আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের অর্ধেকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম-এ ভোট গ্রহণ করা হবে, এই সিদ্ধান্ত আগেই ছিল। বিএনপিসহ বেশকিছু বিরোধী দল, সুশীল সমাজের আপত্তির মুখে সরকারের দাবিতে নির্বাচন কমিশন এই সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও সরকারি দল আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনেই ইভিএম চেয়েছিল।

এরপরও হঠাৎ অনিশ্চয়তা দেখা দেয় ইভিএম নিয়ে। নির্বাচন কমিশন থেকে কয়েক দিন ধরেই বলা হচ্ছিল, জানুয়ারির মাঝামাঝিতে ইভিএম প্রকল্প অনুমোদন দিতে হবে। নইলে নির্বাচনের আগে ১৫০ আসনে ইভিএমে নির্বাচন করা সম্ভব হবে না।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোট নিতে দুই লাখ ইভিএম মেশিন, গাড়ি ও অন্যান্য সামগ্রীর ব্যবস্থা করতে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছিল কমিশন।

আরও পড়ুন >>> ক্ষমতাবানদের পেছনে গড্ডলিকা 

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর হঠাৎ করেই দেশে ডলারের সংকট দেখা দেয়, দামও বেশ কয়েক সপ্তাহ নিয়ন্ত্রণহীন ছিল। এখনো সংকট আছে, তাই সরকার নিজেই কৃচ্ছ্রতা সাধন করছে বহু ক্ষেত্রে। ব্যাংকগুলোও এলসি খোলায় আগের মতো দরাজ দিল হতে পারছে না।

ঠিক এমন এক বাস্তবতায় পরিকল্পনা কমিশন নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে ইভিএম প্রকল্প অনুমোদনে। 

ইভিএম নিয়ে বিতর্ক মনে হচ্ছে আবার শুরু হলো। নির্বাচন, বিএনপির দাবি অনুযায়ী, নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার দাবি মানা হবে এমন কোনো প্রতিশ্রুতি সরকার বা সরকারি দল দেয়নি।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৭ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হতে পারে।

ইভিএম নিয়ে বিতর্ক মনে হচ্ছে আবার শুরু হলো। নির্বাচন, বিএনপির দাবি অনুযায়ী, নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার দাবি মানা হবে এমন কোনো প্রতিশ্রুতি সরকার বা সরকারি দল দেয়নি। এখন সামনে এলো এই বিতর্ক। মেশিন ভালো না খারাপ এর সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন প্রশ্ন—বৈদেশিক মুদ্রার এমন এক সংকটকালে এই প্রকল্প অনুমোদন করা কী ঠিক হচ্ছে?

আরও পড়ুন >>> জনপ্রতিনিধি নাকি জনপ্রিয় প্রতিনিধি? 

বিএনপি বিরোধিতা করেই আসছে। আওয়ামী লীগের সাথে মহাজোট করা জাতীয় পার্টিও আমরা দেখেছি নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপে ইভিএম-এর প্রতি পূর্ণ সমর্থন দেয়নি।

নাগরিক সমাজের কাছ থেকে যে মতামত এসেছে সেখানে প্রযুক্তির বিরোধিতা করা না হলেও সাধারণ ভোটারকে ভরসা দিতে ভারতের মতো সবগুলো ভোটযন্ত্রে ভোটার-ভেরিফিয়াবল পেপার অডিট ট্রেইল (কাগুজে নথি) [Voter verifiable paper audit trail (VVPAT)] গুনতে পারার পদ্ধতি রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

ইভিএম-এ সমস্যা কোথায়, এমন প্রশ্ন করা হলে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়। এর অন্যতম হলো হ্যাকিং করার আশঙ্কা। বিরোধীরা বলছেন, কোনো যন্ত্রই হ্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে শতভাগ সুরক্ষিত নয়। আধুনিকতম কম্পিউটারের সুরক্ষাও সম্ভব হচ্ছে না।

আরেকটি আশঙ্কা হলো ভোটের আগেই কারচুপির ফাঁদ ঢুকিয়ে রাখা হতে পারে এই যন্ত্রে। এগুলো নিয়ে বুয়েটের কয়েকজন শিক্ষকসহ প্রযুক্তিবিদরা বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন যে, ভোটযন্ত্র নিরাপদ। কিন্তু একটি জায়গায় সম্ভবত আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে যেটি আমরা কয়েকমাস আগে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে দেখেছিলাম।

আরও পড়ুন >>> রাজনীতি কি মরণ খেলা? 

প্রত্যেকটি ইভিএম বুথে শক্তিশালী প্রার্থীর লোকজন ভোটার সহায়তার নামে তাদের পছন্দমতো প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করছেন বা অনেক নিরীহ ভোটার কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখছেন তার ভোট একটি নির্ধারিত প্রতীকে চলে গেছে। কমিশন এই কারণে সেই নির্বাচন বাতিলও করেছিল।

একটি মাত্র আসন ও কয়েকটি কেন্দ্র থাকায় এবং কমিশন সিসিটিভির মাধ্যমে ঢাকা থেকে সেই অনিয়ম প্রত্যক্ষ করে ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন। সারাদেশে ৩০০ আসনের লাখ লাখ কেন্দ্রে ভোট হবে এবং সেই ভোটে যখন অনেক প্রার্থীর বর্তমান পদ পদবী বজায় রেখেই নিজেদের দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে, তখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায় কমিশনের জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ বড় বেশি কঠিন হয়ে দেখা দিবে।

ইভিএম-এর সবচেয়ে বড় সুবিধা একজন ভোটারের আঙুলের ছাপ না মিললে কোনোভাবেই সেই ভোট জাল ভোট হিসেবে দেওয়া সম্ভব হবে না। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রমুখী করার ক্ষেত্রে এটি অবশ্যই ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে যদিও নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় ইভিএম-ই একমাত্র সূচক নয়। 

ইভিএম-এ সমস্যা কোথায়, এমন প্রশ্ন করা হলে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কথা বলা হয়। এর অন্যতম হলো হ্যাকিং করার আশঙ্কা।

নির্বাচন কমিশন বলছে ইভিএম নিয়ে এতশত আশঙ্কা অমূলক। এগুলো অত্যাধুনিক মেশিন এবং অত্যন্ত স্বচ্ছ। ফলে ভোট প্রভাবিত করার সম্ভাবনা নেই।

ভোট শেষে এগুলো খোলা হবে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সামনে। সেই প্রক্রিয়ার ছবি তোলা হবে, প্রিন্ট আউটে তাদের স্বাক্ষরও নেওয়া হবে। দফায় দফায় এত বাছাই ও নজরদারির ভেতর কারচুপি সহজ হবে না। এছাড়া ভোটের ফল ঘোষণার পরও বহুদিন এগুলো সংরক্ষিত করা যাবে।

আরও পড়ুন >>> সহমতের রাজনীতি

ভোটযন্ত্র ব্যবহারের বিভিন্ন ধাপ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। দাবি অনুযায়ী ভোটার-ভেরিফিয়াবল পেপার অডিট ট্রেইলও রাখা যেত বলে মনে করেন অনেকে। কারণ এই ইভিএম-এর এই কাগুজে নথির হিসেব করা নগদ টাকা গোনার মতোই সহজ। ইভিএম এবং পেপার মেলানো তেমন ঝামেলার নয়।

যাদের ভেতর প্রযুক্তি ভীতি আছে তারা এর বিরোধিতা করবেন বা করছেন। এই ক্ষেত্রে সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিজ নিজ জায়গা থেকে ইভিএমকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।

এই প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করা যেত, যদি সেটা বাড়ানোর উদ্যোগ থাকতো। কিভাবে ভোট দিতে হয় তা ভোটারদের নিয়ে বছরব্যাপী প্রশিক্ষণ, হাটে-বাজারে প্রচারণা ও গণমাধ্যমে বারবার প্রচার করার মাধ্যমে এই ভীতিটা দূর করা সম্ভব ছিল।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন