স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা। উৎসাহ আর উদ্দীপনা নিয়ে আমরা উৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত। ত্রিশ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত একটি দেশের জন্য পঞ্চাশ বছর অবশ্যই একটি বড় মাইলফলক। তার মধ্যে যুক্ত হয়েছে দেশটির জন্মদাতার জন্মশতবার্ষিকী। অর্থাৎ, দ্বিগুণ উৎসবের আয়োজন। ওহ, হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম, এই একই বছরেই আমরা অর্জন করেছি উন্নয়নশীল দেশের দালিলিক স্বীকৃতিও। জাতি হিসেবে আমরা গর্বিত। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের লক্ষ্য নিয়ে আগাচ্ছি আমরা। এই যে এতো এতো অর্জন, তার মাঝেও কি আমাদের বুকে সামান্য হলেও আফসোস নেই? আছে। কী সেই আফসোসের জায়গাটি?

আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, কিন্তু সমবণ্টনের কাজটি রয়ে গেছে। আমাদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, কিন্তু সেই পথেও হাঁটতে হবে আরও অনেক দিন। তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার মতো কিছুই হয়নি এখনও। আমাদের নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে কতটা? নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কাজটি কতটা এগিয়েছে আসলে? ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশটি অর্জিত হয়েছিল সেই দেশের স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের কী অবস্থা? সাম্য ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে গড়ার কাজটি কতদূর এগোলো? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ার কাজটি আমরা কতটা পরিকল্পনামাফিক করতে পারলাম? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই কি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হয়ে যাবে? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজতো একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন। দেশকে গ্লানি মুক্ত করার পথে এক ধাপ এগোনোর কাজ। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্নের রাস্তাটা অনেক লম্বা। অনেক সাংস্কৃতিক লড়াই জড়িত এখানে।

লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায় যখন দেখি জাতির পিতার জন্মদিন ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসবের শুরুর দিনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর মৌলবাদীদের হামলা। এখনও ধর্মীয় অনুভূতির দোহাই দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দুদের ঘরবাড়ি, এলাকা ছাড়া করা হচ্ছে তাদের। জাতির পিতার ভাস্কর্যকে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকির পরেও তারা অক্ষত থাকে, অথচ সামান্য ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য জেলে নিয়ে যাওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যেসব সরকার এসেছিল তাদের প্রতিটিই ছিল বাংলাদেশের চেতনা থেকে অনেক দূরে। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতের গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছিল আমাদের লাল সবুজের পতাকা। সেইসব দিন পেরিয়ে এসেছি আমরা অনেকদিন।

ইউটিউব, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা অনলাইন পোর্টালগুলোতে নারী ইস্যু, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলে অশ্রাব্য ওয়াজ। প্রধানমন্ত্রীকে হুমকি দিয়েও জঙ্গি মৌলবাদী গোষ্ঠী থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেন? কাদের স্বার্থে মৌলবাদের সঙ্গে আপস? এই আপস করে কী অর্জিত হচ্ছে আমাদের? এভাবে কি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত হবে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ পেতে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে আমাদের?

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যেসব সরকার এসেছিল তাদের প্রতিটিই ছিল বাংলাদেশের চেতনা থেকে অনেক দূরে। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতের গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছিল আমাদের লাল সবুজের পতাকা। সেইসব দিন পেরিয়ে এসেছি আমরা অনেকদিন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আজ ক্ষমতায় আছে প্রায় ১২-১৪ বছর। এই লম্বা সময়ে আমরা এমন কোনো পরিকল্পনা বা কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে পাইনি যা দিয়ে আগামীর বাংলাদেশকে নিয়ে খুব বেশি গর্বিত হতে পারব। অনেকেই ভাবতে পারেন আমি হয়তো কেবল নেতিবাচক কথাই বলছি কেন? এতো এতো উন্নয়ন তবে কোথায় গেল? উন্নয়ন হচ্ছে এবং এ নিয়ে অনেক প্রশংসা বাণীও আছে। অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠাটাই একটি বড় স্বীকৃতি। কিন্তু এর পাশাপাশি আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের চিত্রটিও সামনে আনতে হবে। কেবল প্রশংসায় ভেসে গেলে তো পিছিয়েই গেলাম। আর এই সরকারের কাছে আশা না করলে আর কার কাছে করব? সেই ভরসার জায়গাটি একদমই শূন্য আমাদের সামনে।

আগামীর বাংলাদেশ মানে আজকের তরুণ বা যুবকেরা। কিন্তু তারা কোন চেতনায় গড়ে উঠছে, সেই বিষয়টিকে নিয়ে আমাদের পরিকল্পনার জায়গাটি কোথায়? এই ভাবনাটি যখন জেগে ওঠে তখন আমি দেখি, তরুণ সমাজ জাতির পিতাকে সঠিক সম্মান দিচ্ছে না। এই দায় কার? আমরা তাদের মধ্যে সেই বোধ, চেতনার উদয় কি ঘটাতে পেরেছি?

অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠাটাই একটি বড় স্বীকৃতি। কিন্তু এর পাশাপাশি আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের চিত্রটিও সামনে আনতে হবে। কেবল প্রশংসায় ভেসে গেলে তো পিছিয়েই গেলাম।

আমি হতাশার বাংলাদেশকে খুঁজে পাই, যখন শুনি আমারই ছেলের বয়সীরা জাতির পিতার জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ঘোষিত কর্মসূচিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়। এমন কি হওয়ার কথা ছিল? পুরো পৃথিবীতে বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতিবিদ আছেন, কিন্তু কোথাও জাতির জনককে অসম্মান করা হয়নি। তার সম্মানের জায়গা থেকে কখনো সরানো হয়নি। অথচ আমরা এর ব্যতিক্রম, যা উচিত নয়।

এসব দেখেই প্রশ্ন আসে, আমরা আসলেই কতটা ইতিহাসকে পৌঁছে দিতে পেরেছি নতুন প্রজন্মের কাছে? কেন কাজটা পরিকল্পনা বহির্ভূত থেকে গেল আমাদের? নাকি পরিকল্পনাই ছিল না কোথাও? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে আসলেই কি পেরেছি আমরা ‘চেতনায়’ পৌঁছে দিতে? আজকের এই বিশেষ ক্ষণে এসে আমি কেবল এই জায়গাটি নিয়ে ভাবছি।

লীনা পারভীন ।। কলামিস্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট