মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের অক্সিলারি ফোর্সগুলোর নৃশংসতাকে নানা শব্দ প্রয়োগে প্রকাশ করা হয়। এক্ষেত্রে ‘গণহত্যা’ শব্দটি সব থেকে বেশি প্রচলিত। গণহত্যার আভিধানিক ইংরেজি Mass Killing, কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ ধরনের নৃশংসতাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে সুনির্দিষ্ট একটি শব্দে- জেনোসাইড। জেনোসাইড এবং মাস কিলিং এক নয়।

পোলিশ আইনজীবী ও অধ্যাপক রাফায়েল লেমকিন’র দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ‘দ্য কনভেনশন অফ দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অফ দ্য ক্রাইম অফ জেনোসাইড’ গ্রহণ করে। এই কনভেনশনে জেনোসাইডকে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এছাড়া খুব স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয় কোন অপরাধ জেনোসাইড হিসেবে গণ্য হবে। 

এই কনভেনশনের আর্টিকেল দুইয়ে বলা হয়েছে, কোনো জাতি/গোত্র/নৃতাত্ত্বিক/ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায়ে সংঘটিত কার্যক্রমগুলো জেনোসাইড।  

আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নৃশংসতা এবং এর আগের দুই যুগের নিষ্পেষণকে বিবেচনা করি, তাহলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের জাতি পরিচয় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার একটি স্পষ্ট অভিপ্রায় ছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর। এই অভিপ্রায়ে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসজুড়ে তারা গণহত্যা, ব্যাপক হারে নারী ধর্ষণ, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা, উদ্বাস্তুকরণ, সম্পদ ধ্বংস, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করার মতো সম্মিলিত অপরাধ করেছে। শুধু গণহত্যা নয়, এই সকল অপরাধের সব এবং জাতি পরিচয় নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায় মিলে হচ্ছে জেনোসাইড ’৭১। জেনোসাইডের ক্ষেত্রে সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, মূল বিষয় হচ্ছে ‘অভিপ্রায়’। যদি প্রমাণ করা যায় ঘাতকদের অভিপ্রায় ছিল জাতি/গোত্র/নৃতাত্ত্বিক/ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিহ্ন করা, তাহলেই সেটি জেনোসাইড।

কনভেনশনের আর্টিকেল দুইয়ে বলা হয়েছে, কোনো জাতি/গোত্র/নৃতাত্ত্বিক/ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায়ে সংঘটিত কার্যক্রমগুলো জেনোসাইড।  

ব্রাজিলের একটি আদিবাসী গোত্রের মাত্র ১৬ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, সেটিও জেনোসাইড হিসেবে আদালতে স্বীকৃত হয়েছে। জেনোসাইডের বাংলা গণহত্যা নয়, জেনোসাইড নিজেই একটা অর্থবোধক শব্দ হিসেবে প্রচলিত, এর অনুবাদ জরুরি নয়।

নিজেদের প্রয়োজনেই এসব শব্দ ব্যবহারে আমাদের জানা, বোঝা ও বোধগম্যতার প্রয়োজন আছে, প্রয়োজন আছে সচেতনতা ও সতর্কতার। জাতিসংঘ কর্তৃক জেনোসাইডের স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়ে ভাবলেই এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ১৯৭১-এর নৃশংসতা একটি স্পষ্ট জেনোসাইড; কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটি এখনও জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত জেনোসাইড নয়। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন আমেরিকান কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড ওয়াশিংটনে যে জরুরি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন তার শিরোনাম ছিল— ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’। অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের সেই বিখ্যাত রিপোর্টটিরও শিরোনাম ছিল ‘জেনোসাইড’।

বাংলাদেশের জেনোসাইডের পরে সংঘটিত কম্বোডিয়া, রুয়ান্ডা ও বসনিয়া-হার্জেগোভিনার জেনোসাইড জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশেষ করে বসনিয়া-হার্জেগোভিনার জেনোসাইড অতি দ্রুত স্বীকৃতি পেয়েছিল। এর পেছনের কিছু কার্যকারণ বিবেচনা করা জরুরি। যখনই কোনো জেনোসাইড জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত হয়ে যায়, তখন আর সেটি কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে না, এটি তখন আন্তর্জাতিক ইস্যু। জাতিসংঘ ও রাষ্ট্রগুলোর ত্বরিত দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় জেনোসাইড বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখার, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও। শুধু তাই নয়, জেনোসাইড থামানোর পর এর জন্য দায়ীদের শাস্তি বিধান করাও জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়।

দায়িত্ব এড়ানো এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির অপকৌশলের জন্য সংজ্ঞাগত ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়। যে সার্বিয়ানরা বসনিয়ায় জেনোসাইড ঘটিয়েছিল, তারা নিজেরাই ‘এথনিক ক্লিনজিং’ শব্দটি ছড়িয়ে দিয়েছিল যাতে ‘জেনোসাইড’-এর দায় থেকে মুক্তি পায়। এথনিক ক্লিনজিং কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধ নয়, যেমন আন্তর্জাতিক অপরাধ নয় গণহত্যা বা মাসকিলিং। জেনোসাইড, মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ- সব হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ।

যখনই কোনো জেনোসাইড জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত হয়ে যায়, তখন আর সেটি কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে না, এটি তখন আন্তর্জাতিক ইস্যু। জাতিসংঘ ও রাষ্ট্রগুলোর ত্বরিত দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় জেনোসাইড বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখার, প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগ করে হলেও। শুধু তাই নয়, জেনোসাইড থামানোর পর এর জন্য দায়ীদের শাস্তি বিধান করাও জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়।

জেনোসাইড বাংলাদেশ- জাতিসংঘ কর্তৃক এখন পর্যন্ত স্বীকৃত না হওয়ার পেছনে আমাদের নিজেদের জানা, বোঝা ও কূটনৈতিক এবং একাডেমিক উদ্যোগের অভাব তো অবশ্যই রয়েছে, সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও জড়িত আছে। বিশ্বের পরাক্রমশীল দুই পরাশক্তি চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক ভূমিকা তখন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবে। রক্তের দাগ মুছে ফেলার একটা মিশন সদা কার্যকর রয়েছে এসব সুপার পাওয়ারের। এদের ফান্ডিংয়ে বড় বড় গবেষণা হয় সেইসব জেনোসাইডকে ‘সামান্য’ দেখাতে, যেসবে তাদের হাতে রক্ত লাগানো আছে।

বিষয়টি তাই সহজ নয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর অন্যতম নৃশংস এই জেনোসাইডের স্বীকৃতি অবশ্যই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দিতে হবে। অর্থনীতি ও অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সামনে সুযোগ এসেছে জেনোসাইড ’৭১-এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে কাজ শুরু করার। জাতিসংঘের স্বীকৃতি হয়তো সহজ নয়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধু রাষ্ট্র- ভারত, প্রাক্তন সোভিয়েত ব্লকের বর্তমান রাষ্ট্রগুলো, কানাডা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অনেক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য আদায় করা অসম্ভব নয়। উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর ভারতে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা যে নৃশংসতার শিকার হয়েছিলেন সেটি কানাডার অন্টারিও প্রভিন্স জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এক্ষেত্রে সেখানে বসবাসরত শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা জোরালো ভূমিকা পালন করেছিলেন।

জেনোসাইড ’৭১-এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য জরুরি উপাদান হচ্ছে, এখনো বেঁচে থাকা ভিকটিম ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য সংগ্রহ করে রাখা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক গৌরবের পাশাপাশি জেনোসাইডের সাক্ষ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজটিও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। 

হাসান মোরশেদ ।। প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান গবেষক, www.1971archive.org