আমরা যারা কৃষি খাতে কাজ করি প্রায়শই অভিযোগ শুনি, কৃষি গবেষণা সংস্থাগুলো প্রতিবছর এতো এতো জাত-প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে কিন্তু সে তুলনায় মাঠে উন্নত জাত বা প্রযুক্তি সম্প্রসারণ হচ্ছে না অথবা সম্প্রসারণ হলেও তার হার আশানুরূপ নয়। তাই কৃষি বিষয়ক যেকোনো সভা সেমিনার ও কর্মশালায় প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পাশাপাশি সম্প্রসারণে গবেষণা-সম্প্রসারণ লিংকেজ বা সংযোগ আরও জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। কাজের প্রয়োজনে আমি গত ছ’মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) কর্তৃক আয়োজিত প্রায় দশটি আঞ্চলিক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করি। এর প্রায় প্রতিটিতেই কৃষক ও মাঠপর্যায়ের সম্প্রসারণ কর্মীদের কাছ থেকে যে অভিযোগটি পাওয়া গেছে সেটি হলো নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণে গবেষণা-সম্প্রসারণ দুর্বল সংযোগ প্রধান সমস্যা।

আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেম (এনএআরএস) এর অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো বিভিন্ন ফসলের নতুন নতুন জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা। তারা যে সকল জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এই জাত ও প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে বা মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ করে থাকে। এটিকে কেন্দ্র করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষকদের মধ্যে যে পারস্পরিক সম্পর্ক সেটিকেই গবেষণা-সম্প্রসারণ-কৃষক সংযোগ বলা যেতে পারে। এ কাজের প্রশাসনিক দিক তদারকি করে স্বয়ং কৃষি মন্ত্রণালয় এবং গবেষণার বিষয়াদি সমন্বয় করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিজ্ঞানীদের কাজ ফসলের নতুন জাত ও উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা। কিন্তু এগুলোর মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণের দায়িত্ব কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। আর এ কাজে বীজ সার ও নানা উপকরণ সহায়তা প্রদান করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। এর বাইরে বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা এ কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নতুন জাত প্রযুক্তি সম্পসারণে এই পুরো প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত প্রত্যেকটি সংস্থা ও এর কর্মীদের সাথে কৃষকের একটি শক্তিশালী ও দৃঢ় সংযোগ থাকা আবশ্যক। যাতে কৃষক যা চায় সংস্থাগুলো মাঠপর্যায়ে তা যোগান দিতে পারে।

সংস্থা হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিস্তৃতি যেমন বেশি তেমনি এই প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিধিও ব্যাপক। কৃষিতে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কৃষি বাজার সংযোগ, বাণিজ্যিক কৃষি জনপ্রিয়করণ, পরিবেশ সুরক্ষা, কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ, ভ্যালু চেইন, সাপ্লাই চেইন ইত্যাদি সাম্প্রতিককালে কৃষি সম্প্রসারণের মূল কাজের মধ্যে পড়ে।

অনুরূপভাবে প্রযুক্তি ব্যবহারে মাঠপর্যায়ে কৃষক যেসব সমস্যা বা অসুবিধার সম্মুখীন হন সেগুলো সম্প্রসারণ কর্মীদের মাধ্যমে গবেষণা সংস্থাগুলোতে পৌঁছানো হয় যাতে বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে সেগুলোর গ্রহণযোগ্য ও সাশ্রয়ী সমাধান বের করতে পারেন। এই প্রক্রিয়াটি যদি সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে কাজ করে তাহলে প্রযুক্তি সম্প্রসারণে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এই যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং এর সঙ্গে জড়িত কোনো একটি একক বা পক্ষ যদি ঠিক মতো কাজ না করে তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটি বাধা প্রাপ্ত হয় এবং কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

সংস্থা হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিস্তৃতি যেমন বেশি তেমনি এই প্রতিষ্ঠানের কাজের পরিধিও ব্যাপক। কৃষিতে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, কৃষি বাজার সংযোগ, বাণিজ্যিক কৃষি জনপ্রিয়করণ, পরিবেশ সুরক্ষা, কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ, ভ্যালু চেইন, সাপ্লাই চেইন ইত্যাদি সাম্প্রতিককালে কৃষি সম্প্রসারণের মূল কাজের মধ্যে পড়ে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাথে সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও ব্যক্তিমালিকানাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এসব বিষয়ে সম্প্রসারণ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। এই সার্বিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু কৃষক এবং লক্ষ্য কৃষি ও কৃষকের উন্নয়ন। আর সেটি তখনই নিশ্চিত হবে যখন গবেষণা-সম্প্রসারণ-কৃষক সংযোগ সুদৃঢ় হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে ভূমিকা পালনকারী অন্যতম প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে বিএডিসি’র সেবার পরিধিও সমগ্র বাংলাদেশে বিস্তৃত। মাঠপর্যায়ে এর অফিসসমূহ উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও প্রত্যন্ত এলাকায় অফিসের সুবিস্তৃত নেটওয়ার্ক রয়েছে। বিএডিসির মৌলিক কাজগুলো হচ্ছে সারা বাংলাদেশে কৃষি উপকরণ উৎপাদন, সংগ্রহ (ক্রয়), পরিবহন, সংরক্ষণ এবং বিতরণ ব্যবস্থাপনা টেকসই করা। বিশেষ করে অত্যাবশ্যকীয় কৃষি উপকরণ যেমন: বীজ, সার সরবরাহ এবং ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকের জন্য সেচের সুযোগ সৃষ্টি করা। কিন্তু নতুন জাত-প্রযুক্তি সম্প্রসারণে বিএডিসির সীমাবদ্ধতা হচ্ছে মাঠপর্যায়ে চাহিদা তৈরি না হলে বিএডিসি নতুন কোনো জাতের বীজ উৎপাদনে আগ্রহী হয় না বা ঝুঁকি নিতে চায় না। মাঠপর্যায়ে চাহিদা সৃষ্টি এই জায়গায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিএডিসির একটি গ্যাপ রয়েছে যেটি সমাধান করা অতি জরুরি।

উপরের আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, গবেষণা-সম্প্রসারণ ও বিতরণ ব্যবস্থা উভয়ই পরস্পর নির্ভরশীল। অর্থাৎ একটি ছাড়া অন্যটি তার দায়িত্ব সম্পাদন করতে পারে না। সুতরাং এই সকল প্রতিষ্ঠানের ভালো যোগাযোগ, নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং কার্যকর সহযোগিতা গবেষণালব্ধ জ্ঞানের প্রসারণে প্রাথমিক প্রয়োজন। বাংলাদেশে গবেষক এবং সম্প্রসারণ কর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগে ও বোঝাপড়ায় কিছু দুর্বলতা রয়েছে যা গবেষণা এবং সম্প্রসারণের মধ্যে সহযোগিতা এবং যোগসূত্রকে বাধা দেয়। এটি দূর করতে পারলে বাকি সমস্যাগুলো এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে।

বিএডিসির মৌলিক কাজগুলো হচ্ছে সারা বাংলাদেশে কৃষি উপকরণ উৎপাদন, সংগ্রহ (ক্রয়), পরিবহন, সংরক্ষণ এবং বিতরণ ব্যবস্থাপনা টেকসই করা।

সাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতা বলি। ফার্মিং ফিউচার বাংলাদেশ’র আয়োজনে সাংবাদিকদের একটি প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষক হিসেবে গত জুলাই মাসের শেষের দিকে গিয়েছিলাম রাজশাহী। দেশের কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে উপস্থাপনা ছিল আমার। উপস্থাপনা শেষে আমাকে স্থানীয় এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ব্রি’র একজন কর্মকর্তা হিসেবে আপনি কি মনে করেন এতো জাত-প্রযুক্তির প্রয়োজন আছে? উদাহরণস্বরূপ বললেন, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট গত পাঁচ দশকে প্রায় ১০৫টি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে। এখন বছরে গড়ে ৪-৫টি জাত উদ্ভাবন করছে কিন্তু মাঠে তো এখনো সেই ব্রি ধান ২৮, ২৯, ১১, ৪৮ এই জাতগুলোই বেশি চলছে। তাহলে এতো জাতের কী দরকার?

আমি বললাম, দেশের সব অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি ও পরিবেশ এক রকম নয়। তাছাড়া সবার রুচি ও পছন্দও ভিন্ন। আপনি আগে যে এনালগ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন তা কি এখনো করেন? তিনি বললেন, না। আমি বললাম আপনি তো আগে মাস্কও ব্যবহার করতেন না এখন যে করছেন! উনি বললেন এটা তো সময় ও পরিস্থিতির কারণে। আমি বললাম, ব্যাপারটা অনেকটা সে রকম। পরিবেশগত কারণে বাংলাদেশের একেক অঞ্চলের জাতের চাহিদা একেক রকম। তাছাড়া আগে লোকসংখ্যা ছিল কম, খাদ্যের চাহিদা ছিল সীমিত। এখন লোকসংখ্যা ও খাদ্যের চাহিদা দুটোই বেড়েছে, তাই দিন দিন উফশী জাতের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। আর সময়ের সাথে মানুষের রুচি এবং পছন্দ পরিবর্তিত হচ্ছে তাই নানা দিক বিবেচনায় নিয়ে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা অপশন তৈরি করছেন, ব্যবহার করা না করা কৃষকের ব্যাপার। আমার উত্তরে তিনি সম্মতি প্রকাশ করলেন, বললেন এভাবে তো চিন্তা করিনি।

অতএব বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব হচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশ, সময়, রুচি চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে নতুন নতুন জাতের অপশন তৈরি করা, সেগুলো আজই ব্যবহার হবে বিষয়টি এমন নয়, নিকট ভবিষ্যতের কৃষি ক্ষেত্রে কি ধরনের সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ দেখা দিবে সেটি বিবেচনায় নিয়ে জাত-প্রযুক্তি-উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করে যেতে হবে। পাশাপাশি নতুন জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের পারস্পরিক সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকের নতুন জাত ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই কেবল কৃষিতে বর্তমানে অর্জিত সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যাবে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।

এম আব্দুল মোমিন।। ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি