মশা নিয়ে আমাদের ভোগান্তি কমছেই না। এই বছর সিটি কপোরেশনগুলো বেশ উদ্যোগ ও আয়োজন গ্রহণ করলেও সফলতা যেন অধরাই থেকে গেছে। করোনা মহামারীর মধ্যেও মশা আমাদেরকে প্রচণ্ড বিরক্ত করেছে। এডিস মশা যথারীতি ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। শীতকালে মশার প্রাদুর্ভাব ছিল উল্লেখ করার মতো। বিগত দুই দশক ধরে মশা আমাদের দেশে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। ২০১৯ সালে মশার প্রাদুর্ভাব অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। মশা এখন ভয়ানক আতঙ্কেরও কারণ।

মশা থেকে পরিত্রাণ পেতে ব্যক্তিগত সচেতনতা ও সুরক্ষা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি সফল ও টেকসই মশা দমন ব্যবস্থাপনা। তাই গবেষণা নির্ভর সঠিক মশা দমন পদ্ধতি (সোর্স রিডাকশন, কীটনাশকের ব্যবহার, ব্যবহারের মাত্রা, সঠিক ব্যবহার-বিধি ইত্যাদি) অবলম্বন এখন সময়ের দাবি। না হয় কোটি কোটি টাকা খরচ করেও মশার সফল নিধন প্রায় অসম্ভব।

মশা নিধন কার্যক্রম মূলত সিটি কপোরেশনগুলোর উপর ন্যস্ত। তারা জনসচেতনতা বৃদ্ধি, লার্ভা ধ্বংসকরণ কার্যক্রম বরাবরের মতোই জোরদার রেখেছে আর মশা দমনের মূল কার্যক্রম হিসেবে এলাকায় এলাকায় রুটিন করে সকাল-বিকাল কীটনাশক (স্প্রেইং/ফগিং) প্রয়োগ করে আসছে। মূলত কীটনাশকই হচ্ছে মশা দমনের প্রধান হাতিয়ার। কীটনাশক ব্যবহারে আমাদের সঠিক পরিকল্পনা থাকা উচিত এবং এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

মূলত কীটনাশকই হচ্ছে মশা দমনের প্রধান হাতিয়ার। কীটনাশক ব্যবহারে আমাদের সঠিক পরিকল্পনা থাকা উচিত এবং এ বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

কীটনাশক বাছাইয়ে আমাদেরকে খুবই সর্তক হওয়া প্রয়োজন। লক্ষ্য করা গেছে, মশা দমনে আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার হয়ে আসছে। যার ফলে মশারা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। তাই প্রয়োগ তালিকায় নতুন ও কার্যকরী কীটনাশক (এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড) যোগ করতে হবে। পুরাতন ও একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার পরিহার করতে হবে। কীটনাশক বাছাই করার পূর্বে প্রথমে ল্যাব টেস্ট (টক্সিসিটি বায়োঅ্যাসে) করতে হবে। মশার লার্ভা দমনে (লার্ভিসাইডিং) বিশেষ গুরুত্ব, পর্যাপ্ত পরিমাণ লার্ভিসাইডিং এবং সঠিক, নিরাপদ ও কার্যকরী লার্ভিসাইড ব্যবহার করতে হবে। অনেক দেশেই লার্ভিসাইড হিসেবে বিটিআই (বেসিলাস থুরেনজিনেসিস প্রোডাক্ট : তরল/পাউডার) ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের দেশেও পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

সকলের অভিযোগ কীটনাশক প্রয়োগেও এখন মশা মরতে দেখা যায় না। বছরের পর বছর একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার, মাত্রাতিরিক্ত বা ভুল ডোজ প্রয়োগে মশা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে গেছে। কারণ মশার নিজস্ব একটা ক্ষমতা আছে। প্রতিকূল পরিবেশে বাঁচার জন্য মশা দেহের ফিজিওলজিক্যাল সিস্টেমের পরিবর্তন করতে প্রধানত সাইটোক্রোম পি-৪৫০ মনোঅক্সিজিনেজ এনজাইম তথা পি-৪৫০ জিন কে (কীটনাশক-প্রতিরোধী জিন) কাজে লাগায় এবং ধীরে ধীরে চরম প্রতিরোধী হয়ে ওঠে।

কীটনাশক দিয়ে এদেরকে আর সহজে দমন করা যায় না। সুতরাং মাত্রাতিরিক্ত ডোজ খুব ভয়ানক হতে পারে। তাই কীটনাশকের ভুল প্রয়োগ বা অতিপ্রয়োগ করা যাবে না। এ ব্যাপারে আরও সচেতন হতে হবে।

সকলের অভিযোগ কীটনাশক প্রয়োগেও এখন মশা মরতে দেখা যায় না। বছরের পর বছর একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার, মাত্রাতিরিক্ত বা ভুল ডোজ প্রয়োগে মশা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে গেছে।

কীটনাশক প্রয়োগের জন্য যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করবেন অর্থাৎ স্প্রে-ম্যানদের বিভিন্ন গ্রুপের কীটনাশক সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকতে হবে। মশার জীবন সম্পর্কেও তাদের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। স্প্রে-ম্যানদেরকে যথাযথ ট্রেনিং দিতে হবে। স্প্রে-ম্যানরা যেন শুধু শ্রমিক শ্রেণির লোক না হয়। শ্রমিক দিয়ে মশার কীটনাশক প্রয়োগ করা সঠিক হবে না।

তাছাড়া স্প্রে-সুপারভাইজার বা স্প্রে-ম্যানদেরকে এডিস-সহ অন্যান্য মশা (কিউলেক্স, এনোফিলিস ইত্যাদি) শনাক্তকরণের পাশাপাশি, টার্গেট ও নন-টার্গেটস প্রজাতির প্রাণী চিনতে হবে এবং এদের রক্ষারও ব্যবস্থা নিতে হবে। মশার লার্ভার বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে তাদের ধারণা থাকতে হবে।

কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার-বিধি তাদেরকে জানতে হবে ও মানতে হবে। কীটনাশক প্রয়োগের জন্য অত্যাধুনিক মেশিন ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে থারমাল ফগার মেশিন ছাড়াও উন্নতমানের মেশিন যেমন: আলট্রা লো ভলিউম স্প্রেয়ার (ইউ্এলবি স্প্রেয়ার) ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া যে সময় কীটনাশক প্রয়োগ করা হবে সেইসময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিণত মশা মারতে গভীর রাতে বা ভোরে (রাত ১১ টা-ভোর ৬ টার মধ্যে) এডাল্টিসাইড প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

কীটনাশক প্রয়োগের পর ঠিকমতো কাজ করছে কি না অর্থাৎ লার্ভা বা পরিণত মশা মরছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কীটনাশকের কার্যকারিতা মনিটরিং করতে হবে। মাঠপর্যায়ে কোনো কীটনাশক ঠিকমতো কাজ না করলে তা পরিবর্তন করে নতুন কার্যকরী কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

বর্তমানে সিটি কপোরেশনগুলো মশা দমনে ব্যবহৃত কীটনাশক ক্রয় করে থাকে। প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার কীটনাশক ক্রয় করা হয়। কীটনাশক ক্রয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত থাকার কথা শোনা যায়। তবে যেভাবেই ক্রয় করা হোক না কেন, লক্ষ্য রাখতে হবে কীটনাশক যাতে ভেজাল না হয়। মশা দমন একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ পাবলকি হেলথ ইস্যু, তাই এক্ষেত্রে কোনো অবহেলা করা ঠিক হবে না।

মশা নিধনে বর্তমানে কীটনাশক ছাড়াও বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল যেমন: ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহার (স্ত্রী মশার উর্বর ডিম উৎপাদন ব্যাহত করে), স্টেরাইল ইনসেক্ট টেকনিক (মশার ডিম উৎপাদন ব্যাহত করে), মশক প্রিডেটরস যেমন- মশক মাছ (গাপ্পি, গ্যামবুসিয়া) ইত্যাদির বাণিজ্যিক ব্যবহার বিদেশে প্রচলিত আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সময় ও কার্যকারিতা বিবেচনায় কীটনাশকই ব্যবহার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। বলতে গেলে এর বিকল্প এখনো পাওয়া যায়নি। যদিও ইনটিগ্রেটেড মসকিটো ম্যানেজমেন্ট (আইএমএম) অনুসারে কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে সর্বশেষ টুলস। তাই কীটনাশক ব্যবহারে উল্লেখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখলে কীটনাশকের সফল ও কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা যাবে। মশা দমন হবে এবং আমাদের মশা দমন (অপারেশন) ব্যবস্থারও আধুনিকায়ন হবে।

ড. মো. আসাদুজ্জামান মিয়া ।। কীটতত্ত্ববিদ; সায়েনটিস্ট, এনাসটাসিয়া মসকিটো কন্ট্রোল, সেন্ট অগাস্টিন, ফ্লোরিডা, আমেরিকা

mamiah81@yahoo.com