনি। ক্ষমতা ভোগের তৃপ্তির ঢেঁকুর। কিন্তু এই ঢেকুঁরের পাশে দীর্ঘশ্বাসও ভারী হয়ে উঠছিল চারপাশে। কারণ ক্ষমতা চারদলীয় জোটের মূল দলের বাইরে চলে গিয়েছিল অনেকটা। জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোটসহ অন্যান্যরা আর্থিক বা বৈষয়িক লাভের পাশাপাশি গুছিয়ে নিচ্ছিল নিজের দলকে। তৃণমূলে দলের ভিত মজবুতের জন্য যা যা করা দরকার সবই তারা করে নিচ্ছিল। উপর থেকে বিএনপির কতিপয় নেতা কর্মীর ক্ষমতা ভোগের উল্লাসটিই চোখে পড়তো। এই উল্লাসের সঙ্গে বিএনপি যাদের হাতে গড়া, কিংবা বিএনপির ব্র্যান্ড বলে পরিচিত নেতাদের অনেকেই যোগ দিতে পারেননি বা দেননি। কেউ কেউ পদের বাইরে ছিলেন। কয়েকজন পদে থেকেও অস্বস্তিতে ছিলেন। তারা অতি আস্ফালন মেনে নিতে পারছিলেন না। বিশেষ করে বহিরাগত ও সুবিধাবাদী শ্রেণি ঢুকে পড়া এবং জামায়াতের প্রভাব তারা মেনে নিতে পারেননি। সেই সঙ্গে তখন বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের উঠোনের ভাঙা কুলোয় রূপ দেয়াটাও, দলের ভেতর ক্ষোভের বাষ্প তৈরি করেছিল। আমরা সেই সময়ে দেখতে পাই বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা দলের নেতৃত্ব ও দল পরিচালনা নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করছেন, ক্ষোভ প্রকাশ করছেন খোলামেলা ভাবে।

আমি নিজেই একাধিক নেতার এমন বক্তব্য নিয়েছি। এদের মধ্যে ছিলেন সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী, কর্নেল অলি আহমেদ, অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান। তারা আওয়ামী লীগের সময়ে দল যেমন সাংগঠনিক ভাবে পরিচালিত হচ্ছিল, তা মেনে নিতে পারছিলেন না। তাদের মতে, এতে দলের সাংগঠনিক ভিত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নবীন প্রবীণে মিলে দল পরিচালনা করতে হবে। তাদের অভিযোগ ছিল- বিএনপির মূল শক্তি ছাত্রদলকে লোভী করে তোলা হচ্ছে। তারা সংগঠনের চেয়ে ক্ষমতা, ভোগ দখলে বেশি মনোযোগী।

কাদের মির্জা সমাবেশ করতে না পেরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আশ্রয় নেন। এতে তার বক্তব্য আরো বিস্তার লাভ করে। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বরাবর বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করে দেখতে।

বিক্ষুব্ধ বিএনপি নেতারা ক্ষমতা বলয়ের পাশে জড়ো হওয়া আমলা ও ব্যবসায়ীদের নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাদের সেই ক্ষোভ ও দীর্ঘশ্বাস কতোটা সত্য ছিল এর পরিণতি কি হয়েছিল, তা দৃশ্যমান। অহেতুক এখানে শব্দ অপচয়ের প্রয়োজন নেই। তবে আওয়ামী লীগের সময়েও বিএনপির পক্ষ থেকে এক ধরনের প্রোপাগান্ডা ছিল, এরা অযোগ্য বলেই এদের দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তাই চিৎকার করছে তারা। কখনও বলা হয়েছে এটা বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। আবার একথাও বলা হয়েছে, এদের ব্যবহার করছে একটি গোষ্ঠী।

স্মৃতির সড়ক থেকে বর্তমানে এসে দেখি সেই পুরাতন গান গাইছে রাজনীতি। এখনও ক্ষমতার চাক ঘিরে আছে লোভী সুবিধাবাদী, অনুপ্রবেশকারীর দল। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার শুধু পদ, পদক আর অর্থ যোগের লোভে। তারাই তোপধ্বনি তুলছে শাবাশ শাবাশ। কিন্তু আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা, আদর্শের ধারক কর্মী, সমর্থকরা দেখছেন, কেমন করে বহিরাগতরা তাদের দলটিকে ত্রিপলে ঢেকে দিচ্ছে।

জন মানুষের দাবী, স্বপ্ন সেই আচ্ছাদন ভেদ করে আসতে পারছে না। কথা হচ্ছে। দলের নানা অবস্থান থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে কারা দলের ক্ষতি করছে। কিন্তু নতুনদের নতুন কণ্ঠ ডিজে পার্টির মতো এতো প্রকাণ্ড ও বীভৎস যে, আওয়ামী লীগের প্রকৃত নেতা কর্মীদের আদর্শিক উচ্চারণ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তবে ডিজে পার্টির কর্মীরা অতি আস্ফালনে ক্লান্ত হয়ে পড়বেন শিগগিরই। তখন ঠিকই আদর্শিক শ্লোগান, আহবান সাধারণের কাছে, শীর্ষ নেতাদের কাছে পৌঁছবেই। কিন্তু ততো দিনে বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আব্দুল কাদের মির্জার সত্যবচন কি আসলেই সত্য? নাকি রাজনৈতিক কৌশল? এসব জবাব খুঁজতে গিয়ে আন্তঃবিরোধ বাড়বে।

সাংবাদিক মুজাক্কিরের মতো আরো প্রাণ ঝরবে অকারণে। তাই বচন যেভাবেই আসুক তাকে পরখ করে নিয়ে, নিজেকে নিজেদের শুদ্ধ করে নেওয়া উচিত। মনে রাখা দরকার ফল বঞ্চিত মালীর দীর্ঘশ্বাসে, বৃক্ষের শিকড় ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হয়। ঐ ক্ষয় রোগ থেকে দেশের শুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে নিরাপদ রাখতে হবে।

নিরাপদ রাখার কোনো উদ্যোগ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। বরং জট শক্ত করা হচ্ছে। আব্দুল কাদের মির্জার কথাই যদি বলি, দেখা যাচ্ছে তাকে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না। বসুরহাটে এখন নিজ দলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে। কাদের মির্জা সমাবেশ করতে না পেরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আশ্রয় নেন। এতে তার বক্তব্য আরো বিস্তার লাভ করে। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বরাবর বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্ত করে দেখতে। প্রশ্ন রাখেন তার মতো কর্মীর প্রধানমন্ত্রীর প্রয়োজন আছে কিনা ?

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের অনুজর মূর্তিতে সাধারণ মানুষের মাঝে দুই রকম প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল, এক আওয়ামী লীগ এবার সত্যি সত্যি বেকায়দায় পড়তে যাচ্ছে। দলের প্রভাবশালী নেতার ভাই-ই যদি এমন বিদ্রোহী হয়ে উঠেন, তাহলে তো সত্যি দলের ভেতরকার অবস্থা ভালো নেই। ছোট খাটো পটকা বড় বিস্ফোরণের জন্ম দিতে পারে। তারা আশা করছিলেন, আব্দুল কাদের মির্জার অনুসারী হবেন অনেকেই। হলেন না কেউ যখন, তখন ভাবা হয়েছিল ভোটে তাকে হারিয়ে দেওয়া হবে, তাও হলো না। তিনি জিতে এলেন।

আমজনতা কিন্তু আব্দুল কাদের মির্জার সত্যবচন বিশ্বাস করে বসে আছেন। তাদের চারপাশ বিশ্বাসের প্রণোদনা বাড়ছে। অন্যদিকে আরেকটি পক্ষ এখনও বিষয়টিকে আপোষের খেলা হিসেবে দেখছেন। ভাবছে কিছুই হবে না। কিছুদিন পর অন্য কোনো ইস্যুতে আব্দুল কাদের মির্জা হারিয়েই যাবে।

ভাবা হলো, এবার বুঝি তিনি থামবেন। থামলেন না। বরং তার সত্য বচন ও প্রতিবাদী অবস্থান অব্যাহত রইলো। তিনি বলে চলছেন। আর কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগও যেন ঘরোয়া অনুশীলন ম্যাচ খেলে যেতে থাকলো। মাঠে বিরোধী দল নেই। আব্দুল কাদের মির্জাকে নিয়েই রাজনীতির মাঠ সরব করে রাখতে চাইলো। গণতন্ত্রের কৃত্রিম নিঃশ্বাসটুকু না হয় রইলো। কিন্তু ঘরোয়া খেলাতেও ঝগড়া বাঁধে। তাই হলো। সংঘর্ষে রক্ত ক্ষয় হলো। এই ক্ষয়ের সঙ্গে যে দলের ক্ষরণ শুরু হলো তা দল বুঝতে পারছে না এখনও।

আমজনতা কিন্তু আব্দুল কাদের মির্জার সত্যবচন বিশ্বাস করে বসে আছেন। তাদের চারপাশ বিশ্বাসের প্রণোদনা বাড়ছে। অন্যদিকে আরেকটি পক্ষ এখনও বিষয়টিকে আপোষের খেলা হিসেবে দেখছে এখনও। ভাবছে কিছুই হবে না। কিছুদিন পর অন্য কোনো ইস্যুতে আব্দুল কাদের মির্জা হারিয়েই যাবে।

এই হারিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশাটি স্বাস্থ্যকর নয়। নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি করে ফুসকুড়ি তৈরি করাতে ঝুঁকি আছে। কারণ এই ফুসকুড়িতে যেকোনো সময় ‘ইনফেকশন’ দেখা দিতে পারে। যা দলের কাঠামো ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই আব্দুল কাদের মির্জাকে ছোটখাটো ফুসকুড়ি ভেবে অবহেলা না করে, যথাযথ চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন। কেন, কোন পরিস্থিতিতে আব্দুল কাদের মির্জারা আর্বিভুত হন, হচ্ছেন, সেই পর্যবেক্ষণ ও তদারকি জরুরি। আওয়ামী লীগ অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল, এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি অসংখ্যবার হয়েছে, তাই এমন ইনসুইং বল বিচক্ষণতার সঙ্গেই মোকাবিলা করবে বলে বিশ্বাস রাজনীতির দর্শককুলের।

তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী