ছবি : সংগৃহীত

ছোটবেলায় সিনেমা হলগুলো আমার কাছে ছিল এক বিস্ময়। আমার শৈশব এবং কিশোর বেলা কেটেছে গ্রামে। পনের কিলোমিটার এলাকার মধ্যে তিনটি সিনেমা হল।

নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলা সদরে ছিল ‘সাথী’ সিনেমা হল। উপজেলা সদর থেকে আরেকটু উজিয়ে উত্তরে ঢাকা সিলেট মহাসড়কের পাশে মুন্সেফের চরে ছিল ‘অন্বেষা’। আর কিছুটা দক্ষিণে কয়েক কিলোমিটার গেলে হাতিরদিয়ায় আরেকটি সিনেমা হল ‘পিপাসা’। যদিও এটি ছিল আরেক উপজেলায়।

শুরুতে বলছিলাম—সিনেমা হলগুলো ছিল আমার কাছে এক বিস্ময়। একটু ব্যাখ্যা করি। সিনেমা হলগুলো ঘিরে দিনমান বিরাজ করতো হুল্লোর। নানা কিসিমের মানুষ। দোকানপাট এবং হলের উঁচু ছাদের ভবনে কেমন একটা মাদক লাগা গন্ধ। সিনেমা শুরুর আগে বিভিন্ন বয়সী মানুষের উপস্থিতি, সব মিলিয়ে এক মহাযজ্ঞ।

আরও পড়ুন >>> ঋত্বিক ঘটকের সীমান্তহীন বাঙালিত্বের অভিলাষ 

আমার প্রথম সিনেমা হলে প্রবেশ মায়ের কোলে চড়ে। ছবির নাম ছিল ‘মতি মহল’। বছর চারেক বয়স বোধহয় তখন। সিনেমার কী গল্প, কারা নায়ক নায়িকা কিছুই বুঝিনি তখন। শুধু মনে আছে হলে থাকার পুরোটা সময় একবার মায়ের কোলে, একবার বাবার কোলে আরেকবার খালার কোলে ঘুরেছি।

সবার উদ্বেগ ছিল আমি যেন না কাঁদি। কারণ কাঁদলেই সবার সিনেমা দেখা মাটি। তখন গোটা পরিবার নিয়ে হলে সিনেমা দেখার চলন ছিল। পরে বড় হয়ে আমি জেনেছি মতি মহল সিনেমার নায়ক ছিলেন রাজ্জাক। নায়িকার নামও জেনেছিলাম। কিন্তু সেটি এখন আর মনে নেই। এরপর স্কুলে পড়ার সময় বাবার সঙ্গে হলে গিয়ে আমরা দুই ভাইবোন দেখেছি—সালমান শাহ মৌসুমী অভিনীত বিখ্যাত সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত (১৯৯৩)’।

আমার শৈশব কৈশোরের স্মৃতি ঘেরা সেই তিনটি সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে গেছে অনেক বছর আগে। তবে এখনো আমি নরসিংদী গেলে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি হলগুলোর দিকে। ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে এখনো অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে...

মনে আছে সিনেমাটি দুই সপ্তাহ চলেছিল সাথী সিনেমা হলে। বাবার সঙ্গে দেখার পরের সপ্তাহে একা একা হলে গিয়ে আবার দেখেছি কেয়ামত থেকে কেয়ামত। সেই থেকে শুরু আমার সিনেমা হল যাত্রা।

এরপর স্কুল পালিয়ে কত সিনেমা দেখেছি—তার কোনো হিসেব নেই। এমনও হয়েছে একই দিনে অন্বেষায় বারোটা থেকে তিনটার শো দেখে পরে সাথীতে তিনটা থেকে ছয়টার শো দেখে পরে বাড়ি ফিরেছি। এছাড়া নরসিংদী সদরে ছিল দুটি সিনেমা হল—সংগীতা এবং মিতালি। সেখানেও দেখেছি অসংখ্য সিনেমা।

আরও পড়ুন >>> সিনেমা হোক দখিনা হাওয়ায় দুরন্ত পালতোলা নাও 

আমার শৈশব কৈশোরের স্মৃতি ঘেরা সেই তিনটি সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে গেছে অনেক বছর আগে। তবে এখনো আমি নরসিংদী গেলে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকি হলগুলোর দিকে। ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে এখনো অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়ে। দেয়ালে শ্যাওলা জমেছে। প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরের যতটা চোখে পড়ে, দেখা যায় জমে অসংখ্য মাকড়শার ঝুল আর ধুলার মোটা আস্তর।

দেশের অনেক সিনেমা হলের ঠিক এই রকমই অবস্থা। কোথাও কোথাও হয়তো বন্ধ হয়ে যাওয়া হলের ভবনটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। তবে বেশিরভাগ জায়গায়ই হল ভেঙে ফেলা হয়েছে। বহুতল ভবন হয়েছে। মার্কেট হয়েছে। অবধারিত প্রশ্ন কেন এমনটা হলো?

হল মালিকরা বলেন ভালো সিনেমা নেই। তাই হল চালিয়ে বছরের পর লোকসান গুনতে হয়। প্রযোজকরা বলেন, ভালো গল্প নেই, ভালো পরিচালক নেই, ভালো অভিনেতা অভিনেত্রী নেই। তাই লগ্নি করা টাকা উঠে আসে না।

স্ক্রিপ্ট রাইটাররা বলেন, ভালো গল্প লিখে কী হবে, কারা অভিনয় করবে? পরিচালকরা বলেন, শিল্পী কই? কাদের নিয়ে কাজ করব? সব মিলিয়ে বিশাল গ্যাঁড়াকল। আর এসবের মাঝে পড়ে দর্শক মুখ ফিরিয়েছে সিনেমা হল থেকে।

আরও পড়ুন >>> শনিবার বিকেল : খুলে যাক রুদ্ধ দ্বার 

এসবের মধ্যে কথা উঠেছিল ভারত থেকে সিনেমা আমদানির। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো সংগঠন একমত হয়েছিল ভারতীয় সিনেমা আমদানির ব্যাপারে। কিন্তু সেখানেও বাঁধ সেধেছেন চলচ্চিত্র অঙ্গনের অনেকেই। ফলে সব মিলিয়ে থেমে গেছে সেই প্রক্রিয়াও।

তহবিল গঠনের দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মাত্র একটি সিনেমা হল পাঁচ কোটি টাকা নিয়েছে ঋণ হিসেবে। বাকি টাকা পড়ে আছে অলস। হল মালিকদের কথা হলো, ঋণ নিয়ে পরে শোধ করব কীভাবে? হল চালিয়ে লাভের মুখ দেখা যায় না।

নব্বইয়ের দশকেও দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ১৪’শর বেশি। প্রেক্ষাগৃহ মা‌লিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চল‌চ্চিত্র প্রদর্শক স‌মি‌তি জানিয়েছে, ১৯৯৮ সালে ১২ শ’ ৩৫‌টির মতো সিনেমা হল ছিল দেশে। দুই যুগের ব্যবধানে হলের সংখ্যা কমতে কমতে এখন ১২০টিতে নেমেছে। করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলে এখন চালু আছে ৬০টির মতো হল (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১০ ডিসেম্বর ২০২১)।

এই অবস্থা উত্তরণের জন্য সরকার কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল। পাঁচ শতাংশ সুদে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এক হাজার কোটি টাকার পুনরায় অর্থায়ন তহবিল গঠন করে।

আরও পড়ুন >>> চলচ্চিত্র বিষয়ক এজেন্ডাটা কী?

তহবিল গঠনের দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মাত্র একটি সিনেমা হল পাঁচ কোটি টাকা নিয়েছে ঋণ হিসেবে। বাকি টাকা পড়ে আছে অলস। হল মালিকদের কথা হলো, ঋণ নিয়ে পরে শোধ করব কীভাবে? হল চালিয়ে লাভের মুখ দেখা যায় না। উল্টো লোকসান গুনতে হয়।

আগে আমাদের নায়ক নায়িকারা আলোচনায় আসতেন সিনেমার কারণে। কাজের কারণে। অভিনয়ের গুণে। এখন তারা খবরের শিরোনাম হন—বারে ক্লাবে গিয়ে মারামারি করে। মাদক মামলায় আসামি হয়ে। সামাজিক মাধ্যমে নানা উল্টা পাল্টা মন্তব্য করে। প্রযোজকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে দাঁড়িয়ে। কখনো আবার শিরোনাম হন, সিনেমা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে বা মসজিদ-মাদ্রাসা করে দেওয়ার নাম করে। ২০২২ সালে চলচ্চিত্রের শিল্পীরা আলোচনায় ছিলেন শুধু শিল্পী সমিতির নির্বাচন দিয়ে।

হ্যাঁ, এসবের মাঝেও আমরা কিছু ভালো ছবি নির্মিত হয়েছে। সেগুলো দেখার জন্য দর্শক কিন্তু ঠিকই হলে যান। টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ি থাকে। কিন্তু সেটি বছরে কয়টি? বছরে হাতেগোনা দুয়েকটি সিনেমা দিয়ে কি আর পুরো ইন্ডাস্ট্রি চলতে পারে? চলতে যে পারে না তার জ্বলন্ত প্রমাণ তো একের পর এক হল বন্ধ হয়ে যাওয়া।

আরও পড়ুন >>> বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৪৭-১৯৭৫) শিল্পের স্বকীয়তা 

এখন হচ্ছে পুরো দুনিয়ার এক সঙ্গে জুড়ে থাকার যুগ। চাইলেই ঘরে বসে পৃথিবীর যেকোনো দেশের সিনেমা দেখা যায়। টিভির রিমোট ঘোরালেই দেখা যায় একশ চ্যানেল। ফলে প্রতিযোগিতা এখন সারা বিশ্বের সঙ্গে। এই বিষয়টা আমরা বুঝিনি। বা বুঝলেও গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। এখনো আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে আমরা পারব সফল হতে। আবারও দর্শকে গমগম করবে হলগুলো। সিনেমাপ্রেমী মানুষের পদভারে মুখর হবে হল প্রাঙ্গণ।

মানুষ বিনোদন ছাড়া থাকতে পারে না। বেঁচে থাকতে হলে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের মতো বিনোদনও একটি প্রয়োজনীয় বিষয়।

মানুষ বিনোদনের জন্য তার কাছে থাকা সবচেয়ে ভালো মাধ্যমই বেছে নেবে এবং এটিই স্বাভাবিক। সুতরাং আমরা যদি আমাদের সিনেমা যুগোপযোগী করতে পারি, হলগুলো আধুনিক করতে পারি—মানুষ আবার হলে ভিড় জমাবেন আগের মতোই। আমি বড় আশাবাদী মানুষ। সুতরাং আবারও আমাদের সিনেমার সুদিন ফিরবে—এই আশায় আছি।

খান মুহাম্মদ রুমেল ।। অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, সময় টেলিভিশন