বাংলাদেশ স্বাধীনের পর অনেক দিন পর্যন্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলতে ১৯৭৩-এর অ্যাক্টের অধীনে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়কেই বোঝানো হতো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত আগ্রহে প্রণীত ১৯৭৩-এর অ্যাক্টের অধীনে তখন ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে মর্যাদা পায়। বর্তমানে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত  অনুযায়ী দেশে সর্বমোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫২টি। তবে বর্তমানে ৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম চলছে।

প্রায় প্রতিদিনই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা খবর পত্রিকার পাতায় প্রধান শিরোনাম হতে দেখছি। কোথাও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা নেই, কোথাও উপাচার্যের পাহাড়সম দুর্নীতি। কোথাও আত্মীয়স্বজনকে নিয়োগ দিতে গিয়ে নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করা হচ্ছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলে মূলত সরকারি অর্থায়নে, অর্থাৎ জনগণের করের টাকায়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য শিক্ষা ও গবেষণার বিকাশ এবং মানসম্মত গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধার জায়গা ছিল অনেক উঁচুতে। আমরা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, ১৯২১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর কয়েক দশকের মধ্যে শিক্ষা ও গবেষণায় উঁচু মানের কারণে এটি ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর (সত্যেন বোস) পাঠানো একটি প্রবন্ধ পড়ে সর্বকালের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করেছিলেন। সেই প্রবন্ধটি আইনস্টাইন জার্মানি থেকে প্রকাশ করেন এবং পরবর্তী সময়ে সত্যেন বোসের সঙ্গে আইনস্টাইন যৌথভাবে গবেষণা-প্রবন্ধ লিখেছেন এবং তাদের যৌথ তত্ত্বের ভিত্তিতে পদার্থের একটি অবস্থার নামকরণ করা হয়েছে ‘Bose-Einstein condensate’। সত্যেন বোসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি কণার নামকরণ করা হয় ‘বোসন কণা’, পরে আরেকটি কণাকে ‘হিগস-বোসন কণা’ নামে অভিহিত করা হয়, যা এখনো প্রচলিত। একইভাবে, পাকিস্তানের বিখ্যাত বিজ্ঞানী আবদুস সালাম ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন উদ্বোধন করতে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার মান নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে এমন অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। শুধু বিজ্ঞান নয়, সাহিত্য, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই শুধু নন, শিক্ষার্থীরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এছাড়া প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা সময়ে রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিও দেশীয় তথা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ উজ্জ্বল ছিল। তবে, অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমানে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ের ওপরের দিকে তো দূরে থাক, শেষের দিকেও দেখা যাচ্ছে না।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গত দুই-তিন বছর ধরে টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা খবর পত্রিকার পাতায় প্রধান শিরোনাম হতে দেখছি। কোথাও নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা নেই, কোথাও উপাচার্যের পাহাড়সম দুর্নীতি। কোথাও আত্মীয়স্বজনকে নিয়োগ দিতে গিয়ে নিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তন করা হচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে কন্যা-জামাতাকে নিয়োগ দিতে নিয়োগ নীতিমালার শর্ত শিথিল করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাৎ, স্বজনপ্রীতি, উপ-উপাচার্যের বিরুদ্ধে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগসহ ২৫টি অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক দফা নির্দেশনাও দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর আগে অনিয়ম করে শিক্ষার্থী ভর্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সংশ্লিষ্টতা, আবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে কমিশন ভাগাভাগি নিয়ে অচলাবস্থা ইত্যাদি অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি গণমাধ্যমে এসেছে।

জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বাধীন থাকবেন, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করবেন এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষা প্রসারে ভূমিকা রাখবেন।

আবার কোথাও মাসের পর মাস ক্যাম্পাসে থাকছেন না উপাচার্য। রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত তিন বছর নয় মাসে উপাচার্য ২৫০ দিনও অফিস করেননি বলে অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে ওঠা কিছু অভিযোগের বিষয়ে ইউজিসি তদন্ত শুরু করলে এ মাসের গোড়ার দিকে সংবাদ সম্মেলন ডেকে তিনি যেভাবে উল্টো শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন, তাতে হতবিহ্বল হওয়া ছাড়া আর উপায় কী?

কিছুদিন আগে গণমাধ্যমে খবর এসেছে বৈরী পরিস্থিতিতে গোপনে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে নিয়োগ-বাণিজ্যসহ স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার অভিযোগও রয়েছে। আবার পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে একাডেমিক, আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই অনুমান করা যায়, উপরোক্ত অনিয়মগুলো ঘটছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী তথা উপাচার্যসহ প্রশাসনিকভাবে উচ্চপর্যায়ের কিছু পদকে কেন্দ্র করে।

কী কারণে বারবার ঘটছে একই ধরনের ঘটনা?
প্রশ্ন উঠেছে এমন সব ঘটনার বারবার জন্ম দেওয়া, অনিয়ম ও দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ার পরও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে আসীন থাকছেন কীভাবে? মূলত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাক্রমে ইউজিসি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারকি করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিতদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেলে সেগুলো তদন্ত করে ইউজিসি। আর যদি তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয়, সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে উপাচার্যকে পদচ্যুত বা অপসারণ করা হয়। তবে এ ধরনের অপসারণের নজির তেমনটা দেখা যায় না। বরং তদন্ত কমিটির সুপারিশ কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাতেই আটকে থাকে ব্যবস্থা গ্রহণের পর্ব। ফলে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও বিভিন্ন অপকর্মের পাহাড় জমিয়েও নির্বিঘ্নে পার পেয়ে যান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রশাসনিক উচ্চপদে আসীন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এটি যেন স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। 
সে কারণে উপাচার্যের মেয়াদ শেষ হলে নতুন যিনি এই পদে আসীন হন তিনিও পূর্বসূরির দেখানো পথ অনুসরণ করেন। নতুন কোনো পন্থায়, নতুন নিয়মে অনিয়ম শুরু করেন তিনিও। আইনানুগ ব্যবস্থা না নেওয়ায় তা বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রীতিতে পরিণত হয়েছে। যার প্রভাব দৃশ্যমান।

এর থেকে উত্তরণের পথ কী?
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচ্চমর্যাদার বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের শুধুমাত্র নিজেদের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ করে ১৯৭৩ সালের অ্যাক্ট প্রণয়ন করেছিলেন। এই অ্যাক্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেওয়া হয়েছিল পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বাধীন থাকবেন, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করবেন এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা কেন্দ্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষা প্রসারে ভূমিকা রাখবেন।

কিন্তু সেই বিষয়টি তো হচ্ছেই না, বরং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা এখন বেশ নাজুক। অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পিছু ছাড়ছে না। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে প্রায় প্রতিনিয়ত। জন্ম দিচ্ছে নানান সমালোচনার। ব্যক্তি বিশেষের দুর্নীতির কারণে বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন আজ বিলীন হতে চলেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য মো. আবদুল হামিদ একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী হয়ে উপাচার্যরা নিজেরাই যদি অনিয়মকে প্রশ্রয় দেন বা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কী হবে তা ভেবে দেখবেন।

এজন্য অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে আশু পদক্ষেপ জরুরি। ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন, অভিযুক্তদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট পদ থেকে অপসারণ এবং একই সঙ্গে অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।

আসলে উপাচার্য নিয়োগে দলীয় যে লেজুড়বৃত্তির ধারা চলছে তা চলতে থাকলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন হতে হয়।
শোনা যাচ্ছে, আগামী তিন মাসে প্রায় ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে আরও বেশি কৌশলী হতে হবে। নিজ দলের ভেতরেও অনেক ভালো শিক্ষক আছেন যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে পারেন। তাদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ করলে এর প্রভাব নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়বে বলে বিশ্বাস করি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ও সর্বোপরি উচ্চশিক্ষাকে বাঁচাতে প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপরোক্ত ঘটনাগুলোর ইতি টানা।

ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়