১৯ জুলাই ২০২২। দেশব্যাপী এক ঘণ্টার পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দিয়েছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। কোথায়, কখন, কী পরিমাণ লোডশেডিং করা হবে, তার সূচিও ঠিক করে দেয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কথা ছিল ঢাকায় দিনে এক ঘণ্টা এবং ঢাকার বাইরে দুই ঘণ্টা করে লোডশেডিং হবে। প্রথম কয়েকদিন পরিস্থিতি ঠিকই ছিল। মানুষ সেটা মেনেও নিয়েছিল।

সময় যত গড়িয়েছে পরিস্থিতি ততই খারাপ হয়েছে। এখন মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বিদ্যুতহীন থাকতে হচ্ছে। সম্প্রতি আমি সিলেটের ভোলাগঞ্জ গিয়ে যে পরিস্থিতি দেখেছি তাতে মানুষ এখন বলে, তাদের এখানে বিদ্যুৎ যায় না, আসে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ না থাকাটাই এখন স্বাভাবিক।

এর মধ্যে ৪ অক্টোবর ২০২২, পূর্বাঞ্চলে গ্রিড বিপর্যয়ের কারণে অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের প্রায় সব জেলা। প্রায় ৮-১০ ঘণ্টার বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে চরম জনদুর্ভোগ দেখা দেয়।

সব ধরনের জরুরি সেবা ব্যাহত হয়েছে; রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হাসপাতালগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম চলতে পারেনি, বিদ্যুতের অভাবে রাজধানীর অফিস, বাসাবাড়ি-সর্বত্র পানি সংকট ছিল প্রকট।

সময় যত গড়িয়েছে পরিস্থিতি ততই খারাপ হয়েছে। এখন মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বিদ্যুতহীন থাকতে হচ্ছে...

সবচেয়ে দুর্ভোগের শিকার হন বহুতল ভবনের বাসিন্দারা। প্রায় অচল হয়ে পড়ে টেলিযোগাযোগ সেবাও। এখনো সেই ধাক্কা পুরোপুরি সামলে উঠা যায়নি বলেই শুনতে পাচ্ছি। 

২০১৪ সালে বিদ্যুতের গ্রিড বিপর্যয়ে ১২ ঘণ্টার জন্য সারাদেশে ব্ল্যাকআউট অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এবারের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে দেশের বিদ্যুৎ গ্রিডের সামগ্রিক অবস্থা ও নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিয়েছে।

আমরা শুনে আসছি দেশের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ডিজিটাল হয়েছে, তাহলে কেন সাথে সাথে গ্রিড বিপর্যয়ের স্পট ও কারণ চিহ্নিত হলো না এখনো?

এখন আর মফস্বলের মানুষ নয়, লাগাতার লোডশেডিং-এ নাকাল ঢাকা মহানগরের বাসিন্দারা। প্রতিদিনই দফায় দফায় লোডশেডিং হচ্ছে। আমরা সবাই দেখছি পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের ছিটেফোঁটা নেই। এলাকা ভেদে ৫ থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিং হচ্ছে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, সেপ্টেম্বরের পর থেকে লোডশেডিং কমবে। কিন্তু অক্টোবরে এসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে বলেই দেখছি আমরা।

যখন লোডশেডিং হয়, তখন বলা হয়েছিল কিছুদিন দেশবাসী কৃচ্ছ্রসাধন করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এরপরই সরকার জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিল। এতে সব শ্রেণির মানুষই, বিশেষ করে শহর ও গ্রামের নিম্ন আয়ের ও প্রান্তিক মানুষের কষ্ট বেড়েছে।

বড় শহরগুলোয় অ্যাপার্টমেন্ট, শপিং মল ও মার্কেটে লোডশেডিং হলে সেখানকার লোকজন জেনারেটর দিয়ে ডিজেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকেন। গ্রামাঞ্চলে সেই বিকল্প ব্যবস্থাও নেই।

আমরা শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আতশবাজি পুড়িয়ে উদযাপন করার কিছুদিনের মধ্যেই লোডশেডিং শুরু হলো। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল গ্যাস সংকটের কারণে অবস্থা খারাপ হয়। প্রয়োজনীয় গ্যাস বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

সম্প্রতি বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় স্পট মার্কেট থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এতে বিপুল টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়ে গেছে। বর্তমান দামে কিনলে যে পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হবে তা অসম্ভব। তার জন্য আপাতত গ্যাস আমদানি না করার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে।

বেশিরভাগ বিদ্যুৎ কেন্দ্র গ্যাস নির্ভর। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমাদের যে পরিমাণ গ্যাসের চাহিদা রয়েছে তার অর্ধেক আমাদের নিজস্ব গ্যাস। বাকিটা আমদানি করতে হয়। তাই বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম না কমা এবং দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহ না বাড়া পর্যন্ত এই সংকট নিরসন হচ্ছে না বলেই ধারণা করছি।

সংকট ব্যবস্থাপনায় বলা হয়, সংকট হবে না এমনটা ভাবাই সবচেয়ে বড় সংকট। আমাদেরও তাই হয়েছে। বিশ্ববাজার একইরকম থাকবে, এটা ভেবে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি, যার ফল ভোগ করছি আজ। সেটা করলে এখন এরকম ভোগান্তিতে পড়তে হতো না।

সংকট ব্যবস্থাপনায় বলা হয়, সংকট হবে না এমনটা ভাবাই সবচেয়ে বড় সংকট। আমাদেরও তাই হয়েছে। বিশ্ববাজার একইরকম থাকবে, এটা ভেবে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি, যার ফল ভোগ করছি আজ।

২০২৫ সালের মধ্যে ৩০ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সেটা আপাতত হবে বলে মনে হচ্ছে না।

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ ও গ্যাস পাওয়া না পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিতে পড়েছেন শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। বিদ্যুৎ বিভ্রাট বা অনিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ।

স্বয়ংক্রিয় মেশিনগুলো চালু অবস্থায় হঠাৎ বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে বন্ধ হলে পুরো সিস্টেমই নষ্ট হয়ে যায়। এতে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়ে। এই অবস্থায় শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে না পারলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও থমকে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা উৎপাদনে খরচ হয়েছে। অথচ বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থায় অগ্রগতি হয়নি উৎপাদনের সাথে তাল মিলিয়ে। সারাদেশেই বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনের অবস্থা বেহাল ও জরাজীর্ণ। দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ না হওয়ায় পুরোনো লাইন ওভারলোডেড হয়ে ঘন ঘন ট্রান্সফরমার জ্বলে যাওয়ার পাশাপাশি লাইন পুড়ে ও ছিঁড়ে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।

বলা হচ্ছে, দেশে মোট বিতরণ লাইনের অন্তত ৪০ শতাংশই জরাজীর্ণ। দেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতে যে ভয়ংকর দুর্নীতি ও অপচয় হচ্ছে, তা কমাতে পারলেও দেশবাসীকে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো না। বিদ্যুৎ খাতে সিস্টেম লসের নামে শত শত কোটি টাকার অপচয় হচ্ছে। এর জন্য যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা কখনো আমরা শুনিনি।

সরকার প্রধান পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের কথা বলেছিলেন। সেই অনুযায়ী সূচিও ঠিক হলো। কিন্তু কেন সেই সূচির ব্যত্যয় ঘটল এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষকে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় থাকতে হচ্ছে, তার তদন্ত হওয়া দরকার। দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।

শুধু সমস্যা অস্বীকার করে বা আশ্বাস দিয়ে জনগণের দুর্ভোগ ও অর্থনীতির ক্ষতি কমানো যাবে না। পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের কেন এমন ছন্নছাড়া অবস্থা হলো সেটা খুঁজে বের করাই উত্তম কাজ এখন।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি