সারা বিশ্বেই অর্থনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। কোভিড-উত্তর বিশ্ব অর্থনীতিতে একদিকে চাহিদা বেড়েছে (সব দেশেই প্রচুর প্রণোদনার অর্থ ঢালা হয়েছিল বলে এবং অনেক দিন পরে ব্যবসা-বাণিজ্য খুলে যাওয়ার কারণে) এবং অন্যদিকে সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়েছিল (তাই জাহাজ ভাড়া পাঁচ ছয় গুণ বাড়ে)।

সরবরাহ ঘাটতির কারণে আমদানি মূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ফেড) বাজার থেকে অর্থ শুষে নেওয়ার কৌশল হিসেবে উপর্যুপরি তার মৌলিক বা নীতি সুদের হার বাড়াতে থাকে। এরই মধ্যে ফেড তিন শতাংশের মতো নীতি সুদ বাড়িয়েছে। সুদের হার বাড়ার কারণে ডলার দামও বাড়ছে।

উন্নত বিশ্বে লাগাতার সুদ হার বাড়ানোর প্রভাব আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেও পড়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতসহ প্রায় সব দেশেই পলিসি রেট বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি এসব দেশের মুদ্রার মানের ব্যাপক অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে।

মূলত মার্কিন মুল্লুকে মূল্যস্ফীতি বাগে আনার জন্যই ফেড এমন আগ্রাসী মুদ্রানীতি পরিচালনা করছে। এর ফলে উন্নত দেশগুলোর মুদ্রার সম্মিলিত গড় দামের চেয়ে প্রায় শতকরা পনের ভাগ বেড়ে গেছে ডলার। তাই বাধ্য হয়ে ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যসহ সব ধনী দেশই তাদের পলিসি রেট বাড়াচ্ছে। কেননা তাদের মূল্যস্ফীতি নয়-দশ শতাংশে পৌঁছে গেছে।

উন্নত বিশ্বে লাগাতার সুদ হার বাড়ানোর প্রভাব আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশেও পড়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতসহ প্রায় সব দেশেই পলিসি রেট বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি এসব দেশের মুদ্রার মানের ব্যাপক অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে। ফলে আমাদের আমদানি খরচ ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। সেই তুলনায় আমাদের রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধি ততটা বাড়েনি। তাই বাণিজ্যিক ও চলতি হিসেবে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দেয়। আর সেই কারণে সার্বিক লেনদেনে বিরাট ফারাক তৈরি হয়েছে। এর প্রভাবে আবার আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে শুরু করে।

ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক এক বছরে প্রায় দশ বিলিয়ন ডলার বাজারে বিক্রি করেছে। এর ফলে বাজার থেকে সমপরিমাণের বাংলাদেশি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা হয়েছে। তাই কোনো কোনো ব্যাংকে তারল্য ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ব তেল ও গ্যাসের বাজারে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ যে কবে থামবে তা কেউ বলতে পারছেন না। এমনিতেই রাশিয়ার গ্যাস ও তেল পেতে ইউরোপসহ অনেক দেশেই সমস্যা হচ্ছে। কেননা রাশিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর নানা ধরনের স্যাঙ্কশন জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। তেল ও গ্যাসের বিশ্ব সরবরাহ কমে গেছে। এর মধ্যে আবার ওপেক ও আরও কয়েকটি দেশ সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রতিদিন দুই শতাংশ তথা বিশ লক্ষ ব্যারেল তেল উৎপাদন কমিয়ে দেবে। এখনই প্রতি ব্যারেল তেলের দাম নব্বই ডলারের মতো।

এই সিদ্ধান্তের পর তেলের সরবরাহ কমে যাবে বলে তার দামও বাড়বে বলেই মনে হয়। আর গ্যাসের বিশ্ব বাজার তো ইউরোপের চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জ্বালানি মূল্য এবং ডলারের বাড়ন্ত মূল্য আমাদের মতো আমদানি নির্ভর অর্থনীতির ওপর কতটা চাপ সৃষ্টি করবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

গ্যাসের বিশ্ব বাজার তো ইউরোপের চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে জ্বালানি মূল্য এবং ডলারের বাড়ন্ত মূল্য আমাদের মতো আমদানি নির্ভর অর্থনীতির ওপর কতটা চাপ সৃষ্টি করবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

তদুপরি বিশ্ব খাদ্য সংস্থা এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি হুশিয়ারি দিচ্ছে যে আগামী বছর বিশ্বজুড়েই ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে। চলতি বছর সারা বিশ্বেই যে জলবায়ু পরিবর্তনের উথালপাথাল দেখা গেছে তাতেই খাদ্য উৎপাদন নিয়ে এই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া বিশ্বের শস্য ভাণ্ডার বলে পরিচিত ইউক্রেন ও রাশিয়ায় যুদ্ধ চলতে থাকায় তাদের কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুদ্ধের কারণে খাদ্য পরিবহনেও সমস্যা হচ্ছে।

আমাদের মতো দেশে যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গম ও ভোজ্য তেলসহ অনেক খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। সরবরাহ পেতেও অসুবিধা হচ্ছে। এসবই আমাদের আমদানি মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর পেছনে কাজ করছে। আর এবছর আমাদের দেশসহ এই অঞ্চলে বর্ষাকালে বৃষ্টি হয়নি। তবে বর্ষাকালের শেষ প্রান্তে এসে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব আমন ফসলের ওপর পড়বে বলে মনে হয়।

জমিতে রস থাকবে বলে বোরো ধান উৎপাদনেও কম সেচ লাগবে। তা সত্ত্বেও বিশ্ব খাদ্য পরিস্থিতি মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছে না। সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাপক হারে কমে যাবে বলে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ তাদের অর্থনৈতিক আউটলুক বা প্রক্ষেপণে একাধিকবার বলেই চলেছে। আইএমএফ আশঙ্কা করছে আগামী বছর বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২.৯ শতাংশ হবে।

এসব কিছু বিবেচনায় নিয়েই আমাদের প্রধানমন্ত্রী ক’দিন আগে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন যে ২০২৩ সাল হবে মহামন্দার বছর। যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘ সফরের সময় তিনি অনেক রাষ্ট্রনায়ক ও বিশ্বসংস্থার প্রধানদের সাথে আলাপ করেছেন।

তারাও বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাসহ মূল্যস্ফীতির সংকট নিয়ে নিশ্চয় তার সাথে মত বিনিময় করেছেন। তাই তো তিনি এমন স্পষ্ট করে বিশ্ব মহামন্দার কথা বলেছেন।

এর আগেও তিনি বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষাবস্থা এবং তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের কথা খুবই সরাসরি বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ কোদালকে কোদাল বলার জন্য। বিশ্ব মহাসংকট যে ধেয়ে আসছে এই কথা দেশবাসীর কাছে প্রাঞ্জল ভাষায় বলার জন্য নিশ্চয় সাধুবাদ পেতেই পারেন।

সমস্যা স্বীকার করাও বিচক্ষণ নেতৃত্বের লক্ষণ। সেই কাজ তিনি খুবই দূরদর্শিতার সঙ্গে করেছেন। শুধু সমস্যার কথাই তিনি বলেননি। এই মহাসংকট কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন। উপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে বলেছেন।

আমাদের মতো করেই এই সমস্যা যে সমাধান করতে হবে সেই কথা বোঝার জন্য তিনি বলেছেন আমাদের কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যা যা দরকার তাই করতে হবে। কৃষি বাজেট তিনি আগেই বাড়িয়েছে। প্রয়োজনে অন্যত্র থেকে কৃষির জন্য বাড়তি বাজেট দিতেও তিনি প্রস্তুত রয়েছেন।

আর তার এই উচ্চারণ থেকেই বোঝা যায় যে আমাদের সংকট মোচনের বড় রক্ষা কবচের নাম কৃষি। কৃষি শুধু আমাদের খাদ্যই জোগান দেয় না, আমাদের কর্মসংস্থানের চল্লিশ শতাংশ এবং শিল্প খাতের কাঁচামাল ও চাহিদাও জোগায়। সেই কারণেই প্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরি মহাসংকটেও বাংলাদেশ তার কৃষি ও ছোটোখাটো উদ্যোক্তাদের ওপর ভর করে ঠিকই ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে। ১৯৯৮ সালের মহাবন্যার সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্মুখ সারির একজন যোদ্ধার মতো ত্রাণ কার্যক্রমই শুধু পরিচালনা করেননি, বন্যা পরবর্তী কৃষির পুনর্বাসনের জন্য কত উদ্যোগই না নিয়েছিলেন। এমনকি বর্গাচাষীরাও যাতে কৃষিঋণ পান তার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেজন্য হাটে বাজারে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের বুথ খোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারা ঋণ পেলেন তার তালিকা ইউনিয়ন পরিষদ অফিসসহ প্রকাশ্য জায়গায় টানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় ধানের চারা পরিবহনের জন্য সরকারি হেলিকপ্টার পর্যন্ত ব্যবহার করেছিলেন।

একইভাবে ২০০৯ সালেও দেখেছি বিশ্ব আর্থিক মন্দা মোকাবিলার জন্য কৃষি, এসএমই, প্রবাসী আয় এবং রপ্তানি শিল্পের বিকাশে উপযুক্ত নীতি সহায়তার ডালি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। উন্নয়নমুখী কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের এসব অন্তর্ভুক্তিমূলক উদ্যোগের জন্য সম্পূরক অর্থায়ন নীতিমালা গ্রহণ করেছিল।

হালের কোভিড-১৯ সংকট উত্তরণেও বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকার হাতে হাত রেখে জিডিপির ছয় শতাংশের মতো প্রণোদনা কর্মসূচি পরিচালনায় এগিয়ে এসেছে। এরই ধারাবাহিকতায় রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে তৈরি বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একদিকে ম্যাক্রো অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য নানা মাত্রিক উদ্যোগ নিচ্ছেন, অন্যদিকে এক ইঞ্চি জমিও যেন পতিত না থাকে সেই ধরনের মাইক্রো নীতির ওপরও জোর দিচ্ছেন।

ইতিমধ্যে ডলার সংকট মোকাবিলার জন্য বিনিময় হার খানিকটা নমনীয় করা হয়েছে। মনে হয় রপ্তানিকারক, প্রবাসীরা এবং আমদানিকারকদের জন্য একটি ব্যান্ডযুক্ত একক বিনিময় হার চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তা না হলে এই তিন অংশীজনের মাঝে ডলার মূল্য নিয়ে টানাপোড়েন বাড়ছে। অযথা স্পেকুলেশনও বাড়ছে। এর সুযোগ নিচ্ছে হুন্ডিওয়ালারা।

তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও বিএফআইউ’র যৌথ উদ্যোগে নিয়ন্ত্রণে আনতেই হবে। আর এলসি মনিটরিং আরও জোরদার করে ট্রেড ফাইন্যান্সিং এর মাধ্যমে অর্থ পাচারে ছিদ্রগুলো অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। চলমান মন্দা ও আগামী দিনের মহামন্দা মোকাবিলার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেসব উদ্যোগের কথা বলেছেন সেগুলোর প্রতি সমর্থন জানিয়ে আরও কিছু বাড়তি নীতি পরামর্শ দিতে চাইছি।

নীতি পরামর্শ—

এক. প্রধানমন্ত্রী যেমনটি বলেছেন কৃষিকেই আমাদের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সেজন্য যথোপযুক্ত বাজেটারি সহায়তা ছাড়াও সহজ শর্তে ঋণ, সম্প্রসারণ এবং মার্কেটিং সমর্থন দিয়ে যেতে হবে।

দুই. বঙ্গবন্ধু পুরস্কার পেয়েছেন যেসব কৃষক এবং যাদের নাম প্রস্তাব করা হয় সেগুলোর তথ্য ভাণ্ডার কৃষি মন্ত্রণালয়ে আছে। এরা আধুনিক কৃষক। এদের জন্য বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করা যায়।

তিন. সোলার সেচের বিকাশে আরও মনোযোগী হতে হবে। সরকার কৃষি যান্ত্রিকিকরণের জন্য যে ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছে সেখান থেকে সোলার সেচ প্রকল্পও অনুরূপ ভর্তুকি দেওয়া হোক। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া পঁচিশ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে কয়েক লক্ষ সোলার পাম্পের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

চার. গবেষণা ও উদ্ভাবন সমর্থনের পাশাপাশি কৃষির উন্নয়নের জন্য মার্কেটিং ও গুদামজাত করার জন্য ঋণ দেওয়া যায়।

পাঁচ. কৃষি পণ্যের জন্য ই-কমার্স উৎসাহ দেওয়ার অংশ হিসেবে ট্রেড লাইসেন্সবিহীন ছোট ঋণ মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো যেন ন্যানো ঋণ মডেলে দেয় তার নির্দেশনা বাংলাদেশ ব্যাংক দিতে পারে।

ছয়. আজকাল অনেক শিক্ষিত নারীও আধুনিক কৃষি উদ্যোগ নিচ্ছেন। তাদের জন্য আলাদা কিছু ঋণ ও রাজস্ব সুবিধার কথা নিশ্চয় ভাবা যায়।

সাত. কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের চালু করা স্টার্টআপ উদ্যোগ ত্বরান্বিত করা গেলে মন্দ হয় না। এবারের মন্দায় আমাদের কৃষি এবং ছোট উদ্যোগ প্রণোদিত করতেই হবে।

আট. কৃষিভিত্তিক শিল্পের প্রসারের পাশাপাশি কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর জন্য সব ধরনের নীতি সমর্থন দিতে হবে।

নয়. বদলে যাওয়া গ্রাম বাংলায় অকৃষি খাতের প্রসারের জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের হাতে প্রয়োজনীয় পুঁজি জোগান দিয়ে যেতে হবে। এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের গতি কতটা তা দেখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মনিটরিং জোরদার করতে পারে। এই কর্মসূচি যেন অব্যাহত থাকে সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

দশ. ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে ঋণ দিতে উৎসাহী করার জন্য সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছে। সোলার পাম্পও এই কর্মসূচির সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। তাহলে কৃষিতে বিনিয়োগের হার বাড়বে। প্রয়োজনে এই গ্যারান্টি স্কিমের জন্য বাজেটারি বরাদ্দ আরও বাড়ানো যেতে পারে।

আমাদের মতো দেশে যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গম ও ভোজ্য তেলসহ অনেক খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। সরবরাহ পেতেও অসুবিধা হচ্ছে। এসবই আমাদের আমদানি মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর পেছনে কাজ করছে।

এগারো. ন্যানো ক্রেডিট ও ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ডিজিটাল ফাইন্যান্সের আওতায় ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াই ঋণ দেওয়ার যে উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। আধুনিক কৃষি উদ্যোক্তাদেরও এই সুযোগ দেওয়া হোক।

বারো. কৃষির পরেই প্রবাসী আয় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় চালক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রাখছে। হালে নতুন করে অনেকেই প্রবাসী কর্মী হিসেবে বিদেশে যাচ্ছেন। এরা যাতে সহজেই উপযুক্ত রেটে তাদের বিদেশি আয় দেশে পাঠাতে পারেন সেদিকে নীতি সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো যেন তাদের ঠকাতে না পারে সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে হুন্ডির ক্ষেত্রগুলো উপড়ে ফেলার যে উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ হাতে নিচ্ছে সেগুলোর ব্যাপ্তি আরও বাড়াতে হবে।

তেরো. বড় আকারের প্রবাসী আয় দেশে আনার জন্য বিনিয়োগ বন্ড, ট্রেজারি বন্ডসহ নানাধরনের বিনিয়োগ যাতে সহজেই প্রবাসীরা করতে পারেন যে জন্য ডিজিটাল লেনদেনের যে উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে তা আরও সহজলভ্য করতে হবে। এই বিষয়ে যথেষ্ট তথ্যও প্রবাসীদের দিতে হবে। এনআইডি সম্পর্কিত জটিলতা এবং বন্ড রিনিউয়াল জটিলতা দ্রুত দূর করে প্রবাসীদের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে উৎসাহী করতে হবে।

চৌদ্দ. প্রবাসী কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে। তারা যখন ছুটিতে দেশে আসেন অথবা চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরেন তাদের জন্য বিশেষ দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ কর্মসূচি যুক্ত করার উদ্যোগ জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় নিতে পারে।

পনের. প্রবাসীদের যারা ওয়ার ট্রান্সফারের মাধ্যমে প্রবাসী আয় পাঠান এবং ফ্রিল্যান্সিং-এর অর্থ যারা দেশে আনেন তাদের কম রেটে ডলার বিক্রি করতে হয়। সকল বিদেশি আয়কারকদের একই হারে ডলার বিনিময় হার দেওয়ার জন্য যে দাবি উঠেছে তা আমার কাছে যুক্তিসংগতই মনে হয়। এই বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

ষোল. এরই কথা রপ্তানিকারকদের বেলাতেও খাটে। তারাই বা কেন কম রেটে ডলার বাঁচবেন। আমদানিকারকরাই বা বেশি দামে ডলার কিনবে। একটি বাজার নির্ভর বিনিময় হার সবার জন্য তৈরি করতেই হবে আমাদের। ভারত তো তা করতে পেরেছে। আমরা কেন পারব না?

সতেরো. এছাড়া আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বা আর্থিক সংস্থা খেকে কম সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ সংগ্রহে বাংলাদেশ যথেষ্ট পারদর্শিতা দেখাচ্ছে। গুণমানের প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি এনে এই ধরনের বিদেশি সহযোগিতা আরও বেশি বেশি সংগ্রহ করে যেতে হবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল আইএফএফের সাথে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জন্য দেন দরবার করছে। এক্ষেত্রে তাদের সাফল্য কামনা করছি।

আঠেরো. বাণিজ্যিক অর্থায়নের ওপর মনিটরিং বাড়িয়ে সহজেই বিদেশে অর্থ পাচারের ছিদ্রগুলো অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

এরকম আরও অনেক নীতি পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। সকল অংশীজনের সাথে বসে নিবিড় আলাপ করে নিয়মনীতি পর্যালোচনা করে নতুন করে স্মার্ট নীতি চালু করার সুযোগ নিশ্চয় আছে। এই সংকট কালে সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।

বাজারে প্যানিক ছড়ায় এমন কিছুই করা যাবে না। দীর্ঘদিন ধরে আমরা স্বকীয় দেশজ অনেক অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন নীতি কৌশল উদ্ভাবন করে চলেছি। পরীক্ষিত এসব নীতি কাঠামোর ওপর ভরসা করে হিসেব করে পা ফেললে নিশ্চয় চলমান মন্দা বা আগামী দিনে মহামন্দা মোকাবিলা করেই বাংলাদেশের উন্নয়নের সুনাম ধরে রাখতে পারবো। সেজন্য সকল অংশীজনের সাথে নিবিড় নীতি আলাপের সংস্কৃতি খুবই আন্তরিকতার সাথে গড়ে তুলতে হবে।

ড. আতিউর রহমান ।। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর