ছবি : সংগৃহীত

পাকিস্তানে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, শাসকপক্ষ একটাই এবং সেটা হলো সেনাবাহিনী। সেই সেনাবাহিনী এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় দল সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পিটিআই এখন মুখোমুখি। সেনা শাসকদের সহযোগী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের দল অবশ্য পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকেও এখন ইমরানের কাতারে ফেলতে চেষ্টা করছে।

বিপর্যয়ের দিকে এগোচ্ছে পাকিস্তান—এমন একটা কথা বলছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা। ইমরান খান নিজেও বলছেন সেটা। তিনি দেশ ভেঙে যাওয়ারও ইঙ্গিত দিচ্ছেন। 

২০২৩ সালের ৯ মে তাকে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট চত্বর থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। সাথে সাথে সহিংস হয়ে ওঠে গোটা দেশের পরিস্থিতি। অবস্থা এমন হয়েছে যে, পাকিস্তানের সেনাসদর, একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেলসহ অনেক সেনা কর্মকর্তার বাসভবন জনতার হামলার শিকার হয় যা পাকিস্তানে আগে কখনো ঘটেনি।

আরও পড়ুন >>> পাকিস্তান : কান্ট্রি অব থ্রি ‘এ’ 

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক আছে বলা যাবে না এবং পরিস্থিতি এমনই যে, পাশের দেশ আফগানিস্তানের তালেবান সরকার পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছে, পাকিস্তান পরিস্থিতি তাদের জন্য শঙ্কার। 

দুর্নীতির অভিযোগের মতো হাতিয়ার হাতে থাকলে প্রতিহিংসার রাজনীতিতে আর কিছু লাগে না। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেই কাজটিই বারবার করছে। সেই দেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীকেই মেয়াদ পূর্ণ করতে দেয়নি সেনাসদর এবং ইমরানের বেলায়ও তা ঘটেছে।

সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া পাকিস্তানে ক্ষমতায় আসা এবং ক্ষমতায় টিকে থাকা কার্যত অসম্ভব। সেটা জেনেও ইমরান খান সাহস দেখিয়েছেন এবং সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নিয়ে কথা বলেছেন....

ইমরান খান একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী। অথচ যেভাবে সম্প্রতি তাকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে গ্রেফতার করা হলো, সেটা এক কথায় ভয়ংকর। এই গ্রেফতারি যে বেআইনি, পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট সেই রায় দিয়েছে।

ইমরান খান আপাতত জামিন পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে অবশ্যই তার তদন্ত ও বিচার হবে যথাবিধি। কিন্তু একটা দেশের সেনাবাহিনী যখন ক্ষমতাসীন দলকে দিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে বিরোধী স্বরকে দমন করার কাজে দুর্নীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে, তখন গণতন্ত্রের পক্ষে তার ফল হয় মারাত্মক। এমন অবস্থা তালেবানি শাসনের সাথেও যায় না। 

আরও পড়ুন >>> পাকিস্তানের বিপজ্জনক রাজনীতি 

সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া পাকিস্তানে ক্ষমতায় আসা এবং ক্ষমতায় টিকে থাকা কার্যত অসম্ভব। সেটা জেনেও ইমরান খান সাহস দেখিয়েছেন এবং সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নিয়ে কথা বলেছেন, এমনকি সেনা প্রধানসহ চাকরিরত বড় সেনা কর্মকর্তাদের নাম নিয়ে তিনি অভিযোগ তুলে ধরেছেন। ইমরান খানের এই সাহস জনতার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে এবং তার প্রকাশও ঘটছে এখন। 

পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এমন একটা সময় চলছে যখন দেশটি চরম আর্থিক সংকটে ভুগছে। প্রবৃদ্ধি বলে কিছু নেই, মূল্যস্ফীতি চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে কমতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে এবং এখন প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানির অর্থও হাতে নেই।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে হাত পেতেছে শেহবাজ সরকার, কিন্তু সেটা পাওয়াও অনিশ্চিত। আইএমএফ যদি সদয় না হয়, তা হলে ঋণের ফাঁদে পুরোপুরি ডুবে যেতে পারে পাকিস্তান। 

সেনাবাহিনী যদি সারাক্ষণ প্রশাসনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে এবং প্রশাসনের নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়, সেটা গণতন্ত্র না। বলতে গেলে সামগ্রিকভাবে দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা। এই ছদ্ম-গণতন্ত্র পাকিস্তান বহন করে চলেছে দশকের পর দশক ধরে। দেশ জুড়ে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা পাকিস্তানকে খাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। 

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে হাত পেতেছে শেহবাজ সরকার, কিন্তু সেটা পাওয়াও অনিশ্চিত। আইএমএফ যদি সদয় না হয়, তা হলে ঋণের ফাঁদে পুরোপুরি ডুবে যেতে পারে পাকিস্তান। 

পাকিস্তান এমনিতে সহিংসতায় আক্রান্ত দেশ। সাম্প্রতিক অস্থিরতায় সন্ত্রাসী তৎপরতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত এই মুহূর্তে পাকিস্তান তিনটি বড় সমস্যায় পর্যদুস্ত—রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তা হুমকি। সবই দেশটিকে ঠেলে দিচ্ছে নৈরাজ্যের দিকে।

আরও পড়ুন >>> পাকিস্তানপ্রেমী বাংলাদেশি! 

দেশটি এখনই হয়তো সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন হয়ে যাবে না, তবে পাকিস্তানে যে ভয়াবহ অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি আছে সেটি দেশটির রাজনৈতিক এবং সামাজিক বন্ধন ভেঙে ফেলছে। একটা স্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে কোনো দেশ কার্যকর শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে না। ক্ষমতাসীনরা বা বিরোধীরা কোনো পক্ষই সমঝোতা মানছে না। 

পাকিস্তানের পত্রপত্রিকাগুলো নানা বিশ্লেষণ প্রকাশ করছে। অনেকেই বলছে, বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে এই গণঅসন্তোষ থেকে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে পাকিস্তানে।

ইমরান খান নাটকের সময়ই পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের গিলগিট-বালটিস্তানে সেনা বিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। অস্থিরতা চলছে বালুচিস্তানেও। বালুচিস্তানে হাজার হাজারস মানুষ উধাও হয়ে গেছে, যাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক কর্মী। অভিযোগ আছে যে, সামরিক বাহিনীই এর নেপথ্যে।  

পাকিস্তানে এখন যে অস্থিরতা চলছে তাকে বলা যায় রাজনৈতিক শূন্যতা হিসেবে। এর সুযোগ নিচ্ছে জঙ্গি গোষ্ঠী এবং আরও নেবে বলেই আশঙ্কা। ২০২১ সালে প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানে (টিটিপি) সুবিধাজনক অবস্থান পেয়েছে, কারণ আফগানিস্তান তাদের জন্য অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। যেহেতু দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক, তাই সামাজিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে জঙ্গি গ্রুপগুলো তৎপরতা বাড়িয়েছে। 

আরও পড়ুন >>> জাতিরাষ্ট্র পাকিস্তান : অর্থ ও নীতির দ্বন্দ্ব 

বর্তমান পরিস্থিতি পাকিস্তানের ভঙ্গুর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থারই প্রতিফলন। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো পাকিস্তানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজন বেশি। সেটা করতে গেলে রাজনীতি থেকে সেনাবাহিনীকে দূরে থাকতে হবে বা রাখতে হবে।

আপাতত শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে সেনা প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ ও স্বাধীন নির্বাচন। ২২ কোটির বেশি লোকের পারমাণবিক সমৃদ্ধ দেশটি পশ্চিমে আফগানিস্তান, উত্তর-পূর্বে চীন এবং পূর্বে পারমাণবিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের মধ্যে অবস্থিত, যা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এরকম একটি দেশে অস্থিরতা সব প্রতিবেশির জন্যই উদ্বেগজনক। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনী পরিস্থিতি তাদের হাতের বাইরে যেতে দেবে কি না সেই সিদ্ধান্ত তাদেরই।
 
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন