ছবি : সংগৃহীত

মালয়েশিয়ার ছোট্ট একটা গ্রাম ‘সুঙ্গাই নিপাহ’। ১৯৯৯ সালে সেখানে প্রথম নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। সংক্রমণের উৎস ছিল নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত অসুস্থ শূকর। রোগটি যেন মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, তার জন্য সেই সময় লাখ লাখ শূকর মেরে ফেলা হয়।

কারণ, আক্রান্ত শূকর থেকে ভাইরাস বাড়ির পোষা কুকুর-বিড়াল, ঘোড়া, ছাগলের দেহেও ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই সময় ২৬৫ জনের মধ্যে এনসেফালাইটিস (Encephalitis) দেখা দেয়, যার মধ্যে মারা যায় ১০৫ জন মানুষ। আক্রান্ত এক রোগীর মস্তিষ্ক থেকে একটি নভেল প্যারামিক্সো ভাইরাস আলাদা করা হয়। লোকটির গ্রামের নামেই ভাইরাসের নাম দেওয়া হয় নিপাহ ভাইরাস। ভাইরাসটি ফলভূক বাদুড়ের মধ্যেও শনাক্ত করা হয়েছিল। এর থেকে ধারণা করা হলো, বাদুড় থেকেই ভাইরাসটি ছড়িয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিকভাবে যেসব প্রাণঘাতী সংক্রামক ব্যাধিকে অগ্রাধিকার দেয়, নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ সেসব রোগের একটি। পরবর্তী মহামারি হতে পারে নিপাহ ভাইরাস।

আরও পড়ুন >>> বাদুড় যখন ভাইরাসের বাহক 

নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের ধরন কিছুটা করোনাভাইরাসের মতো। তবে এতে মৃত্যুহার করোনার চেয়ে অনেক বেশি। প্রতিবছর শীতকালে বাংলাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশের মেহেরপুরে ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে ২০০১ সালে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়।

নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছর প্রথম এক নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। ভাইরাসে মৃত নারীর বাড়ি রাজশাহী এলাকায়। খেজুরের রস খেয়ে তিনি বাদুড় বাহিত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। একজনই আক্রান্ত হয়েছিলেন, তিনি মারা গিয়েছেন।

আইইডিসিআরের হিসাবে, বাংলাদেশে ২২ বছরে ৩২টি জেলায় নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়েছে ৪১টি। আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দুই দশকে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৭১ শতাংশেরই মৃত্যু হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ২২ বছরে দেশে এখনো পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ৩২৬ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে মারা গেছে ২৩২ জন।

প্রতিবছর শীতকালে বাংলাদেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশের মেহেরপুরে ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে ২০০১ সালে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়।

সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এই সময় বিশেষ সতর্ক থাকা উচিত। শীতের মৌসুমের শুরু থেকেই আবহমান গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুরের রস আহরণে ব্যস্ত সময় পার করেন গাছিরা। একই সঙ্গে মানুষের মধ্যেও খেজুরের রস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়।

শীতে খেজুরের রস বাদুড়েরও অন্যতম প্রিয় খাবার। বাদুড়ের প্রজাতিগুলোর মধ্যে গ্রেটার ইন্ডিয়ান ফ্রুট ব্যাট খেজুরের রস পছন্দ করে। বাংলাদেশে টেরোপাস মিডিয়াস গোত্রের বাদুড় নিপাহ ভাইরাসের প্রাকৃতিক আধার।

আরও পড়ুন >>> নিপাহ ভাইরাস যেভাবে ছড়ায় 

খেজুরের রস বের হওয়ার স্থানটি বাদুড় চেটে রস খায়। কখনো আবার সেখানে প্রস্রাব ও পায়খানা করে। আর বাদুড়ে মুখ দেওয়া খেজুরের রস পানে মানুষের মধ্যে দেখা দেয় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমণ ঝুঁকি গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি।

শহরাঞ্চলে এখন খেজুরের কাঁচা রস নিয়ে উৎসব হচ্ছে। খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে (ফুটিয়ে) বা গরম করে পান করলে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্তের কোনো আশঙ্কা নেই। তাই বিজ্ঞানীরা বলছেন, খেজুরের রস গরম করে তা থেকে গুড় তৈরি করলে সেখানে ভাইরাস থাকার কোনো ভয় থাকে না। কারণ ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রস গরম করলে সেখানে ভাইরাস মারা যায়।

বাংলাদেশে বিজ্ঞানীরা টেরোপাস মিডিয়াস গোত্রের বাদুড় থেকে নিপাহ ভাইরাসের জিন নকশা উন্মোচন করছেন। গবেষকেরা জিনগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে টেরোপাস মিডিয়াস গোত্রের বাদুড় থেকে ১০ ধরনের নিপাহ ভাইসারকে আলাদা করেন। জিনগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এসব ভাইরাসের মধ্যে ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ মিল রয়েছে। দূর-দূরান্তের বাদুড়ের ভাইরাসের মধ্যেও মিল পাওয়া গেছে। বাদুড়গুলোর বিভিন্ন আবাসস্থলের মধ্যে আনাগোনা কিংবা চলাচলের যোগসূত্রকে এমন মিলের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা।

এই ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি থেকেও অন্য ব্যক্তিতে ছড়াতে পারে। আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার পরিবারের সদস্য ও পরিচিতরা আক্রান্ত হন। তাদের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর্মীরাও আক্রান্ত হতে পারেন।

আরও পড়ুন >>> শৈত্যপ্রবাহের গতিপ্রকৃতি ও প্রভাব 

এছাড়াও পাখি বা বাদুড়ের অর্ধ খাওয়া যেকোনো ফলমূল খেলেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে। খেজুরের রস ছাড়াও শাক-সবজি, ফলমূলেও বাদুড় মলমূত্র ত্যাগ করে এবং আংশিক খেয়ে থাকে। এসব জিনিস যখন মানুষ ভালো করে পরিষ্কার না করেই কাঁচা খায়, সেটাও নিপাহ ভাইরাসের অন্যতম একটা উৎস।

দূষিত খেজুরের রস খাওয়ার পর সাধারণত সংক্রমণের ৫–১৪ দিনের মধ্যে নিপাহ আক্রান্তের লক্ষণ দেখা দেয়। তবে লক্ষণ প্রকাশ না করেও ৪৫ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় শরীরের মধ্যে থাকতে পারে।

প্রাথমিকভাবে প্রচণ্ড জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, বমি, মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা যায়। মাথা ঘোরা, ঘন ঘন তৃষ্ণা পাওয়া, ঘুম ঘুম ভাব, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, প্রলাপ বকা ও মস্তিষ্কের তীব্র সংক্রমণজনিত নানাবিধ স্নায়ুবিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এই সময় বিশেষ সতর্ক থাকা উচিত।

কেউ কেউ নিউমোনিয়া, রক্ত জমাট বাঁধা, বুকে তীব্র যন্ত্রণাসহ তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে আসে। তাদের দ্বারা এই রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও বেশি থাকে। এই ক্ষেত্রে অনেকে প্রাথমিকভাবে ভালো হয়ে উঠলেও পরে মস্তিষ্কের বিভিন্ন জটিলতায় ভুগতে পারেন। আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার কয়েক বছর পরও তার শরীরে পুনরায় নিপাহ ভাইরাস সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে, যাকে ‘রিল্যাপসিং এনকেফেলাইটিস’ বলা হয়।

প্রস্রাব, রক্ত, সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড (Cerebrospinal Fluid) ইত্যাদি শারীরিক তরল থেকে পিসিআর, অ্যান্টিবডি টেস্ট, এলাইজা, সেল কালচার দ্বারা ভাইরাসকে শনাক্ত করা যায়।

আরও পড়ুন >>> টমেটো ফ্লু : শিশুরাই যখন আক্রান্ত 

প্রতিবছর দেশে নিপাহ ভাইরাসে অনেকে আক্রান্ত হন, এমনটি নয়। কিন্তু যারাই আক্রান্ত হন, তারাই মারা যান। তবে, মৃত্যুর কাছ থেকে যারা ফিরে আসেন, তাদের জন্য এক ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করে। বেঁচে থেকেও তারা স্মৃতি হারিয়ে ফেলতে পারেন এবং পঙ্গু হয়ে যেতে পারেন চিরতরে।

নিপাহ ভাইরাসে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হলে বা আক্রান্ত হয়েছেন সন্দেহ হলে তাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই, বিশ্বের কোথাও টিকাও আবিষ্কৃত হয়নি। রয়েছে শুধু সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট।

তবে এটি যেহেতু একটি এনভেলপড ভাইরাস (Enveloped Virus), তাই সাবান, ডিটারজেন্ট, ৭০ শতাংশ অ্যালকোহল এবং ৭০ ডিগ্রি তাপমাত্রার মাধ্যমে এই ভাইরাস ধ্বংস করা সম্ভব।

প্রতিরোধ ও সাবধানতা

নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের কোনো কার্যকর চিকিৎসা না থাকায় সঠিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—

১। কাঁচা খেজুরের রস পান থেকে বিরত থাকুন। তবে রস দিয়ে তৈরি পিঠা-পায়েস অর্থাৎ আগুনের উত্তাপে রস রান্না হওয়ার পর তৈরি সব খাবার খাওয়া যেতে পারে। আর কাঁচা রস যদি খেতেই হয়, তবে গাছ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহের হাঁড়ি সযত্নে ঢেকে রাখতে হবে, যাতে কোনো পাখির সংস্পর্শে না আসে।

২। যেকোনো ফল খাওয়ার আগে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিন।

আরও পড়ুন >>> করোনা ভ্যাকসিন : ব্যর্থ ক্যাম্পেইন ও ধন্য রাজার পুণ্য দেশ সমাচার 

৩। পাখি বা বাদুড়ে খাওয়া ফল যেমন—আম, লিচু, জাম, জামরুল, গোলাপজাম, কাঁঠাল, ডেউয়া, পেঁপে, পেয়ারা, বরই ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো।

৪। যেহেতু নিপাহ ভাইরাস শরীরে প্রবেশের ৫ থেকে ১৪ দিন পর লক্ষণ প্রকাশ পায়, তাই নিকট সময়ে যারা খেজুরের রস খেয়েছেন, তাদের সবাইকে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।

৫। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি বা রুগ্ণ পশু থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন।

৬। প্রাণী বিশেষ করে শূকরের খামারে কাজ করার সময় সতর্ক থাকুন।

৭। আক্রান্ত মানুষ থেকে অন্য মানুষেও এই রোগ ছড়াতে পারে। আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে।

৮। যারা রোগীদের সেবা দিয়েছেন এবং মৃতদের সৎকার করেছেন, তাদের দিকেও লক্ষ রাখতে হবে।

৯। আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক-নার্সদের বিশেষ সতর্কতা, যেমন মুখে মাস্ক-গ্লাভস-গাউন ব্যবহার, রোগী দেখার পর হাত ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধোয়া ইত্যাদি অবলম্বন করা উচিত।

আরও পড়ুন >>> বঙ্গভ্যাক্স : স্বাস্থ্যখাতের গেমচেঞ্জার 

১০। রোগীর ব্যবহার করা কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী সাবান দিয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করুন।

১১। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর কফ ও থুতু যেখানে-সেখানে না ফেলে একটি পাত্রে রেখে পরে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

১২। যে এলাকায় নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, সেই এলাকায় নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ হওয়ার পর আরও অন্তত ২১ দিন পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে।

তাছাড়া নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়া কোনো দেশ থেকে কেউ বাংলাদেশে এলে তাকে অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

ড. মো. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। অধ্যাপক ও গবেষক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়