ছবি : সংগৃহীত

জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবীব্যাপী বাড়ছে তাপমাত্রা। গলছে মেরু অঞ্চলের বরফ। বিপদসীমা অতিক্রম করছে সমুদ্র ও নদীর পানির উচ্চতা। তলিয়ে যাচ্ছে নিচু অঞ্চলগুলো। ভারী বৃষ্টিপাত, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

বসতঘর ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হচ্ছে কোটি কোটি মানুষ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যাও। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আগামী তিন দশকে ২১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ ঘর-বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবগুলো অবশ্যই বিশ্বজুড়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীব্যাপী যে তাপমাত্রা বাড়ছে তার উত্তাপ অনুভূত হচ্ছে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটেও।

মাঠে খেলতে নেমে প্রায়ই আবহাওয়াজনিত প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন ক্রিকেটাররা। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বের নামকরা ম্যাগাজিনগুলো এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। প্রতিবেদনে গুরুত্ব সহকারে বলা হয়েছে যে, বিশ্বজুড়ে যেভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে তাতে করে বহিরাঙ্গন ক্রিয়াগুলোর মধ্যে সবচাইতে বড় ধাক্কা খাবে ক্রিকেট।

আরও পড়ুন : জলবায়ু পরিবর্তন : ঝুঁকি মোকাবিলায় আমরা কি সক্ষম?

ফুটবলের পরেই ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় একটি খেলা। ক্রিকেট একটি গ্রীষ্মকালীন বহিরাঙ্গন খেলা এবং বিশ্বে অনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা হয় বিরূপ আবহাওয়ায়, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ অনেক উচ্চ তাপমাত্রার দেশে। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে ওভার কর্তন থেকে শুরু করে খেলা পরিত্যক্ত পর্যন্ত হয়েছে বহুবার। 

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবগুলো অবশ্যই বিশ্বজুড়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীব্যাপী যে তাপমাত্রা বাড়ছে তার উত্তাপ অনুভূত হচ্ছে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেটেও।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা অনেক দেশ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে ভালো খেলুড়ে দেশ হিসেবে স্বীকৃত। বিশেষ করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশ।

প্রাকৃতিক এবং মানব সৃষ্ট কারণে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনে তাপদাহ, বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে এসব দেশগুলো।

অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মতো ভালো ক্রিকেট খেলুড়ে দেশগুলোর উপরও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। ইংল্যান্ডে ২০২২ সালে সবচেয়ে উষ্ণতম দিনের মুখোমুখি হয়েছে ক্রিকেট।

জুন মাসে পাকিস্তানের মুলতানে তিনটি ম্যাচ খেলতে গিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেখানে তখন তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০২১ সালে সিডনিতে অ্যাশেজ চলাকালীন তাপদাহে বিপদ আরও বেড়ে গিয়েছিল, যখন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক জো রুট পঞ্চম টেস্টের পঞ্চম দিনে মাত্র এক ঘণ্টা ব্যাট করতে পেরেছিলেন এবং অসুস্থ হয়ে অবসর নিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন : পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের ভূমিকা কী?

সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের মাঝখানে এক পর্যায়ে তাপমাত্রা ৫৭.৬ ডিগ্রিতে আঘাত করার সাথে চতুর্থ দিনে তিনি শ্বাসরুদ্ধকর তাপমাত্রার মধ্যে ছিলেন। শুধুমাত্র অতিরিক্ত তাপমাত্রায় ক্রিকেটের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসময়ে বৃষ্টিও ক্রিকেটের জন্য একটি বড় দুর্যোগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে।

অন্যদিকে অনাবৃষ্টির ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। এছাড়াও ঝড় আরও একটি দুর্যোগ। ২০১৭ সালে ঘূর্ণিঝড় ক্যারিবীয় অঞ্চলের পাঁচটি দেশের ক্রিকেট স্টেডিয়ামগুলোর ব্যাপক ক্ষতি করেছিল।

জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে ক্রিকেট দলগুলোর সফর পরিকল্পনায় নানা রকম সমস্যা হচ্ছে। অতিবৃষ্টি তাপদাহ ছাড়াও বায়ুদূষণ, ধোঁয়া, ধূলিকণা ম্যাচের সময়সূচি ব্যাহত করছে মারাত্মকভাবে।

ক্রিকেট এমন একটি খেলা যেখানে খেলোয়াড়রা লম্বা হাতা শার্ট, ট্রাউজার, প্যাড ও হেলমেট পরিধান করে থাকেন এবং খেলাটি দীর্ঘ সময় ধরে হয়। উপরন্তু ক্রিকেট এমন একটি খেলা যেখানে আবহাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে এবং আবহাওয়া খেলাকে যেকোনো মুহূর্তে প্রভাবিত করতে পারে।

জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রিকেট সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটের জন্য জলবায়ু তহবিল গঠনের সময় এসেছে।

বৃষ্টি বা রৌদ্রোজ্জ্বল দিন খেলার ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণ করে দিতে পারে। বিশেষ করে রৌদ্রোজ্জ্বল দিন সাধারণত ব্যাটিংয়ের জন্য বেশি সহায়ক, অন্যদিকে মেঘলা এবং আর্দ্র পরিস্থিতি বোলিং সমর্থন করে। বিভিন্ন সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রিকেট সমস্যার সম্মুখীন হলেও বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়নি।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল এই বিষয় নিয়ে তেমন মনোযোগ দেয়নি। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট অতিরিক্ত তাপ থেকে খেলোয়াড়দের রক্ষা করতে নতুন একটি তাপ নীতি চালু করেছে, যার মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি পানের বিরতির এমনকি প্রয়োজন হলে খেলা স্থগিত করার বিষয়ও বিবেচনা করা হবে। কিন্তু ক্রিকেট খেলুড়ে অন্যান্য দেশগুলো এই বিষয় নিয়ে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না এমনকি বাংলাদেশও নয়। তবে তা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে।

খেলার উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন উদ্বেগের বিষয় আর এর সমাধান নির্ভর করে বিশ্বের রাজনীতিবিদ এবং খেলার সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের ওপর।

আরও পড়ুন : উন্নয়ন গ্রাস করছে প্রকৃতি 

জলবায়ু সঙ্কট থেকে ক্রিকেটকে রক্ষা করার জন্য কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন আর এক্ষেত্রে আইসিসি অবশ্যই মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের আবহাওয়া এবং জলবায়ু বিবেচনায় নিয়ে ক্রিকেট কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায় এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রিকেট সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটের জন্য জলবায়ু তহবিল গঠনের সময় এসেছে।

উষ্ণ আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেটও ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তাই বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড এই বিষয় বিবেচনায় রেখে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারে।

এই পরিকল্পনায় বিভিন্ন ধরনের কৌশল থাকতে হবে যে আমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতি কীভাবে মানিয়ে নেব। পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ক্রিকেটার, ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের নেতৃবৃন্দ এবং পরিবেশবিদদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।। কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com