আজ ৫ অক্টোবর, বিশ্ব শিক্ষক দিবস। বিশ্ব শিক্ষক দিবস ’২২ উপলক্ষে Education International (EI) এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে- The Transformation of Education Begins with Teachers (শিক্ষক দিয়েই শিক্ষার রূপান্তর শুরু হয়)।

গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মক্তব থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেসব শিক্ষকের নিকট হতে শিক্ষা গ্রহণ করেছি। সেই সঙ্গে শ্রদ্ধা জানাই বিশ্বের সকল শিক্ষককে, যারা দোপায়ী জনগণকে ‘মানুষ বানানো’র মতো সবচেয়ে কঠিন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।

দিবসের ভূমিকা

বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধ এবং তাদের অধিকারকে সামনে রেখে সভা, সেমিনার, কর্মশালা ও র‍্যালির মাধ্যমে বিভিন্ন দিবস পালিত হয়। এসব দিবসে সংশ্লিষ্ট পেশার লোকদের সামাজিক ভূমিকা, সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য তাদের দায়িত্ব এবং সেই সঙ্গে তাদের অধিকার সম্বন্ধে রাষ্ট্রকে জাগ্রত করা হয়। কোনো জাতির ভাগ্য উন্নয়নে উন্নত শিক্ষার বিকল্প নেই এবং যোগ্য শিক্ষকই শিক্ষার চালিকাশক্তি। তাই শিক্ষকের অবস্থান পৃথিবীতে অগ্রগণ্য। ফলে বিশ্ব শিক্ষক দিবস পৃথিবীতে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিবস।

বাংলাদেশে শিক্ষক দিবস

বাংলাদেশে শিক্ষা এবং শিক্ষক এতটাই নগণ্য বিষয় যে এ নিয়ে রাষ্ট্র বা এর কোনো অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের ভাবার সময় নেই। শিক্ষা সংক্রান্ত দুটি মন্ত্রণালয়, চারটি অধিদপ্তরসহ আনুষঙ্গিক কয়েক ডজন অফিস থাকলেও এ দিবসে উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি কোনো দিন চোখে পড়েনি। এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরের শিক্ষকদের শতাধিক সংগঠনের ও উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম আছে কি না আমার জানা নেই। এমন কোনো কর্মসূচি আমার চোখে পড়েনি যা থেকে নবাগত একজন শিক্ষক বুঝতে পারবে কি তার দায়িত্ব, কী তার অধিকার। চোখে পড়েনি এমন কোনো কর্মসূচি যা থেকে দেশের একজন মানুষ বুঝতে পারবে ‘সমাজে শিক্ষকের ভূমিকা’। তাই সমাজের কাছেও এ দেশে শিক্ষকের অবস্থান অনেক দুর্বল।

পিছন ফিরে দেখা

পাকিস্তানি স্বৈরশাসকেরা এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পশ্চাৎপদ করে রাখতে চেয়েছিলেন। একচোখা শাসকের কাছ থেকে স্বদেশ ও দেশের মানুষকে উদ্ধারের স্বপ্নদ্রষ্টা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। ব্রিটিশদের কেরানী তৈরির শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের জন্য তিনি শিক্ষা প্রশাসন পুনর্গঠন শুরু করেন। তিনি একজন প্রফেসরকে শিক্ষা সচিব করলেন। শুরু হলো ভঙ্গুর ও অবহেলিত শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নের কাজ। কিন্তু নব্য স্বাধীন একটি দেশের চারদিকে অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ’৭৫ এ স্বপ্নদ্রষ্টার স্বপ্নকে মলিন করে দিলেন দেশ-বিদেশি ষড়যন্ত্র। অনিশ্চয়তায় পড়ল দেশ, পেছনে ফিরে গেল শিক্ষাব্যবস্থাও।

পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের কায়দায় আবার বেদখল হলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আজও সেই অবস্থায়ই আছে, বরং দিন দিন শিক্ষকদের হাত থেকে কেঁড়ে নেওয়া হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষার মান ও লক্ষ্যকে ঠিক করতে হাফ ডজন শিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও কারো পরামর্শকে তোয়াক্কা করা হয়নি। বর্তমান সরকারের সময়ে গৃহীত শিক্ষানীতির বয়স এক যুগ পার হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি তেমন কিছুই। সেখানেও শিক্ষকদের মর্যাদার কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা শুধু বক্তৃতা আর হাত তালির মধ্যেই নিপতিত আছে আজও।

প্রাথমিক শিক্ষা

প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে কাঁদা মাটিতে বীজবপন এবং তার পরিচর্যা করা। একে মৌলিক শিক্ষা (basic education) বলা হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় হচ্ছে জাতি তৈরির ফ্যাক্টরি। কোনো একটি জাতিকে তার কর্ণধারেরা কেমন দেখতে চান, তার প্রতিফলন ঘটে এখানে। তাই তো এই সেক্টরটা একটি দেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান। কিন্তু কী ভিশন নিয়ে এ দেশের প্রাথমিক শিক্ষা চলমান তা আমার কাছে একেবারেই অস্পষ্ট। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তাদের নিকট তার লক্ষ্য (goal) জানতে চাইলেই সেটির প্রমাণ পাওয়া যাবে। ভিশন না থাকায় এবং কার্যকরী প্রাথমিক শিক্ষার অভাবে একটা আদব বর্জিত জাতি তৈরি করছি আমরা। মৌলিক শিক্ষা (fundamental education) দিতে ব্যর্থ হয়েছি নতুন প্রজন্মকে, যার ফল ইতোমধ্যে পেতেও শুরু করেছি।

লাখ লাখ মেধাবীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে চাকরি পান প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। যদিও বিভিন্ন কোটার মাধ্যমেও তুলনামূলক কম মেধাবী সেখানে নিয়োগ পান। আবার গ্রাম্য মাতব্বরের তদারকিতে তৈরি কমিউনিটি বিদ্যালয় যা প্রি-প্রাইমারি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছিল। কোনো অদৃশ্য ইশারায় সেই কমিউনিটি বিদ্যালয়গুলোকে হঠাৎ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত করে দেওয়া হয়েছে। সেখানে নিয়োগপ্রাপ্ত মাতব্বরের আত্মীয় স্বজনেরাও হয়ে গেছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ফলে কয়েক লাখ লোকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চাকরিতে এসেছেন যারা, তাদের সঙ্গে মাতব্বরের নিয়োগ দেওয়া আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা ও শিখন পদ্ধতির যথেষ্ট প্রশিক্ষণ শিক্ষকদের না থাকায় প্রকৃত শিক্ষা পাচ্ছে না নতুন প্রজন্ম। যেখানে আমাদের প্রতিবেশী কলকাতায়ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের জন্য বিএড কোর্স বাধ্যতামূলক, সেখানে এ দেশে কোনোরকম দক্ষতা ছাড়াই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা চলছে।

মাধ্যমিক শিক্ষা

দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ মাধ্যমিক সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় সোয়া এক লাখ। অন্যদিকে স্নাতক পর্যায়ে পাঠদানের সরকারি প্রতিষ্ঠানও দেড় হাজারের অধিক। প্রতি উপজেলায় অন্তত একটি সরকারি কলেজ নিশ্চিত করেছে রাষ্ট্র।

তাহলে প্রতি উপজেলায় যদি একটি সরকারি কলেজ থাকতে হয়, তবে কয়টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকার দরকার? অথচ আঙ্গুল গুণে বলে দেওয়া যায় সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সংখ্যা। কলেজ সরকারি নিয়ে যে কূটরাজনীতি রয়েছে; তা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নেই সেজন্য এ খাতটি রাখা হয়েছে বেসরকারি তদারকিতে। দেশের ৯২ শতাংশ শিক্ষার্থীকে পড়তে হয় বেসরকারি বিদ্যালয়ে। এই সেক্টরের শিক্ষক নিয়োগ বা তাদের তদারকি সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল। যদিও সম্প্রতি এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের যাচ্ছেতাই নিয়মের লাগাম ধরার চেষ্টা চলছে। তবে যেভাবেই নিয়োগ হোক, এসব শিক্ষকের নেই উপযুক্ত কোনো প্রশিক্ষণ, নেই ভালো কাজে প্রণোদনা, নেই পদোন্নতি, নেই অনিয়মের কঠিন সাজা। গণতন্ত্রের নামে উদ্ভট ম্যানেজিং কমিটি দিয়ে চলছে এসব স্কুল। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, গ্রামের চা দোকানি বা ভবঘুরে হয়ে থাকেন স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি। প্রধান শিক্ষকের নাভিশ্বাস ওঠে সভাপতির ফেলে যাওয়া পানের পিক পরিষ্কার করতে। এভাবেই লক্ষ্যহীন কোমর ভাঙা শিক্ষা চলছে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায়।

উচ্চশিক্ষা

উচ্চশিক্ষায় পাঠদান ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সব সেক্টরের দেখভাল করার জন্য তৈরি হয়েছিল বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার। ক্যাডার কম্পোজিশন রুল ১৯৮০ এবং বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা ১৯৮১ অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থেকে সব কর্মকর্তার পদ বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের হওয়ার কথা থাকলেও সেসব পদ শিক্ষা ক্যাডারের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এসব নিয়ে একাধিক মামলা চলমান রয়েছে যুগের পর যুগ ধরে। তাছাড়া শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অধিদপ্তরগুলো (কারিগরি শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা), পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের প্রতিষ্ঠান এনসিটিভি, ব্যানবেইজ, শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রজেক্টের অধিকাংশ পদই শিক্ষা ক্যাডারের দায়িত্বে নেই।

হাজারো বঞ্চনা আর হতাশার মধ্যে প্রতিটি দিন অতিবাহিত করে শিক্ষা ক্যাডার সদস্যরা। চাকরিতে যোগদান করেই তাদের চোখে পড়ে অবহেলা। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ নিয়ে কর্মস্থলে প্রবেশ করেন অন্য সব ক্যাডার সদস্য, সেখানে শিক্ষা ক্যাডার সদস্যকে চাকরির চার বছর পরে প্রমোশনের জন্য অপরিহার্য ‘বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ’ এর জন্য আন্দোলন করতে হয়; যে সময়ে অন্য অনেক ক্যাডার সদস্য প্রমোশন পেয়ে যান। আবার একই সঙ্গে বিসিএস পরীক্ষা ও পদোন্নতির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এবং পদোন্নতির সব যোগ্যতা অর্জন করা সত্ত্বেও পদোন্নতি পান না শিক্ষা ক্যাডার সদস্যরা। দীর্ঘ ২১ বছর পরেও শিক্ষা ক্যাডার সদস্যদের প্রথম পদোন্নতির ইতিহাস রয়েছে।

ক্যাডার সার্ভিসে সর্বোচ্চ পদ ১ নম্বর গ্রেড; কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারকে আটকে দেওয়া হয়েছে ৪র্থ গ্রেডে। পদোন্নতি পেয়েও গ্রেড পরিবর্তন বা বেতন বৃদ্ধি হয় না শিক্ষা ক্যাডারের। আবার সম্মুখভাগে গ্রেড না থাকায় ’১৫ সাল থেকে বেতন ব্লক হয়ে আছে অনেক শিক্ষা ক্যাডার সদস্যের। ২০১৫ সালের পে-স্কেল এই ক্যাডারের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ ‘অধ্যাপক’ দুঃখজনক হলেও তারা ৪র্থ গ্রেডে চাকরি করেন। সিলেকশন গ্রেডের মাধ্যমে অল্প কয়েকজন অধ্যাপক ৩য় গ্রেড পেতেন। ১৫ এর পে-স্কেল সেটুকুও কেড়ে নিয়ে শিক্ষা ক্যাডারকে ৪র্থ গ্রেডে বেঁধে ফেলেছেন। এখন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ একই গ্রেডে বেতন পান। এমনকি জেলা পর্যায়ের শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অফিসের নন-ক্যাডার অনেকেই অধ্যক্ষের উপরের গ্রেডে চাকরি করেন। পে-স্কেল ঘোষণার সময়, পদ অবনমনের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলেও তা সঠিকভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে বোঝানো যায়নি, এমনকি সংবাদপত্রের মাধ্যমেও সঠিকভাবে উত্থাপিত হয়নি।

তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডে পদ সৃষ্টি ও পদোন্নতিতে সমতা সৃষ্টি সম্ভব হয়নি আজও। এমনকি ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করার নির্দেশনা দিয়েছেন কিন্তু অদৃশ্য কারণে এসবই অধরা রয়ে গেছে আজও। একইসঙ্গে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে এসে, অন্য অনেক ক্যাডার সদস্য শুরুতেই যতটুকু সুবিধা পান, শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যরা অবসরে যাওয়ার সময়েও সেই সুবিধা পান না। শিক্ষা ক্যাডারের কোনো সদস্যেরই নেই বাসা থেকে কলেজে যাওয়ার জন্য পরিবহন ব্যবস্থা। এমনকি অধ্যক্ষের জন্যও রাষ্ট্রের বরাদ্দ নেই কোনো গাড়ি। ফলে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আনা, উত্তরপত্র পাঠানো, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বা কর্মসূচিতে যাওয়ার জন্য ভ্যান, রিকশা, অটোরিকশা, পাবলিক বাস বা নিজস্ব পরিবহনের বিকল্প নেই শিক্ষা ক্যাডার সদস্যদের। কলেজের নিজস্ব ফান্ড থেকে গাড়ি কেনার নিয়ম থাকলেও তার অনুমতি মেলা ভার। মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে কোনো কোনো কলেজ হয়ত একটা গাড়ি কেনার অনুমতি নিয়ে গাড়ি ক্রয় করেছে।

ক্যাডার সার্ভিসে চাকরি করলেও ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্স-এ শিক্ষা ক্যাডারের অবস্থান কেউ জানেন না। তাই তো রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠানে তার ছাত্রের জন্য চেয়ার থাকলেও শিক্ষকের জন্য থাকে না কোনো চেয়ার। তাই ব্যক্তিত্ববান অনেক শিক্ষা ক্যাডার সদস্য রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলেন। ভোকেশনাল ডিপার্টমেন্টের দোহাই দিয়ে অর্জিত ছুটির সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয় শিক্ষা ক্যাডার সদস্যদের। শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান শিক্ষা অধিদপ্তরকে করা হয়েছে একটি ‘পোস্ট অফিস’, যাদের নেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো ক্ষমতা।

উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে রাজনৈতিক সূতিকাগার ও কেরানী তৈরির ফ্যাক্টরি। গবেষণা ছাড়া উচ্চশিক্ষা এখন উগান্ডায়ও নেই। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি চা সিঙ্গারার দাম নিয়ে মিথ্যাচার করলেও ছাত্রছাত্রীরা কেমন পরিবেশে, কেমন সিলেবাসে পড়াশোনা করছে তা নিয়ে টু শব্দ করেন না। বরং আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিংকে পরোয়া করেন না বলে বিবৃতি দেন। রাজনৈতিক বেড়াজালে আর পোষ্য অনিয়মের মধ্যে নিয়োগ এবং পদোন্নতির এমন অদ্ভুত সিস্টেম আর কোথাও চালু আছে কি না আমার জানা নেই। এমন হাজারো অনিয়মের মধ্যে পরিচালিত উচ্চশিক্ষা সেক্টরে সবচেয়ে বড় অশান্তির নাম লেজুড়বৃত্তির ‘ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি’— যা এখন সবার চোখের সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট।

আশার আলো এই যে, দেশের দুই/তিনটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করেছে। যদিও সেগুলোকে নষ্ট করতে ইতোমধ্যে সেসব স্থানে ছাত্ররাজনীতি চালুর প্রক্রিয়া চলছে, যা নিয়ে গত সপ্তাহে একটি জাতীয় পত্রিকা প্রতিবেদন ছাপিয়েছে।

শেষ কথা

এ দেশে শিক্ষকদের দেওয়া হয়নি ন্যূনতম সম্মান, আবার তাদেরকে তৈরিও করা হয়নি তাদের যোগ্যতার স্থানে। অনেক ছোট কাজেও একজন শিক্ষককে থানা শিক্ষা অফিস থেকে শুরু করে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত ঘুরতে হয়। অবসরে গিয়েও জীবদ্দশায় নিজের পেনশনের টাকা নিজের চোখে দেখতে পান না অনেকেই। এসব কারণে অনেক শিক্ষকের মধ্যেও তৈরি হয়েছে দায়িত্বহীনতা। এখন অনেকেই আর শিক্ষকতাকে ব্রত ভাবেন না। শুধুই একটা চাকরি মনে করেন। তাই অন্যান্য পেশার লোকদের মতো শিক্ষকদের অনেকেই জড়িয়ে পড়েছেন অপরাধের মধ্যে। দেশের অপরাধ জগতের মধ্যে শিক্ষকেরাও এখন প্রত্যক্ষ অংশীদার। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার নৈতিক সাহস শিক্ষকেরা ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। অথচ পাকিস্তানি দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে আঙুল তুলে সবচেয়ে বেশি প্রাণ দিয়েছিলেন এ দেশের শিক্ষকেরাই। ফলে সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আস্থা বা শ্রদ্ধাটুকু ছিল, তাও হারাতে বসেছে শিক্ষক সম্প্রদায়।

একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বহু মানুষের কাছে এখনো শিক্ষার আলোই পৌঁছায়নি। ৬-১০ বছর বয়সী ৩,৬৬,৮৮৫ জন শিশু এবছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে রয়েছে (সূত্র: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়)। আর যারা শিক্ষা গ্রহণ করেছে তাদের অধিকাংশই হয়েছে কাগুজে শিক্ষিত। স্নাতকোত্তর পাস করা ৪২ শতাংশ বেকার রয়েছে দেশে।

রাষ্ট্রীয় দূরদর্শিতা, আন্তরিকতা ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া লক্ষ্যভ্রষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা আর পশ্চাৎগামী শিক্ষক সমাজকে সামনে আনা সম্ভব নয়। ‘শিক্ষকরা জাতি গঠনের কারিগর,’ ‘শিক্ষকদের সম্মান সবার উপরে’, ‘শিক্ষকদের মানোন্নয়নে সবকিছু করা হবে’ - এমন সব মুখরোচক আর হাততালি মার্কা বক্তব্য দিয়ে শিক্ষক আর শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়। ভিশন, মিশন আর এসডিজি যাই বলুন, সব কাগুজে থাকবে যদি শিক্ষাকে সর্বজ্ঞে আনা না যায়। আর তা কেবলমাত্র সম্ভব শিক্ষকদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে এবং তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে। এ কথা বুঝতে জাতি যত দেরি করবে, দেশ তত পিছিয়ে থাকবে। দেশের তথা জাতির উন্নয়নে শিক্ষক তার যথাযোগ্য মর্যাদা পাবেন এবং জাতি গঠনে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন— বিশ্ব শিক্ষক দিবসে সেই প্রত্যাশা রইল।