অভিনয়ের আড়ালে তার বহু কীর্তি ঢাকা পড়েছে। অনেক মানুষই জানেন না মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্বগাঁথা ইতিহাস, জাতির জনক হত্যার প্রতিবাদ, স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণআন্দোলন উজ্জীবিত করার সোপান। বেশিরভাগ মানুষ জানেন অভিনেতা হিসেবে। অথচ তার জীবনে কর্মের হিসাব কষলে ৩০ শতাংশের বেশি হবে না। বাকি ৭০ শতাংশ—একাত্তরের রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানের সেনাদের বিরুদ্ধে গৌরবগাঁথা লড়াই; স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে থেকে বিজয় ছিনিয়ে আনা।

এর বাইরে সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও সমান অবদান রেখেছেন তিনি। হাজার বছরের বাঙালির ঐতিহ্য চর্চায় দেশজুড়ে গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার। যে অসম্পদায়িক চেতনার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালি লড়েছিলেন, সেই চেতনার জন্য এখনো পথে প্রান্তরে ছুটে চলেছেন ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’-এর পতাকা নিয়ে।

দেশ ও মানুষের জন্য নীরবে কাজ করে যাওয়া এই সাদামাটা মানুষের নাম পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ তার জন্মদিন। ২০ বছর আগে, তখন তিনি জনপ্রিয় অভিনেতা, প্রথম দেখা নাটোরের বাগাতিপাড়ায় গ্রাম থিয়েটারের সম্মেলনে। এরপর থেকে তার কাছাকাছি থাকার সুযোগ হয়েছে।

সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তার সাথে থেকে থেকেছি। দেখেছি দেশের বিভিন্ন জনপদে তার জনপ্রিয়তা। মানুষ ছুটে এসেছেন তার দরাজ কণ্ঠের বক্তৃতা শুনতে। প্রতিটি জনসভায় শব্দের গাঁথুনিতে তুলে ধরেছেন ইতিহাস; বলেছেন বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে কীভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।

মুগ্ধ হয়ে সেসব শুনেছেন হাজারো দর্শক। আমার মতো একজন সাধারণকে তার কাছে থাকার সুযোগ দিয়েছেন। দেখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পথ। 

বাঙালি জাতীয়তার ইতিহাস চিরায়ত অসাম্প্রদায়িকতার। ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার সেখানে স্থান নেই। ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ জলাঞ্জলি দিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় গড়ে তুলেছেন ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামের সামাজিক সংগঠন।

বাঙালি জাতীয়তার ইতিহাস চিরায়ত অসাম্প্রদায়িকতার। ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার সেখানে স্থান নেই। ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ জলাঞ্জলি দিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় গড়ে তুলেছেন ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামের সামাজিক সংগঠন।

‘ধর্ম যার যার, বাংলাদেশ আমার’ এই বোধ নতুন করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সবার মাঝে। আমার সৌভাগ্য—এই বরেণ্য বহুমুখী প্রতিভার সাথে সম্প্রীতির পতাকা নিয়ে ঘুরেছি জনপদ থেকে জনপদে।

দেশের জন্য ১৯৭১ সালে রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন। লাল-সবুজ পতাকা তুলে দিয়েছেন আমাদের হাতে। স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগের কাজ করতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য লাভ করেন। দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে।

পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হারায় বাংলাদেশ। নেমে এলো ঘোর অন্ধকার, তবুও থামেননি তিনি। জনমত গঠনে পত্রিকায় লিখলেন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার কথা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে গড়ে তুলেছিলেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবং বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার।

১৯৮৫ সালে তিনি এরশাদবিরোধী আন্দোলনে মাঠে নামলেন। ‘বাংলাদেশ যুব ঐক্য’ গঠন করলেন। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়ে শুরু করলেন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন। ছিনিয়ে আনলেন গণতন্ত্র। কিন্তু ১৯৯১-এর সাধারণ নির্বাচনে ফিরল না সেই গণতন্ত্র। দৈনিক লালসবুজ পত্রিকায় সম্পাদক হয়ে কলম ধরলেন অনিয়মের বিরুদ্ধে।

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়ের জীবনটিও বর্ণাঢ্য। যার শুরুটা হয়েছিল রাজবাড়ী আর ফরিদপুরে কল্যাণ মিত্রের নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। তার প্রথম টিভি নাটক ‘বিশ্বাস ঘাতকের মা’। তবে তাকে বেশি জনপ্রিয় করেছিল ধারাবাহিক ‘সকাল সন্ধ্যা’ নাটকটি। অসংখ্য নাটকের পাশাপাশি অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রে।

‘একাত্তরের যীশু’ উত্তরের খেপ’, গেরিলা’, মেঘলা আকাশ’, কিত্তনখোলা’, ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, আমার আছে জল’, আধিয়ার’, ‘মহামিলন’, বুনো হাঁস’ ছবিতে অভিনয় করে দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছেন।

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় জীবনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময় এসেছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়। প্রয়াত বরেণ্য সাংবাদিক ও ভাষাসৈনিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী নির্মাণ করেছিলেন ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটক। সেখানে বঙ্গবন্ধু চরিত্র অভিনয়ের জন্য অভিনেতা খুঁজছিলেন। দু’জনকে বলেছিলেন কিন্তু তারেক রহমানের রাজত্বে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করার সাহস দেখাননি কেউ। পরে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী প্রস্তাব দেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় গান আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো-এর রচয়িতা তার স্মৃতিচারণ করেছিলেন এইভাবে, “বঙ্গবন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য যখন অভিনেতা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তখন হাসান ইমাম (তিনি তখন নাটকটির রিহার্সাল দিচ্ছিলেন) বললেন, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রস্তাব দিলে কেমন হয়? আমি বললাম, তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক। মুসলমান অভিনেতারাই যেখানে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকায় অভিনয়ে রাজি নন, তখন তিনি কি রাজি হবেন? আর তাকে কোথায় পাব? তার ঢাকার ঠিকানা তো জানি না।

হাসান ইমাম বললেন, পীযূষ অন্যদের মতো সুবিধাবাদী নন। সাহসী অভিনেতা। তিনি রাজি হতে পারেন। রাজিও হলেন। এরপর তিনি এলেন লন্ডনে। বিএনপির ভাড়াটে গুণ্ডারা থিয়েটার হলে হামলা চালাবার হুমকি দিয়েছিল। তাতে সফল হয়নি। হাজার দর্শক ভর্তি হলে পীযূষ বঙ্গবন্ধুর ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করে নাটকের শেষ অঙ্কে সকলকে কাঁদিয়েছেন। 

...বঙ্গবন্ধু চরিত্র অভিনয়ের জন্য অভিনেতা খুঁজছিলেন। দু’জনকে বলেছিলেন কিন্তু তারেক রহমানের রাজত্বে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করার সাহস দেখাননি কেউ। পরে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী প্রস্তাব দেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

লন্ডনে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকের সফল মঞ্চায়নের পর নিউ ইয়র্কেও নাটকটির মঞ্চায়ন হয়। পরবর্তীতে কলকাতার অরোয়া স্টুডিওতে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকের শুটিং হয়। বঙ্গবন্ধু চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাণনাশের হুমকি এসেছে কয়েকবার।” [২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, জনকণ্ঠ]

দেশ যখন দুঃশাসনের কবলে তখন বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন বিপন্ন। বারবার হুমকির কারণে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় তিনি থাকতে পারতেন না। তবে সেই সময় নিয়মিত পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের খোঁজ নিয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; দিয়েছেন সাহস।

২০০৬ সালে লগি-বৈঠা আন্দোলনের সময় বিটিভিতে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকটি দেখানোর দাবি ওঠে। জনমত তৈরিতে পুরানা পল্টন, জিরো পয়েন্ট, প্রেসক্লাব, দৈনিক বাংলা এলাকায় ছড়ানো হয় লিফলেট। জনগণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিটিভিতে প্রচার হয় ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’। দেশের মানুষ দেখলেন বঙ্গবন্ধু হত্যার নির্মম ষড়যন্ত্রের চিত্রায়ন।

দেশের জন্য সংগ্রাম করা এই মানুষ এখনো পাননি একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক। কোনো ব্যক্তি পুরস্কৃত হওয়ায় পুরস্কারের মহিমা বাড়ে। কারণ গুণীজনদের সম্মান দেখানো না হলে নতুন গুণীজন সৃষ্টি হয় না। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন, প্রত্যেকটা মানুষ যখন একটা সমাজের জন্য, একটি জাতির জন্য, একটি দেশের জন্য অবদান রাখে, তাদের একটা সম্মান করা, গুণীজনের সম্মান করা, এটা মনে করি আমাদের কর্তব্য।’

আশা করি, কর্তব্য থেকেই দেশের জন্য নীরবে কাজ করে যাওয়া পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো গুণীজনদের রাষ্ট্র সম্মান জানাবে।

বিপ্লব কুমার পাল ।। গণমাধ্যমকর্মী