১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত, দরিদ্র, মেধাবিপর্যস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে আশাব্যঞ্জক কোনো প্রক্ষেপণ ছিল না। বরং জনসংখ্যার ৭২% দরিদ্র মানুষের এই দেশকে পশ্চাৎপদতার নানান উপাধিতে ভূষিত করেছিল বিভিন্ন উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ তাদের সে প্রক্ষেপণ যে কত ভুল ছিল, তার প্রমাণ আজকের বাংলাদেশ।

এই বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার কমিয়ে এনেছে জনসংখ্যার ২০ ভাগে; সার্বজনীন টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে মারাত্মক কিছু অসুখের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, ফলে কমেছে শিশুমৃত্যুর হার। গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও রাস্তাঘাটের বিস্তার ঘটিয়ে অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করেছে। দেশব্যাপী নিরাপদ মাতৃত্বের নানান কর্মসূচি গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দেওয়ায় কমেছে মাতৃমৃত্যুর হার, গড় আয়ু পৌঁছে গেছে ৭২ বছরে, যা কেবল দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের চেয়েই বেশি নয়, এমনকি আমেরিকার বেশ কয়েকটি স্টেটের চেয়েও বেশি।

বাংলাদেশের উন্নয়ন দর্শন, অগ্রগতি নিয়ে বরং এখন গবেষণা হচ্ছে এই মিরাকল কীভাবে হলো। আমার মতে, বাংলাদেশের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় শক্তি এ দেশের জনগণ। কৃষি, শিল্প, সেবা— এই তিন প্রধান অর্থনৈতিক খাতের নানান অগ্রগতিতে এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। সত্তরের দশকে এ দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক উৎপাদন বা জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ছিল মাত্র ৯ ভাগ; আজ শিল্প খাত থেকে আমাদের ৩৫ ভাগ জিডিপি আসে। শিল্প খাতের অগ্রগতি বহুলাংশে সম্ভব হয়েছে স্বল্প মজুরিতে বিপুল শ্রমিকের জোগান। অবশ্যই নীতি সহায়তা এবং উদ্যোক্তাদের ভূমিকা আছে। কিন্তু বিপুল শ্রমের জোগান থাকার কারণে উদ্যোগগুলো সহজে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। আমাদের প্রধান শিল্প খাত তথা রফতানি খাত তৈরি পোশাকের উত্থানের পেছনে স্বল্পমূল্যে পাওয়া শ্রম, বিশেষ করে নারীশ্রমিকের ভূমিকা এখন সবাই স্বীকার করেন। সত্যি বলতে কী, বাংলাদেশের উন্নয়নের মিরাকল ঘটিয়েছেন নারীরা। শিল্পায়নে যেমন তাদের বড় ভূমিকা আছে, একইভাবে নারীরাই তাদের সন্তানদের যথাসময়ে টিকা দিয়ে স্বাস্থ্যবান জাতি গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছেন, তা আজ বহু গবেষণায় প্রমাণিত। এ দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত তৈরি করতে গ্রামীণ নারীরা মাইক্রোক্রেডিটের মাধ্যমে নানারকম বাণিজ্যিক উদ্যোগ গ্রহণ করার সুফল ভোগ করেছে গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে। প্রবৃদ্ধিতে নারীদের অবদান অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় শক্তি এ দেশের জনগণ। কৃষি, শিল্প, সেবা— এই তিন প্রধান অর্থনৈতিক খাতের নানান অগ্রগতিতে এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।

কন্যাশিশুকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারলে তা যে আগামীর উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, তার সফল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। নারীশিক্ষার বিস্তারে বাংলাদেশের শিক্ষাবৃত্তি কর্মসূচি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ। মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়ানোর ফলে একদিকে যেমন বিপুল সংখ্যক নারীকে শ্রমবাজারে আনা সম্ভব হয়েছে, আবার তা পরবর্তী শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য দুর্বার সংগ্রাম করে গেছেন, তখন তিনি বারবারই জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস রেখেছেন। নারী-পুরুষ সকল মানুষকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র দিয়েছেন তিনি। এ দেশের সংবিধান রচিত হয়েছে সেভাবেই। নানান চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যখন বাংলাদেশ এগিয়েছে, যখন বারবার প্রাকৃতিক কিংবা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে থমকে গেছে উন্নয়নের গতি, তখনই এ দেশের জনগণ মাথাচাড়া দিয়ে নিশ্চিত করেছে এগিয়ে যাওয়ার মূল মন্ত্র।

বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ’৭০-এর দশকের ১.৫ শতাংশ থেকে বিগত দশকে গড়ে ৮ শতাংশে উন্নীত হওয়ার পেছনে অবকাঠামোগত অগ্রগতির যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এই অগ্রগতি বিশেষভাবে চোখে পড়ার মতো। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎসহ গ্রামে-গঞ্জে ইন্টারনেট সুবিধা ছড়িয়ে দেওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মতো নানারকম সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তোলা, বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রভৃতি অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথকে ত্বরান্বিত করেছে। তবে এ কথাও ঠিক, এই উন্নয়নের সঙ্গে যদি আরও বেশি সুশাসন যুক্ত থাকত, দুর্নীতি যদি কম হতো, কিংবা বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় যদি উন্নয়নের গতি ব্যাহত না হতো, প্রাকৃতিক দুর্যোগে যদি বারবার আঘাতপ্রাপ্ত না হতো, তাহলে হয়তো আমাদের অগ্রগতি হতো আরও বহুগুণ বেশি।

বাংলাদেশ ২০১৫ সালে বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, লোয়ার মিডল ইনকাম কান্ট্রি স্ট্যাটাস অর্জন করেছে। আমরা জানি বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার যাত্রা শুরু করেছে বেশ ক’বছর আগেও এবং বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৬-এ বাংলাদেশ দরিদ্র দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাবে। তবে সফলভাবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এবং দরিদ্র দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সদর্পে এগিয়ে যেতে বাংলাদেশকে বেশকিছু বিষয়ের ওপর মনোযোগ দিতে হবে। এর মধ্যে সর্বপ্রথম বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এবং বিদ্যমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন। সেই সঙ্গে দরকার হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নত করা, এতে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। কর্মসংস্থান সৃষ্টি আমাদের উন্নয়নের মূল লক্ষ্য, কারণ এর মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন সহজ হয়। তবে দারিদ্র্য বিমোচনের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো অব্যাহত রাখতে হবে, দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে ছেলে-মেয়েরা শিক্ষাজীবনে বেশকিছু বাস্তব কাজের দক্ষতা অর্জন করতে পারে। উন্নয়নের গুণগত মান বাড়াতে অবশ্যই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে আরও বেশি পৌঁছে দিতে হবে উন্নয়নের পথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ।

কন্যাশিশুকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে পারলে তা যে আগামীর উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, তার সফল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। নারীশিক্ষার বিস্তারে বাংলাদেশের শিক্ষাবৃত্তি কর্মসূচি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ।

গ্রামে-গঞ্জে বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে, ডিজিটাল বাংলাদেশের সেবা সুসংহত করতে ডিজিটাল কানেক্টিভিটি বাড়াতে হবে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় নিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের দক্ষতা ও মান বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বোপরি উন্নয়নের অপচয় রোধ করতে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ যেহেতু এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যায় তারুণ্যের আধিক্যের দেশ, সেই সুযোগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা আরও জোরদার করতে হবে। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়ের শ্রম ব্যবহারের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা নারীকে অনেক পিছিয়ে রাখছে। এ সহিংসতা রোধ করতে না পারলে নারীর অগ্রযাত্রা ব্যাহত হলে তাতে দেশেরই ক্ষতি।

বাংলাদেশের অগ্রগতিতে সেবা খাত ভূমিকা রেখেছে সহায়ক শক্তি হিসেবে। এক্ষেত্রে আর্থিক খাতের আধুনিকায়ন, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস অগ্রগতি, গ্রামে-গঞ্জে আর্থিক সেবা পৌঁছে যাওয়া, ইত্যাদির ভূমিকার কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। তবে এ কথা ঠিক, ব্যাংকিং খাতে আরও সুশাসন ও স্বচ্ছতা দরকার, দরকার জবাবদিহিমূলক নিয়মকানুন ও তার বাস্তবায়ন।

বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশ তার উন্নয়নকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। তবে এখনও আয় বৈষম্য রয়ে গেছে ধনী-দরিদ্রের মাঝে, যা টেকসই উন্নয়নের পথে হুমকিস্বরূপ। তাই উন্নয়নকে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংবেদনশীল এবং আগামীর জন্য আরও সম্ভাবনাময় করতে আয় বৈষম্য দূর করার উদ্যোগগুলো অব্যাহত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সুশাসন পূর্ণ বাস্তবায়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় সুযোগ বৃদ্ধি করা দরকার।

বাংলাদেশ পরিকল্পনা করেছে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হবে। এই লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব নয়, তবে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সততা দরকার সর্বস্তরের নেতৃত্বের মধ্যে। আবার বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা, আর্থিক খাতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, আইনের শাসন নিশ্চিত করতে যারা আছেন তাদের মধ্যে আরও সংবেদনশীলতা ও সুশাসনের নিশ্চয়তা দরকার।

ড. নাজনীন আহমেদ ।। সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)