একটা বড় এবং আলোচিত সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন শেষে বিদায় নিলেন প্রশাসনিক ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা ইকবাল মাহমুদ। বিদায় বেলায় বলেছেন, ‘জনগণের আস্থার প্রতিদান সেভাবে দিতে পারিনি। আমি চেষ্টা করেছি। তবে একটি বার্তা দিতে পেরেছি যে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’

মানুষের কাছে কি বার্তা তিনি দিয়ে যেতে পেরেছেন সেটা সময়ই বলবে। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, দেশের সাধারণ মানুষ, ছোট-বড় সব শহরের মানুষ, সমাজে বিরাজমান সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে বিষণ্ণ রয়েছেন। 

প্রতি বছর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশাল দুর্নীতির যে ধারণা সূচক প্রকাশ করে, সেখানে দেখা যায় দুর্নীতির নিরিখে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ উপরের দিকেই থাকছে। গণমাধ্যমের রিপোর্ট, দুদকের তদন্ত, সরকারের নানা প্রচেষ্টায় বোঝা যায়, দুর্নীতি রোধের আইনি ব্যবস্থা দুর্নীতি কমাতে পারছে না। 

আমরা একটা জিনিস বুঝি যে, অফিস আদালতে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ আসে সেগুলোর বড় একটা অংশই বিচারযোগ্য নয়, কারণ এগুলো আদালত অবধি গড়ায় না। তাহলে বলা যায়, বিভাগীয় তদন্ত ভালো হলে সেসব দুর্নীতি কমানো সম্ভব। সেটা কতটা সুনীতির সাথে হয় সে এক বড় প্রশ্ন বটেই।

সরকারি স্তরে মন্ত্রী এবং আমলারা, এমনকি যারা নিজেরা দুর্নীতিগ্রস্ত নন, তারাও মূলত যেটা করেন, তা হলো দৈনন্দিন দুর্নীতিকে ধামাচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা।

ইকবাল মাহমুদের এই সময়টায় দুদকে প্রচুর অভিযোগ জমা হয়েছে, বহু মানুষকে ডাকা হয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি, দুর্নীতির বিচারযোগ্য অভিযোগের খুব কমই নথিভুক্ত হয়, তারচেয়েও কম হয় চার্জশিট দাখিল এবং নিশ্চিতভাবে শাস্তি হয় নিতান্ত কম। কতদিন বিচার চলে বা শাস্তির বহর কতটা, সে বিষয়ে যথেষ্ট তথ্যই শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় না।

‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়’ – এমন বার্তা দুদকের বিদায়ী চেয়ারম্যানকে পুলকিত করলেও দেশের আমজনতা এসব বিশ্বাস করেনা। বরং তাদের বদ্ধমূল ধারণা, বড় দুর্নীতিবাজদের অনেকেই আইনের ঊর্ধ্বে নিজেদের রাখতে সক্ষম। অনেকটা বিখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জর্জ অরওয়েলের সেই উক্তির মত ‘All animals are equal, but some are more equal than others’। তেমনি প্রতি বছর বিশ্বের কোন দেশ দুর্নীতিতে কোন অবস্থানে আছে সেটা প্রকাশ হলেও মানুষের বিশেষ কোনো মাথাব্যথা হয় না। বাংলাদেশের মানুষের কাছে দুর্নীতি এক প্রাত্যহিক অঙ্গ।

সরকার দলীয় রাজনীতির সাথে জড়িত ফরিদপুরের দুই ভাইয়ের হাজার কোটি টাকা পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, যুবলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ঢাকায় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা, স্বাস্থ্যের ডিজি-কে দুদকে তলব করার মত ঘটনা প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা প্রমাণ করে। কিন্তু দুর্নীতির ব্যাপকতা মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে তার হ্রাস টেনে ধরা কঠিন হয়। সরকারি স্তরে মন্ত্রী এবং আমলারা, এমনকি যারা নিজেরা দুর্নীতিগ্রস্ত নন, তারাও মূলত যেটা করেন, তা হলো দৈনন্দিন দুর্নীতিকে ধামাচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা। প্রধানমন্ত্রী চাইলেও এসব জায়গা থেকে দুর্নীতির প্রশ্নে ঔদাসীন্য দেখানোর প্রক্রিয়ায় প্রশ্রয় দেওয়া হয়। প্রশাসনের উদাসীনতা মানুষকে প্রতিনিয়ত অনিয়ম আর দুর্নীতির মুখোমুখি করে।

সাধারণ মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য প্রায় প্রতি পদে পদে দুর্নীতির সম্মুখীন হতে হয়। হাসপাতালে স্বজনের চিকিৎসা, নিজের পেনশনের টাকা তোলা, বিদ্যুতের বিল দেওয়া, জমির খাজনা বা নিবন্ধন যে কাজই হোক না কেন, সাধারণ মানুষকে সরকারি অফিসে গিয়ে ভুগতে হবেই। মানুষ বিরক্ত হয়, হতাশ হয় কিন্তু বাকরুদ্ধ হয়ে সব মেনে নেয়। একটা সর্বব্যাপী দুর্নীতিগ্রস্ত অবস্থায় নিপতিত হয়ে তারা সবকিছুকে স্বাভাবিক বলেই ধরে নেয়। ফলে দুর্নীতির একটা গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হয়। দুদকের বিদায়ী চেয়ারম্যানের সাথে দ্বিমত করে বলব, মানুষ ধরেই নিয়েছে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়।

দুর্নীতি করলে সমস্যা নেই। ধরা পড়ার ঝুঁকি কম এবং ধরা পড়লেও তারা জানে সম্ভাব্য শাস্তির খরচ দুর্নীতি থেকে যে আয় হয়, সেটার চেয়ে অনেক কম। ফলে প্রচলিত এই সিস্টেমে দুর্নীতি আর কমে না বরং বলা যায় উৎসাহিত হয়।

সাধারণ মানুষকে বেঁচে থাকার জন্য প্রায় প্রতি পদে পদে দুর্নীতির সম্মুখীন হতে হয়। হাসপাতালে স্বজনের চিকিৎসা, নিজের পেনশনের টাকা তোলা, বিদ্যুতের বিল দেওয়া, জমির খাজনা বা নিবন্ধন যে কাজই হোক না কেন, সাধারণ মানুষকে সরকারি অফিসে গিয়ে ভুগতে হবেই। মানুষ বিরক্ত হয়, হতাশ হয় কিন্তু বাকরুদ্ধ হয়ে সব মেনে নেয়।

ফৌজদারি অপরাধের বিচার ব্যবস্থায় যেসব দুর্বলতা আছে সেসবের কারণে দুর্নীতির মাত্রা বেশি হয়। কিন্তু সমাজ যদি এমন হয় যে, দুর্নীতি থেকে মুক্ত মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলা মানুষ সম্মান পাবে না, সেই সমাজে দুর্নীতি কমবে না। এটাই মডেল। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে, যেনতেন ভাবে অতিমাত্রায় রোজগার না করতে পারলে নিজের পরিবারের মানুষ, পরিজন, বন্ধু সবাই তাকে অযোগ্য ভাবে। দুর্নীতি সম্পর্কে সমাজের নৈতিক অবস্থান এভাবে ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে।

বাংলাদেশে উন্নয়ন এখন বিশ্বব্যাপী আলোচিত। দেশের ভেতরেও উন্নয়ন শব্দটি সর্বাধিক উচ্চারিত। রাস্তাঘাট, অবকাঠামো, মাথাপিছু আয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো। আবার তেমনই চোখে পড়ার মতো বেসিক ব্যাংক, হল-মার্ক, ফার্মার্স ব্যাংক সহ অসংখ্য বড় দুর্নীতির খবর।

দুর্নীতি সরাসরি দরিদ্র মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে। সরকার দারিদ্র্য নিরসন করতে চায়। কিন্তু সেই দারিদ্র নিয়েও দুর্নীতি হয়। তাই উন্নয়ন ভালো হলেও দুর্নীতির আশঙ্কা কমে না। তবুও আমরা আশা রাখতে চাই রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর। একটা বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতি-প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরি করে দৈনন্দিন দুর্নীতির প্রকোপ কমানোর উদ্যোগ নিতে পারলে উন্নয়ন মানুষের হৃদয়কে ছুঁয়ে দেবেই।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি