ছবি : সংগৃহীত

একই সময়ে, একই বাজারে, প্রায় একই রকম সুবিধা যখন একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রদান করে, ব্যবসায়ের ভাষায় তাদের বলা হয় প্রতিদ্বন্দ্বী। বাজার ধরে রাখার জন্য একটা পর্যায়ে তাদের মধ্যে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। যে প্রতিষ্ঠান এগিয়ে থাকে, বলা যায় সেই প্রতিষ্ঠান প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাজনক অবস্থায় থাকে।

সাধারণ মানুষ তার সেবাই গ্রহণ করে বেশি। একটা পর্যায়ে তার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা বাজার থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে শুরু করে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের টিকে থাকার যুদ্ধটা শুরু হয় সেখান থেকেই। আশ্রয় নেয় বিভিন্ন কৌশল।

গুগল (Google) এবং মাইক্রোসফট (Microsoft) দুটোই আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল টেকনোলজি কোম্পানি যারা ইমেইল, ক্লাউড, ব্লগসহ অন্যান্য সুবিধার পাশাপাশি সার্চ ইঞ্জিন (Search Engine) পরিষেবার মাধ্যমে ইন্টারনেট থেকে তথ্য খুঁজে বের করে দেয়। সার্চ ইঞ্জিন পরিষেবা এই দুটো কোম্পানিরই আয়ের প্রধান উৎস। বর্তমানে গুগল এই বাজারের প্রায় ৮৫ ভাগ দখল করে আছে।

আরও পড়ুন >>> ChatGPT : চ্যাটজিপিটি : যা জানা দরকার 

মাইক্রোসফটের বিং (Bing)-সহ অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিনগুলোর দখল বাকি ১৫ ভাগ। তাই টিকে থাকা এবং বাজার বাড়ানোর জন্য মাইক্রোসফট দীর্ঘদিন ধরেই লড়াই করে যাচ্ছে বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে।

যার ধারাবাহিকতায় প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কয়েকদিন আগেই মাইক্রোসফট পার্টনারশিপ গড়ে তুলেছে বর্তমান সময়ে আলোড়ন জাগানো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence, AI) বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআই (OpenAI) এর সাথে।

মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, মাইক্রোসফট তাদের সার্চ ইঞ্জিন বিং-এ সংযুক্ত করবে ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক ঝড় তোলানো আবিষ্কার চ্যাটজিপিটি (ChatGPT)। এই চ্যাটজিপিটির রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে প্রায় মানুষের মতো করেই চিন্তা করে তথ্যপ্রদানের শক্তি।

গুগলের সাথে যুদ্ধের শুরু

মাইক্রোসফট নতুন এই কৌশল ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে একচ্ছত্র সার্চ ইঞ্জিনের বাজার দখল করে রাখা গুগলের জন্য বিশাল চিন্তার বিষয় বটে। কেননা চ্যাটজিপিটি চালুর ২ মাসের মধ্যেই এটি ১০০ মিলিয়নেরও বেশি ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছে গেছে। এই হার অনুযায়ী আগামী দুই বছরের মধ্যেই এর ব্যবহারকারী হবে গুগল সার্চ ইঞ্জিনের ব্যবহারকারীর চেয়েও বেশি।

যেভাবে আমরা একজন সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করি, সেভাবে Bard-কেও যেকোনো প্রশ্ন করা যাবে এবং একটি সংশ্লেষিত উত্তর পাওয়া যাবে নিমিষেই। উত্তরে খুশি না হলে তাকে আবার জিজ্ঞেস করা যাবে....

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে গুগল শিগগিরই তাদের বাজার হারাতে বসেছে মাইক্রোসফটের কাছে। স্পষ্ট একটি ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে গুগলের কোড রেড (Code Red) বা জরুরি অবস্থার ঘোষণার মাধ্যমে। 

আরও পড়ুন >>> বিজয় নাকি অভ্র? 

যুদ্ধের শুরুটা এখান থেকেই। ৩০ বছর ধরে আস্তে আস্তে গড়ে ওঠা টেক-জায়ান্ট গুগল এত সহজে ছাড়বেই বা কেন? এর রয়েছে নিজস্ব এবং অনেক শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণা শাখা। যেটি গুগলকে সমৃদ্ধ করার কাজ করে যাচ্ছে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে।

এরই ধারাবাহিকতায় গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই (Sundar Pichai) এই চলতি মাসেই ঘোষণা দিয়েছেন তাদের কথোপকথন বিষয়ক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিষেবা বার্ড-এর।

বার্ড, চ্যাটজিপিটির মতোই যেকোনো তথ্য উপস্থাপন করবে—প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য হয়তো আরও চমৎকার উপায়ে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই গুগল আনুষ্ঠানিকভাবে সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশ করতে যাচ্ছে বার্ডকে।

বার্ড (Bard)-এর পরিচিতি

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে মানুষের মতোই কোনো বিষয় নিয়ে আলাপচারিতা করতে পারে (Conversational Chatbot) এমন সফটওয়ার পরিষেবার কাজ মূলত গুগল শুরু করেছিল আরও দুই বছর আগেই তাদের ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল ফর ডায়ালগ অ্যাপ্লিকেশন (LaMDA)-এর মাধ্যমে।

এই LaMDA-এর উন্নততর ভার্সনই হচ্ছে Bard। যেভাবে আমরা একজন সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করি, সেভাবে Bard-কেও যেকোনো প্রশ্ন করা যাবে এবং একটি সংশ্লেষিত উত্তর পাওয়া যাবে নিমিষেই। উত্তরে খুশি না হলে তাকে আবার জিজ্ঞেস করা যাবে এবং সে আরও সহজ ও চমৎকার উপায়ে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবে।

আরও পড়ুন >>> মুঠোফোনে আসক্তি বাড়ার কারণ কী? 

বর্তমানে কোনো তথ্য জানতে হলে গুগলের সার্চ ইঞ্জিন যেখানে কেবলমাত্র কিছু ওয়েবসাইটের লিংক আমাদের সামনে হাজির করে, Bard সেক্ষেত্রে সেই সকল লিংকগুলো নিজেই পর্যালোচনা করে নিমিষেই একটি নিবিড় বর্ণনা হাজির করবে।

ইতিমধ্যে গুগলের এই আবিষ্কার চলে গেছে তার বিশ্বস্ত যাচাইকারীদের কাছে, যারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এখন পরীক্ষা করছে। আশা করা যায় সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গুগল এটিকে উন্মুক্ত করে দিবে সাধারণ মানুষের জন্য।

কতটা শক্তিশালী এই Bard?

গুগলের দাবি অনুযায়ী Bard যে মডেলটি (LaMDA) ব্যবহার করছে সেটি এতই শক্তিশালী এবং নিখুঁত যে একটা ৯ বছরের শিশু NASA-এর জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের আবিষ্কারের মতো কঠিন ব্যাপারগুলোও ব্যাখ্যা করতে পারবে সহজ, সুন্দর ও যথার্থভাবে।

৩০ বছরের বেশি অভিজ্ঞতার কারণেই গুগল হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত বা সফটওয়ার প্রকাশ করে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে বহু বছর আগেই। পর্যায়ক্রমে তৈরি করেছে BERT, MUM, LaMDA, PaLM, Imagen এবং MusicLM—এগুলো প্রত্যেকটিই একেকটি model এবং প্রত্যেকটিই তার আগেরটি থেকে হাজারগুণ বেশি শক্তিশালী এবং নিখুঁত।

আরও পড়ুন >>> ডিজিটাল ডিভাইস ও আগামীর শিশু 

এসব মডেলই হচ্ছে Conversional Chatbot এর মূল ভিত্তি। গুগল ঘোষণা দিয়েছে বার্ড হবে তাদের সবচেয়ে নিখুঁত আবিষ্কার। তার কৌতুক করার ক্ষমতা হবে মানুষের মতো, ভুল ধরার ক্ষমতা হবে মানুষের মতো, সত্য এবং যথাযথ যাচাইকৃত তথ্যই সে উপস্থাপন করবে সকলের সামনে।

Bard আর ChatGPT-এর পার্থক্য

ChatGPT এবং Bard দুটোই Natural Language Models এবং Machine Learning এর সাহায্যে এদের ব্যবহারকারীদের সাথে কথা বলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। তবে Bard-এর যেখানে latest এবং up-to-date তথ্যের এক্সেস থাকবে, সেখানে ChatGPT-এর এখন পর্যন্ত এক্সেস ২০২১ সালের আগ পর্যন্ত সব ডাটা। অর্থাৎ, ChatGPT-কে যদি কেউ সম্প্রতি তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্প সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তাহলে সে কিছু বলতে পারবে না এই সম্পর্কে। সেক্ষেত্রে Bard-এর কাছে থাকবে গুগলের কাছে থাকা সকল তথ্যের সাথে up-to-date তথ্যও ।

গুগল ঘোষণা দিয়েছে বার্ড হবে তাদের সবচেয়ে নিখুঁত আবিষ্কার। তার কৌতুক করার ক্ষমতা হবে মানুষের মতো, ভুল ধরার ক্ষমতা হবে মানুষের মতো...

Bard যে LaMDA মডেল ব্যবহার করে, তাকে ট্রেনিং করা হয়েছে প্রচুর Dialogue ডাটা দিয়ে। যার ফলে, এটি মানুষের মতো কথোপকথনে বেশি পারদর্শী হবে। এটি কাস্টমার কেয়ার সেন্টারগুলোর জন্য বেশি উপযোগী হবে।

অন্যদিকে ChatGPT এর মডেলকে ট্রেনিং করানো হয়েছে প্রচুর ওয়েব রাইটিং দিয়ে, যার কারণে যে বিষয়ের বর্ণনা করে সেটি হয় ব্যাকরণ কাঠামোগতভাবে নির্ভরযোগ্য। এটি যেকোনো রিপোর্ট লেখার জন্য বেশি উপযোগী। ChatGPT-তে plagiarism শনাক্তকরণের ব্যবস্থা সংযুক্ত করা আছে, Bard-এর ব্যাপারে এখন পর্যন্ত এই ব্যাপারে কিছু বলেনি Google।

সার্চ ইঞ্জিনের আয় কি কমে যাবে?

সার্চ ইঞ্জিন কীভাবে আয় করে সেটি আগে বোঝার চেষ্টা করি। ধরুন, আপনার একটি টি-শার্টের দোকান আছে এবং সেই দোকানের একটি ওয়েবসাইট আছে। এখন আপনি যদি চান কেউ টি-শার্ট সার্চ করলে শুরুতেই আপনার ওয়েবসাইট সার্চ ইঞ্জিনে প্রথমে দেখাবে যাতে মানুষ আপনার দোকানে আসে কেনাকাটার জন্য। সেক্ষেত্রে আপনাকে অনেক বেশি টাকা দিতে হবে সেই সার্চ ইঞ্জিন কোম্পানিকে। না দিলে হয়তো আপনার ওয়েবসাইটি সে সাধারণ ব্যবহারকারীর কাছে দেখাবেই না।

আরও পড়ুন >>> পাবজি : অনলাইন গেইমের রীতিনীতি ও অর্থনীতি 

Bard বা ChatGPT সার্চ ইঞ্জিনগুলোর ব্যবহারকারীদের সংখ্যা হয়তো কমিয়ে দিতে পারবে কিন্তু আয় কমাতে পারবে না গুগল বা মাইক্রোসফটের। এক্ষেত্রে এমনভাবে চ্যাটবটগুলো ডিজাইন করা সম্ভব যাতে কেউ টি-শার্টের দোকান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে, সেই প্রতিষ্ঠানকেই তারা উত্থাপন করবে যাদের রয়েছে পুরাতন ক্রেতাদের ভালো রিভিউ, সুনাম এবং অন্যান্য সুবিধাজনক বিষয়ের পাশাপাশি তারা ChatGPT বা  Bard-কে কত টাকা দিল তার উপর।

আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যেখানে প্রতি ৬ মাসে টেকনোলজির উন্নতি হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণে। নিত্য নতুন সেবা যুক্ত হচ্ছে, মানুষের পরিশ্রম কমছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আয় বাড়ছে, জীবনমান উন্নততর হচ্ছে।

Bard বা ChatGPT-এর আবিষ্কার ও ব্যবহার মানুষকে কতটা স্বাচ্ছন্দ্য দেবে সেটা সময়ই বলে দেবে। আমরা শুধু একটু অপেক্ষা করি, সৎ থাকি, আর পরিচ্ছন্ন রাখি নিজেদেরকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে।

ড. ইমন কুমার দে ।। সহযোগী অধ্যাপক, তথ্য প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়