সাকিব আল হাসান ছুটি চেয়েছেন। বিসিবি তার ছুটি মঞ্জুরও করেছে। নিউজিল্যান্ড সিরিজ তিনি খেলছেন না সন্তান সম্ভবা স্ত্রীর পাশে থাকতে। এরপর এপ্রিল-মে তে শ্রীলঙ্কা সিরিজ খেলবেন না আইপিএলের জন্য।

সমস্যাটা বেধেছে শ্রীলঙ্কা সিরিজে সাকিবের ছুটির কারণ নিয়ে। জাতীয় দলের হয়ে না খেলে সেই সময়টা আইপিএলে সাকিবের খেলার বিষয়কে বিসিবি বা সাধারণ ক্রিকেট সমর্থক- কেউ যেন মেনে নিতে পারছেন না। এক পা সামনে এগিয়ে অনেকে আবার সাকিবের দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন তুলে বসেছেন! আর সাকিবহীন একাদশের দুশ্চিন্তায় এই সময়ে বিসিবির অসহায়ত্ব, পুরো বিষয়কে আরও বিতর্কিত এবং জ্বালাময় করে তুলেছে।

হঠাৎ করে সাকিব বিষয়ে বিসিবি বেশকিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে প্রায়।

১) সাকিব আর টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহী নন।

২) সাকিব প্রয়োজনীয় ক্রিকেটার কিন্তু অপরিহার্য নন।

৩) সাকিবকে টেস্ট অধিনায়ক করে কোনো ফায়দা হয়নি।

৪) বিসিবির বিনিয়োগকে যথার্থ মূল্যায়ন করেননি সাকিব।

৫) জাতীয় দলে খেলার জন্য কাউকেই জোরাজুরি করবে না বিসিবি।

শেষের সিদ্ধান্ত শুধু সাকিবের ক্ষেত্রে নয়, কার্যত সবার জন্যই প্রযোজ্য- এমন ঘোষণাও দিয়েছেন বিসিবি প্রধান। ২০০০ সালে টেস্ট অভিষেক হওয়ার পর ২০২১ সালে এসে আমরা জানলাম-জাতীয় দলে খেলার জন্য খেলোয়াড়দের বিসিবি ‘জোরাজুরি’ করে বা ‘অনুরোধ’ করে! এই ব্যর্থতা কার? ক্রিকেটারদের নাকি ক্রিকেট বোর্ডের?

একজন কর্মী বা কর্মকর্তা একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারেন। প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নতিতে তার বড় ভূমিকা থাকতেই পারে। প্রতিষ্ঠানের এই উন্নতি করাই তো তার কাজ। নির্ধারিত সেই কাজের জন্য তিনি বেতনাদিসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান, যার মধ্যে ছুটিও অন্যতম। যা তার চাকরির অন্যতম শর্তও বটে। কর্মী হিসেবে সবচেয়ে দক্ষ যিনি নিজেকে শুধু প্রয়োজনীয় নয়, প্রতিষ্ঠানের জন্য নিজেকে এক অর্থে অপরিহার্যও করে তুলতে সক্ষম।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিব আল হাসান নিজেকে তেমনই এক প্রয়োজনীয় এবং একই সঙ্গে অপরিহার্য ক্রিকেটার হিসেবে পরিণত করে তুলেছেন। তার অনেক কিছুই হয়তো আপনার পছন্দ হবে না। তার অনেক কথাকেই কখনো ঔদ্ধত্য কখনো খামখেয়ালিপূর্ণ মনে হবে। কিন্তু মাঠের পারফর্মার হিসেবে তাকে আপনি শীর্ষ আসন দিতে বাধ্য। কারণ সাকিব ভালোই জানেন একমাত্র ২২ গজের পারফরম্যান্সেই একজন ক্রিকেটারকে চেনায়, অন্যকিছু কখনো নয়।

তাই শাস্তি, নিষেধাজ্ঞা, জরিমানা, অধিনায়কত্ব হারানো, মাঠের বাইরের বিতর্ক; এমন অনেককিছু সাকিবের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে সঙ্গী হলেও দিনশেষে তার পারফরমেন্সের কারণেই সাকিব এখনো বাংলাদেশের ‘ম্যান অব দ্যা ক্রিকেট!’

সাকিব কি কখনো বিসিবিকে বলেছেন তিনি আর টেস্ট খেলতে চান না? বিসিবি তাকে জোর করে টেস্ট খেলাচ্ছে এমন অভিযোগ কি সাকিব কখনো কোথাও করেছেন? ...সমস্যা হলো প্রতিষ্ঠান যখন নিজেই নিজের সেরা কর্মীকে প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে তখন ভালোবাসা হারিয়ে যায়; রয়ে যায় হীনমন্যতা!

মাঠে তো বটেই, মাঠের বাইরে বড় অংশ জুড়েও তার এমনই ক্রিকেটীয় প্রভাব যে সাকিবকে ছাড়া আপনি বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাফল্যের অংশটাই সাজাতে পারবেন না! আর তাই আজ যখন ‘ছুটি’ নিচ্ছেন তখন সেটাই দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আলোচনার বিষয়!

সাকিব কিন্তু প্রতিষ্ঠানের নিয়ম মেনেই ছুটির আবেদন করেছেন। বিসিবি সেটা অনুমোদনও করেছে। তাহলে এখন কেন বিসিবি সাকিবের ছুটির বিষয়টা নিয়ে নিজেদের অসহায়ত্ব জানাচ্ছে? ধরা যাক, বিসিবি শ্রীলঙ্কা সিরিজ থেকে সাকিবের ছুটি অনুমোদন করলো না। তাহলে কি হতো? সাকিব কি বিসিবির সেই সিদ্ধান্ত মানতেন না?

এর উত্তরে বিসিবির অবস্থান পরিষ্কার-‘আমরা জোর করে কাউকে টেস্ট খেলাতে চাই না।’ প্রশ্ন হলো, সাকিব কি কখনো বিসিবিকে বলেছেন তিনি আর টেস্ট খেলতে চান না? বিসিবি তাকে জোর করে টেস্ট খেলাচ্ছে এমন অভিযোগ কি সাকিব কখনো কোথাও করেছেন? টেস্ট ক্রিকেটে নিজের ক্যারিয়ার আর কতদিন দেখতে চান-এমন প্রশ্নের বিষয়ে কি বিসিবি কখনো সাকিবের সঙ্গে আলোচনা করেছে? একজন ক্রিকেটার তো আজীবন জাতীয় দলে খেলবেন না। পর্যায়ক্রমে কোন ফরম্যাটের ক্রিকেট থেকে আগেভাগে তার সরে দাঁড়ানো উচিত-কফি’র টেবিলে বসেও তো এসব প্রশ্নের সহজ সমাধান মিলে।

সাকিবের ছুটি এবং টেস্ট ক্রিকেটে তার অনীহা প্রসঙ্গে বিসিবি সভাপতি গোটা মিডিয়ার সামনে যে বক্তব্য দিলেন, সেখানে তার পাশে সেদিন কি সাকিবকে রাখা যেত না?  সমস্যা হলো প্রতিষ্ঠান যখন নিজেই নিজের সেরা কর্মীকে প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করে তখন ভালোবাসা হারিয়ে যায়; রয়ে যায় হীনমন্যতা!

আইপিএলে সাকিব আগেও খেলেছেন। কিন্তু এবার খেলার আগে তাকে শুনতে হচ্ছে তার দেশপ্রেম নেই। দেশের হয়ে না খেলে তিনি খেলছেন বিদেশি ফ্র্যাঞ্চাইঞ্জি লিগে। আইপিএলের জন্য সাকিব কয়টা টেস্ট মিস করবেন? হিসাব বলছে দুটো। ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে দেশের হয়ে ৫৭ টেস্ট, ২০৭টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলা ক্রিকেটারকে সম্ভাব্য দুটো টেস্ট মিস করার কারণে এখন ‘দেশদ্রোহী গালি’ শুনতে হচ্ছে।

সাকিব আল হাসান বাংলাদেশ ক্রিকেটের খুবই দক্ষ একজন কর্মী, কিন্তু বিসিবি নামক প্রতিষ্ঠানটি সেই তুলনায় ‘ব্যাড এমপ্লয়ার’! টেস্ট দল কখনোই এক বা দু’জন ক্রিকেটারের ওপর নির্ভর করা হতে পারে না। একক কৃতিত্বের প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু খেলাটা যে দলীয়। সাকিব কোনো টেস্ট ম্যাচে না খেললে পুরো দলের কম্বিনেশনের ভিত যেন কেঁপে ওঠে। কেন এমন হবে? দলটা তো এগারোজনের। কিন্তু পেছনের লম্বা সময়জুড়ে সাকিব নির্ভরতার ওপর আয়েশের চাদর বিছিয়ে সুখ নিদ্রায় ছিল বিসিবি। আর এখন সাকিবহীন সময়ের চিন্তায় ভুগছে নিদ্রাহীনতায়! ৩৪-এ পা রাখা সাকিবকে আর কতটা সময় ক্রিকেটে পাওয়া যাবে- সেই পরিকল্পনার কোনো ফাইল কি বিসিবি ওপেন করেছে? মনে হয় না!

আইপিএলে সাকিব আগেও খেলেছেন। কিন্তু এবার খেলার আগে তাকে শুনতে হচ্ছে তার দেশপ্রেম নেই। দেশের হয়ে না খেলে তিনি খেলছেন বিদেশি ফ্র্যাঞ্চাইঞ্জি লিগে। আইপিএলের জন্য সাকিব কয়টা টেস্ট মিস করবেন? হিসাব বলছে দুটো। ১৪ বছরের ক্যারিয়ারে দেশের হয়ে ৫৭ টেস্ট, ২০৭টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলা ক্রিকেটারকে সম্ভাব্য দুটো টেস্ট মিস করার কারণে এখন ‘দেশদ্রোহী গালি’ শুনতে হচ্ছে। হাত-পা ও শরীরে অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে খেলার মাঠে লড়েন সাকিবরা। প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়াই করে ম্যাচ জেতান। মাঠের হারে তাদের কষ্টের কান্না স্টেডিয়ামের ভিআইপিতে বসাদের চেয়ে আরও বেশি। সেই তাদেরই শুনতে হচ্ছে এরা অর্থলোভী।

বলাবলি হচ্ছে আইপিএলে ৩ কোটি ২০ লাখ রুপি কামাতে সাকিব দেশের হয়ে খেলছেন না সেইসময়। টাকা তো অবশ্যই একটা ফ্যাক্টর। তবে প্রশ্ন হলো সাকিব তো বিসিবি’র অনুমতি নিয়েই আইপিএলে যাচ্ছেন। দেশের আরও পাঁচজন ক্রিকেটারও তো আইপিএলে খেলার জন্য নাম দিয়েছিলেন। সুযোগটা পেয়েছেন শুধু সাকিব ও মুস্তাফিজ। বাকিরাও কিন্তু টাকা কামাই করার জন্যই আইপিএলের ড্রাফটে নাম পাঠিয়েছিলেন। আর টাকা কে না কামাতে চায়?

এই প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ এবং চিন্তাবিদ আফসান চৌধুরীর ফেসবুকের স্ট্যাস্টাসটা হুবহু তুলে দিচ্ছি-‘সাকিবকে গালি দেবার কি মানে? সে তো হালাল পথে রুজি করছে। কোন শালা টাকাকে বাপ মানে না এই দেশে?’

লেখাটা শেষ করি আরেকটি বাস্তবতা দিয়ে। একই ছাদের নিচে থেকেও যখন দম্পতি আকস্মিক সিদ্ধান্তে বিছানা আলাদা করে নেয়, তখন সেটাকে আর সুখী গৃহকোণ বলে না। ব্যাটিং জুটির জন্য একে অন্যের প্রতি আস্থা, সম্মানবোধ, শ্রদ্ধা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটা হারিয়ে সাকিব ও বিসিবি দুই পক্ষই এখন মাঝ উইকেটে; রান আউট হতে পারে যে কেউ!

এম. এম. কায়সার ।। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক