বিশিষ্ট অটিজম বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদের জন্মদিন আজ। ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর মা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাবা বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সায়মা ওয়াজেদ। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় নাতনী। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সূত্রেই তিনি যে আমাদের পরিচিত তা কিন্তু নয়। ইতোমধ্যেই তিনি বিশ্বে সাড়া ফেলেছেন একজন সমাজসেবী হিসেবে এবং অটিজম আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে।

সায়মা ওয়াজেদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি, ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং ২০০৪ সালে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির ওপর বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় তিনি বাংলাদেশের নারী উন্নয়নের ওপর গবেষণা করেন। এ বিষয়ে তার গবেষণাকর্ম ফ্লোরিডার একাডেমি অব সায়েন্স শ্রেষ্ঠ সায়েন্টিফিক উপস্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। 

বাংলাদেশসহ বিশ্বের অবহেলিত পশ্চাৎপদ প্রতিবন্ধী শিশুদের তিনি টেনে তুলে নিয়ে এসেছেন আলোর জগতে। কিছুদিন আগেও এই রোগে ভোগা কোমলমতি শিশুদের আমরা অবহেলায় দূরে ঠেলে ফেলে দিতাম। এখন সেই ভাবনাটা অনেকটাই কমে গেছে। অটিজমের কারণে অবহেলার ছেদ টানেন সায়মা ওয়াজেদ । তার সুদূরপ্রসারী কল্যাণীমূলক  চিন্তা-ভাবনা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশে ‘নিউরোডেভেলপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি ট্রাস্ট অ্যাক্ট ২০১৩’ পাস করা হয়।

সায়মা ওয়াজেদের প্রচার-প্রচারণা আমাদের প্রচলিত সমাজের ভিত্তিমূলে আঘাত হানে। আর সেটা হলো অটিস্টিক হওয়া মানে তারা সমাজের বোঝা নয়। হয়তো আচরণের কারণে তারা সমাজ থেকে কিছুটা আলাদা। তাদের সামাজিক মেলামেশা অন্য আট-দশ জনের মতো নয়। তবে তারাও ক্রিয়েটিভ চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। পৃথিবীতে এমন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন যারা কিন্তু এই অস্বাভাবিকের দলেই পড়েন। ইদানিংকালে মনোবিদ গবেষকরা জেনেছেন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, লেখক লুইস কারল, ভাস্কর্য শিল্পী মিকেলাঞ্জেলো প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিরাও স্বাভাবিক ছিলেন না। হয়তো ইতিহাসের পাতায় এ রকমের আরও অনেকের নাম খুঁজে পাওয়া যাবে। সুতরাং প্রচলিত অর্থে আমরা যেটা বুঝি অটিস্টিক কিংবা আচরণ অন্যরকম হলেই যে সে একেবারে অক্ষম, এই ধারণা ভ্রান্ত এবং ভুল। 

অটিজম বিশেষজ্ঞ সায়মা ওয়াজেদ অটিস্টিক শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তার কাজের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও শুরু হয়েছে। ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সায়মা ওয়াজেদকে এক্সিলেন্স ইন পাবলিক হেলথ অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হয়ে শুভেচ্ছা দূত হিসেবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় কাজ করছেন। মানসিক স্বাস্থ্য ও অটিজমের বিষয়টি তার প্রচেষ্টাতেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যাবলীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ কারণে আমরা দেখি সমাজে এখন অটিজম সচেতনতা অনেক বেড়েছে। এই বছরেও অটিজম সচেতনতার প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘এমন বিশ্ব গড়ি, অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ব্যক্তির প্রতিভা বিকশিত করি।’ 

অটিজম হলো একটি অন্য ধারার জীবনবোধ। অন্য ধারার কথাটাও ঠিক নয়। অটিস্টিক মানুষেরা প্রতি মুহূর্তে এমন কিছু শিখিয়ে যায়, যা আসলে আমাদের স্বাভাবিক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা সেই স্বাভাবিকের চেয়ে এতই দূরে চলে এসেছি যে, ওদের ‘অস্বাভাবিক’ বলে থাকি। ‘অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার’ আছে যাদের, তাদের অনেকগুলো স্তর থাকে। যেমন কেউ অল্প কথা বলে। কেউ একেবারেই কথা বলে না। কারও সামাজিক যোগাযোগ একেবারেই নেই, বা কেউ সেটা করতে পারে না। এই অটিজম আক্রান্তদের কল্যাণে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠান সায়মা ওয়াজেদকে ইন্টারন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। 

উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান সিমা কলাইনু জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নিউ ইয়র্কের ৫টি বোরোর সব সম্প্রদায়ের অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত সহস্রাধিক শিশুকে তাদের অটিজম সেন্টার, স্কুল এবং হোম সার্ভিসের সেবা দিয়ে আসছে। এই পুরস্কার প্রাপ্তিতে ওই সময় সায়মা ওয়াজেদ বলেছিলেন, অটিজম সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সিমা কলাইনুর এই স্বীকৃতির জন্য আমি সম্মানিত বোধ করছি। অটিজম সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সিমা কলাইনুর মতোই বাংলাদেশ ও এশিয়া অঞ্চলে এ সংক্রান্ত পেশার মানুষের জন্য পরিকল্পিত এবং ব্যাপকভিত্তিক প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টিতে আমি কাজ করছি। অটিজম কোনো ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং আর্থ-সামাজিক সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ নয়। এ কারণেই এর জন্য বিশেষ ধরনের সেবা ও কর্মসূচি প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একজন শুভেচ্ছা দূত হিসেবে অটিজম নেটওয়ার্ক নিয়ে আমি সবার সঙ্গে কাজ করতে চাই। 

অটিজম আক্রান্ত শিশু থেকে সমাজ মুখ ফিরিয়ে নেয়। আত্মকেন্দ্রিক সমাজে যেখানে এখন শুধুই নিজের সন্তানের চিন্তা-ভাবনা নিয়েই ব্যস্ত, সেখানে সায়মা ওয়াজেদ অটিস্টিক বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করে দেখালেন সকল সন্তানই আমাদের। এমন কি সে যদি অস্বাভাবিকও হয়। বঙ্গবন্ধু পরিবারের উত্তরসূরী হওয়ার কারণেই তাঁর এমন উপলব্ধি। এ বছরের এপ্রিল মাসে ‘ প্রাচীর পেরিয়ে, স্টিফেন শোর- এর আত্মজীবনী ও অটিজম নিয়ে সায়মা ওয়াজেদের সাথে আড্ডা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি  বলেন,  ‘অটিজম আমাদের সমাজেরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাতীয় পর্যায়ে এ ধরনের একটা সচেতনতা তৈরি করা গেছে। তাদের (অটিজমে আক্রান্ত) আরও সুযোগ করে দেওয়া উচিত। তাদের জন্য আরও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা উচিত। এটা এখন সবাই বুঝতে পেরেছে।’

অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের সঠিক চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা এখন গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। এর পেছনেও রয়েছে সায়মা ওয়াজেদের বিশাল ভূমিকা। বাংলাদেশে এখন নানামুখি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বছরের অটিজম সচেতনতা দিবসে যেমনটা বলেছেন: ইতোমধ্যে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী (এনডিডি) সুরক্ষা ট্রাস্ট অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তির গৃহভিত্তিক পরিচর্যা ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়ার জন্য কোভিড পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ৫৩টি জেলার ১৯০টি উপজেলার ৩৯০ জন মাতা-পিতা/অভিভাবককে অনলাইন প্রশিক্ষণ দিয়েছে। একই সঙ্গে ৬০টি জেলার ১০৫টি উপজেলার ১১৫টি বিদ্যালয়ের ৪৫০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং এটি চলমান প্রক্রিয়া। ‘বলতে চাই’ ও ‘স্মার্ট অটিজম বার্তা’ নামক দুটি অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয়েছে। সহায়ক প্রযুক্তি হিসেবে ‘বলতে চাই’ অমৌখিক যোগাযোগ সহজীকরণ করবে। শিশুর অটিজম আছে সন্দেহ হলে সহজেই ‘স্মার্ট অটিজম বার্তা’ অ্যাপ দ্বারা ঘরে বসেই অটিজম আছে কি না তা জানা যাবে। এনডিডি সুরক্ষা ট্রাস্টের আওতায় এ বছরই ১৪টি উপজেলায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে ‘অটিজম ও এনডিডি সেবাকেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।  

বাংলাদেশে অটিজমের ক্ষেত্রে এই যে পরিস্থিতি বদলানো, তার পেছনে সায়মা ওয়াজেদের ‘সূচনা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে’র ভূমিকা রয়েছে। এই সংস্থা  মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে এবং প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে মানবতার সেবায় কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিবন্ধীরাও যে মানব সম্পদে যুক্ত হতে পারে এবং তাদের আলাদা বলার আর প্রয়োজন নেই সেই চেষ্টা তিনি করছেন ২০০৮ সাল থেকে। তার কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি জাতিসংঘের অটিজম সচেতনতা দিবসে বিশেষজ্ঞ হিসেবে বক্তৃতা করে আসছেন সেই ২০১২ সাল থেকে।

অটিজম এবং সেই সম্পর্কিত নানা সমস্যাকে একসময়ে প্রতিবন্ধকতা ভাবা হতো। কিন্তু এখন আর তেমনটা নয়। ফলত সামাজিক দায়ভার বহন করার উদ্দেশ্যে আরও বহু নিয়োগকর্তা চাইছেন অটিজম জাতীয় সমস্যাসহ মানুষদের স্বাভাবিক, সাধারণ কর্মক্ষেত্রে কাজের সুযোগ করে দিতে। এছাড়া আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রামগুলোতে বা অনেক শুভেচ্ছা কার্ডে অটিস্টিক বাচ্চাদের আঁকা কার্ড পাই। তখন মনে খুব আনন্দ জেগে ওঠে। কখনও কখনও মিডিয়ায় এই বাচ্চাদের প্রতিভার অনুষ্ঠান দেখতে পাই। তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি তাদের নতুন মুহূর্তের সৃষ্টিগুলোকে। সমাজকে তখন বলতে ইচ্ছে করে ওই যে বাচ্চারা আনন্দ করছে, নতুন কিছু দেখানোর চেষ্টা করছে সেটা তো আর অস্বাভাবিক নয়, স্বাভাবিক। খুবই স্বাভাবিক। আমাদের এই যে নতুন করে চিন্তা-ভাবনার যিনি খোরাক জুগিয়েছেন, তিনি সায়মা ওয়াজেদ। এই প্রচেষ্টারই জন্য এরই মধ্যে সায়মা ওয়াজেদ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের ১০০ জনের তালিকায় নিজের স্থান করে নিয়েছেন। 

বাংলাদেশেও প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশের পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সায়মা ওয়াজেদ এক ইতিবাচক পরিবর্তনের বাতিঘর। এমন এক মহতী মহীয়সীর জন্মদিনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা। তার এই জন্মদিনে তাকে তুলনা করা চলে অরুন্ধতী নক্ষত্রের সঙ্গে। অরুন্ধতী নক্ষত্রকে আকাশের অন্ধকারে খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়; নক্ষত্র খচিত আকাশের দিকে তাকালেই নজরে পড়বে জ্বলজ্বলে তারাগুলোর পাশে অরুন্ধতীকে। তিনিও ঠিক অটিজম বা পিছিয়ে থাকা শিশুদের আকাশে বাঙালির অরুন্ধতীর মতো। বিশ্বের সকল দেশের প্রতিবন্ধী শিশুদের পরিপূর্ণ করার প্রতিবন্ধকতা জয় করে আপনি এগিয়ে যান । আপনার দেখানো পথে জরাগ্রস্ত অতীতকে পেছনে ফেলে প্রতিবন্ধী শিশুদের নবতর পৃথিবী সৃষ্টির উন্মাদনায় হয়ে উঠবে আনন্দমুখর। তারা সৃষ্টি করবে প্রাণোচ্ছল এক নতুন জগৎ।

লেখক :  ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম, অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 

এনএফ