ছবি : সংগৃহীত

প্রতিবন্ধীদের নিয়ে পরিহাস নয়, তাদের 'দিব্যাঙ্গ' নামে অবিহিত করুন। আধুনিককালে মানুষ উন্নত দেশ থেকে শিক্ষা নেয়। কিন্তু মানুষ যতই আধুনিক হচ্ছে, ততই তার মধ্যে কৃত্রিমতা, অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর সাথে আরেকটি বিষয় হচ্ছে, তা লোক দেখানো হলেও, মানুষের মনুষ্যত্ব বোধও বাড়ছে।

আগের মতো কাউকে দেহের অক্ষমতাসহ বিভিন্ন প্রকারের অক্ষমতা চিহ্নিত করে সংকীর্ণতা পূর্ণ ভাষা ব্যবহার করা হয় না। সমাজের সাথে সাথে মানুষের মানবিক বোধ এবং ভাষাও পরিবর্তিত হচ্ছে, আগে শারীরিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধীদের নিজেদের সমস্যা অনুযায়ী অন্ধ, লেংড়া, কানা, খোঁড়া বলে অভিহিত করা হতো।

বর্তমানে এই অমানবিক নিষ্ঠুর শব্দগুলো সচরাচর ব্যবহার করা হয় না। বর্তমানে কেউ যদি শারীরিকভাবে অক্ষম হয়, তবে তার শারীরিক অক্ষমতা নির্দেশ করে এমন শব্দে অবিহিত না করে তাকে প্রতিবন্ধী বলা হয়।

আরও পড়ুন : শৈশব ও খেলার মাঠ 

যেমন কেউ যদি চোখে দেখতে না পায়, তবে তাকে পূর্বের মতো অন্ধ না বলে বর্তমানে 'দৃষ্টি প্রতিবন্ধী' নামে অবিহিত করা হয়। একইভাবে কেউ যদি অস্বাভাবিক আচরণ করে, তবে পূর্বের মতো উন্মাদ, বদ্ধ উন্মাদ, পাগল ইত্যাদি নামে অবিহিত না করে তাকে 'বুদ্ধি প্রতিবন্ধী' বলা হয়।

ইদানীং প্রতিবন্ধী শব্দটি ব্যবহার না করে কেউ কেউ আরও মানবিক দৃষ্টিতে সব প্রতিবন্ধীদের জন্য 'দিব্যাঙ্গ' শব্দটি ব্যবহার করছে। দৈব কারণে সে শারীরিকভাবে অসুস্থ, তাই তাকে দিব্যাঙ্গ বলা হয়। যদিও দিব্যাঙ্গ শব্দটি একটি নতুন শব্দ। শব্দটি ভারতবর্ষের বাঙালির ক্ষেত্রে পরিচিত হলেও, বাংলাদেশে আপাতত শব্দটি জনপ্রিয় নয়। 

শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী, পাগল, অসুন্দর, দরিদ্র এবং দুর্বলদের নিয়ে কোনো পরিহাস করা উচিত নয়। আমাদের বুঝতে হবে, যেকোনো পরিস্থিতিতে আমরা তথাকথিত সুস্থ মানুষও এমন অস্বাভাবিক হয়ে যেতে পারি।

দিব্যাঙ্গ শব্দটি দেশে জনপ্রিয় হলে যথাযথ হয়। কারণ শব্দটি অত্যন্ত যৌক্তিক। এর মধ্যে কোনো অক্ষমতা বা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের মাধ্যমে ছোট করার বিষয় নেই।

শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী, পাগল, অসুন্দর, দরিদ্র এবং দুর্বলদের নিয়ে কোনো পরিহাস করা উচিত নয়। আমাদের বুঝতে হবে, যেকোনো পরিস্থিতিতে আমরা তথাকথিত সুস্থ মানুষও এমন অস্বাভাবিক হয়ে যেতে পারি।

আরও পড়ুন : শিক্ষার সংকটের একটি দিক 

ভাবতে অবাক লাগে, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে পরিহাস না করতে; মানসিক অসুস্থকে পাগল না বলতে; দরিদ্র ও অসুন্দরদের নিয়ে নিন্দা না করতে—মানবিক বিধানগুলো মহাভারতে পাঁচ হাজার বছর পূর্বেই দেওয়া আছে। বিষয়গুলো আজ বৈশ্বিক মানবিক মূল্যবোধের অংশ। এই প্রসঙ্গে মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বলা হয়েছে—

“হীনাঙ্গানতিরিক্তাঙ্গান্ বিদ্যাহীনান্ বিগর্হিতান্। 
রূপদ্রবিণহীনাংশ্চ সত্ত্বহীনাংশ্চ নাক্ষিপেৎ।।”
(মহাভারত : অনুশাসন পর্ব, ৯১.৩৪)

"হীনাঙ্গ, অতিরিক্তাঙ্গ, বিদ্যাহীন, অত্যন্ত নিন্দিত, শ্রীহীন কদাকার, নিঃস্ব ও দুর্বল ব্যক্তিদের নিয়ে নিন্দা বা পরিহাস করবে না।"

বিষয়টি স্মৃতিশাস্ত্রেও বিশেষ করে মনুসংহিতাতেও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—

“হীনাঙ্গানতিরিক্তাঙ্গান্ বিদ্যাহীনান্ বয়োঽধিকান্।
রূপদ্রব্যবিহীনাংশ্চ জাতিহীনাংশ্চ নাক্ষিপেৎ।।”
(মনুসংহিতা : ৪.১৪১)

"যারা হীনাঙ্গ (অর্থাৎ যাদের কোনো অঙ্গের হীনতা আছে—যেমন, কানা, খোঁড়া ইত্যাদি), অতিরিক্তাঙ্গ (অর্থাৎ যাদের অঙ্গের আধিক্য আছে, যেমন, হাতে বা পায়ে ছয়টি আঙ্গুল আছে), যারা বিদ্যাহীন, যারা ‘বয়োধিক’ অর্থাৎ অত্যন্ত বৃদ্ধ, যারা রূপহীন (অর্থাৎ যাদের অঙ্গ-সন্নিবেশ বিকৃত, যেমন টেরা প্রভৃতি), যারা ধনহীন এবং জন্মপরিচয়হীন—তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ বা নিন্দা করবে না।"

আরও পড়ুন : সৃজনশীল ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষাব্যবস্থা কেন জরুরি?

মহর্ষি মনু, মনুসংহিতার চতুর্থ অধ্যায়ে শুধু প্রতিবন্ধী বা দিব্যাঙ্গদের নিয়ে ব্যঙ্গ বা নিন্দা করতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু শাস্ত্রের এই নিষেধ বাক্য পালন না করে যারা প্রতিবন্ধী বা দিব্যাঙ্গদের নিয়ে উপহাস করে তাদের তিনি কমপক্ষে এক কার্ষাপণ অর্থদণ্ড বিধান করেছেন—

“কাণং বাপ্যথবা খঞ্জমন্যং বাপি তথাবিধম্।
তথ্যেনাপি ব্রুবন্ দাপ্যে দণ্ডং কার্ষাপণাবরম্।।”
(মনুসংহিতা : ৮.২৭৪)

"কানা, খোঁড়া অথবা ঐ প্রকার বিকলাঙ্গ ব্যক্তিকে কেউ যদি বিদ্রূপ করে কানা, খোঁড়া বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে তবে কমপক্ষে এক কার্ষাপণ অর্থদণ্ড বিধান করতে হবে।"

বর্তমান ভোগবাদী সমাজে আমাদের চাওয়া পাওয়ার অন্ত নেই। সব চাওয়া পাওয়া যখন পূর্ণ হয় না, তখন তা কেন্দ্র করে আমাদের দুঃখেরও অন্ত নেই।

একথা মনে রাখতে হবে যে, প্রতিবন্ধী মানেই প্রতিভাবন্ধী নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রতিবন্ধী মানুষের কোনো না কোনো অনন্য বিশেষ গুণ থাকে।

এই প্রসঙ্গে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের 'দুঃখের তুলনা' নামে একটি বিখ্যাত কবিতা রয়েছে। কবিতায় বলা হয়েছে, একদা এক ব্যক্তির পায়ে জুতা না থাকায় দুঃখ, বেদনা এবং ক্ষোভের অন্ত ছিল না। সেই ব্যক্তিই একদিন এক ভজনালয়ে গিয়ে দেখতে পেলেন যে, এক ব্যক্তির দুই পা নেই। তখন তিনি বুঝতে পারলেন, জগতে কত মানুষ যে এভাবে শারীরিক মানসিক অক্ষমতা সাথী করে দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে আছেন, এর শেষ নেই।

আরও পড়ুন : শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ 

সর্বদা নিজেকে নিয়ে যারা ব্যস্ত থাকেন তারা অন্যের দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করতে পারেন না। কিন্তু পরের দুঃখ-কষ্ট, অভাব এবং অক্ষমতা চিন্তা করলে, নিজের অভাব ক্ষোভ সবই দূর হয়ে যায়। কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের ভাষায়—

“একদা ছিল না ‘জুতো’ চরণ-যুগলে
দহিল হৃদয় মম সেই ক্ষোভানলে।
ধীরে ধীরে চুপি চুপি দুঃখাকুল মনে,
গেলাম ভজনালয়ে ভজন কারণে !
দেখি তথা এক জন, পদ নাহি তার,
অমনি ‘জুতো’র খেদ ঘুচিল আমার,
পরের অভাব মনে করিলে চিন্তন
নিজের অভাব ক্ষোভ রহে কতক্ষণ?”

প্রত্যেক দিব্যাঙ্গ বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দুঃখ-কষ্ট নিজের মতো করে না দেখে অসহায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির দৃষ্টিতে দেখতে হবে। তবেই মানুষ তাদের বেদনা উপলব্ধি করতে পারবে। তখন আর তাদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে কেউ হাসি ঠাট্টা করবে না।

আরও পড়ুন : মাধ্যমিকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য পাঠ : চ্যালেঞ্জ ও করণীয় 

একথা মনে রাখতে হবে যে, প্রতিবন্ধী মানেই প্রতিভাবন্ধী নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রতিবন্ধী মানুষের কোনো না কোনো অনন্য বিশেষ গুণ থাকে।

হয়তো একটি অঙ্গ তার অক্ষম। কিন্তু অন্যান্য অনেক বিষয়ে সে অনেকের চেয়ে আগানো। তাই তাদের উদ্দেশ্যে আপত্তিকর ভাষা প্রয়োগ না করে, তাদের যথাসাধ্য প্রোৎসাহিত করতে হবে। যেন তারা সমাজের তথাকথিত সক্ষমদের ভিড়ে হারিয়ে না গিয়ে, অসম জীবন যুদ্ধে জয়ী হতে পারেন।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়