ছবি : সংগৃহীত

ঈদ মানে আনন্দ। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য বছরে দুটি ঈদ আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ আসে এক মাসের সিয়াম সাধনার পর। সেই আনন্দ বাঁধভাঙা। নতুন পোশাক ছাড়া রোজার ঈদ হয় না আমাদের। নিজের জন্য না পরলেও সব বাবা-মাই চেষ্টা করেন অন্তত সন্তানের জন্য যাতে নতুন জামা-জুতা কিনতে পারেন।

আবার এসব পরিবারও আছে, যারা ঈদের কেনাকাটা করতে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, নিদেনপক্ষে কলকাতা ছুটে যান। যে যেখানেই যান, ঈদের দিনটি সবার রঙিন হয়ে ওঠে। তবে পবিত্র ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদে আনন্দের ধরন আবার আলাদা। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা ঈদুল আযহায়ও নতুন পোশাক কেনেন। তবে ঈদুল আযহার মূল আনন্দ কোরবানিতে। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত ঈদুল আযহা।

ঈদের আনন্দের মূল চেতনা হলো, সবার মাঝে আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু আনন্দের সাথে মিশে আছে সামর্থ্যের প্রশ্ন। আনন্দ কিনতে আপনার অর্থ লাগবে। যত গুড়, তত মিষ্টি। যত অর্থ, তত আনন্দ। তবে সামর্থ্য কম হলেও ঈদের আনন্দের ভাগ সবাই কম বেশি পান। যেমন যাদের সামর্থ্য আছে, তারাই শুধু কোরবানি দেন। কিন্তু কোরবানির মাংস কমবেশি সবার ঘরেই পৌঁছে যায়। এটা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, ঈদুল আযহায় বাংলাদেশের সব মানুষের ঘরেই কমবেশি মাংস পৌঁছেছে।

আরও পড়ুন >>> দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : সাধ্যের মধ্যে কোনটা? 

ধর্মমতে সামর্থ্যবানরা কোরবানি দেন। কিন্তু বাংলাদেশে সেই সামর্থ্যের সীমাও আকাশ ছুঁতে বসেছে। বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম এই উপমহাদেশে সবচেয়ে বেশি। তুলনা করলে হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে দামি গরুর মাংস বিক্রি হয় বাংলাদেশে। বৃষ্টির কারণে ঈদের আগের দিন কোরবানির পশুর দাম কিছুটা কমেছিল বটে। কিন্তু কয়েকবছরের মতো এবারও পশুর দাম চড়া ছিল। চড়া দামের কারণে অনেকেই এবার কোরবানি দিতে পারেননি।

অনেকে হয়তো একা কোরবানি দেওয়ার বদলে ভাগে কোরবানি দিয়েছেন। একসময় ভারত থেকে চোরাইপথে গরু আসতো। এখন গরু আসা বন্ধ। তাতে শুরুতে পশুর আকাল দেখা দেয়, দামও বেড়ে যায়। কোরবানির পশুর চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে নতুন নতুন খামার গড়ে ওঠে। চাহিদার পুরোটাই এখন বাংলাদেশি পশু দিয়েই মেটানো যাচ্ছে।

পশুর কোনো কমতি নেই। অঢেল সরবরাহ থাকায় দাম কমার কথা। কিন্তু হয়েছে উল্টো। ভারত থেকে গরু না আসার সুবিধা পুঁজি করে দেশি খামারিরা গরুর দাম হেঁকেছেন ইচ্ছেমতো। কয়েকবছরে গরুর দাম বাড়তে বাড়তে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে হঠাৎ করে পেঁয়াজ আর মরিচের দাম বেড়ে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে সরকার পেঁয়াজ আর মরিচ আমদানির অনুমতি দেয়। আমদানি শুরুর আগে, স্রেফ আমদানির অনুমতির কথা শুনেই দাম কমে গিয়েছিল।

সরকার খুব গর্বের সাথে নিজেদের ব্যবসাবান্ধব হিসেবে দাবি করে। সরকার নিছক ব্যবসাবান্ধব নয়, ব্যবসায়ীবান্ধবও বটে। বাজারে গেলে তো মনেই হয় না, দেশে কোনো সরকার আছে। বা বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলেই মনে হয় না।

এইবার ঈদের আগে অনেকেই বলছিলেন, ভারত থেকে গরু আমদানির সুযোগ থাকলে দেশি খামারিরা মানুষকে জিম্মি করতে পারতেন না। আমরা আসলে সবক্ষেত্রেই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে থাকি। কখনো গরু, কখনো পেঁয়াজ, তেল, কাঁচা মরিচ, আদা, চিনি—একেক সময় একেকটা পণ্য আমাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেয়।

সরকার খুব গর্বের সাথে নিজেদের ব্যবসাবান্ধব হিসেবে দাবি করে। সরকার নিছক ব্যবসাবান্ধব নয়, ব্যবসায়ীবান্ধবও বটে। তবে এই সরকারকে আর যাই হোক জনবান্ধব বলা যাবে না। বাজারে গেলে তো মনেই হয় না, দেশে কোনো সরকার আছে। বা বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে বলেই মনে হয় না।

আরও পড়ুন >>> ঋণ করে যেন ঘি না খাই 

সরকারও মুক্তবাজার অর্থনীতির দোহাই দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। বসে বসে দেখেন ব্যবসায়ীরা কীভাবে সাধারণ মানুষের পকেট কাটছে। কাঁচা মরিচ বা আদার দাম বাড়লে হয়তো সাধারণ মানুষের খুব একটা কিছু যায় আসে না। আদা বা কাঁচা মরিচের চাহিদা চাইলেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে এটা একটা সূচক। এটা দিয়ে বোঝা যায়, ব্যবসায়ীরা চাইলে যখন তখন মানুষকে জিম্মি করতে পারে।

অথচ চাইলেই কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সব পণ্য দরকার নেই; চাল, গম, চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল—এই কয়টি পণ্যের ওপর কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে পারলেই মানুষ অনেকটা স্বস্তিতে থাকতে পারে। আমাদের কৃষকরা পর্যাপ্ত ধান উৎপাদন করেন। তাই চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন কিছু নয়। কিন্তু সরকারের উদাসীনতায় কৃষকরা যেমন ধান-চালের ন্যায্য মূল্য পান না, আবার ভোক্তাদেরও বাড়তি দামে চাল কিনতে হয়। লাভটা মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে যায় ।

গম, চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল—মূলত আমদানি নির্ভর। তবে নিত্যপণ্য আমদানি করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কিন্তু বেশি নয়। সরকার চাইলে আমদানিকারকদের সাথে নিয়মিত বৈঠক করে, সময় সময় শুল্ক ছাড় দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। আমদানিকারকরা নানা অজুহাতে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়।

কখনো যুদ্ধ, কখনো ডলার সঙ্কট, কখনো আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়ে বাজারে। এখানে মজার ব্যাপার ঘটে। আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে সাথে সাথে বাংলাদেশের বাজারে তার প্রভাব পড়ে, দাম বেড়ে যায়। আমদানিকারকরা আগের দামে কেনা পণ্য বাড়তি দামে বিক্রি করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে বাংলাদেশে দাম কমে না। ব্যবসায়ীরা তখন বলেন, নতুন দামে আমদানি করা পণ্য দেশে আসলে দাম কমবে। ততদিনে আন্তর্জাতিক বাজারে হয়তো আবার দাম বেড়ে যায়।

বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা আর দাম কমানোর সুযোগ পান না। বাংলাদেশের মানুষ তাই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার ভোগান্তিটা শুধু পান, দাম কমার সুবিধাটা কখনোই পান না। বাজার পরিস্থিতি আসলে সাধারণ মানুষের আয়ত্বের বাইরে চলে যায় করোনার সময় থেকেই। মানুষের আয় কমে যায়, কিন্তু ব্যয় বাড়তে থাকে হুহু করে। করোনার সময় অনেকের আয় কমে যায়, অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসায় ধস নেমেছে। এই মানুষগুলো বাজারের পাগলা ঘোড়ার সাথে তাল মেলাতে পারেন না।

আরও পড়ুন >>> দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : সংসার আর চলে না 

করোনার ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই লাগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা। সেই ধাক্কায় বেসামাল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে আগেই। এখন মহাকাশের পানে যাত্রার পালা। বাংলাদেশে একবার কোনো জিনিসের দাম বাড়লে সেটা আর কমে না। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে বিপাকে পড়েন সীমিত আয়ের মানুষ। কিছু ব্যয় থাকে নির্ধারিত। বাসা ভাড়া, সন্তানের পড়াশোনা, চিকিৎসা ব্যয় নির্দিষ্ট। তাই জিনিসের দাম বাড়লে চাহিদা কমিয়ে আনতে। 

নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে আগেই। এখন মহাকাশের পানে যাত্রার পালা। বাংলাদেশে একবার কোনো জিনিসের দাম বাড়লে সেটা আর কমে না। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে বিপাকে পড়েন সীমিত আয়ের মানুষ...

ধীরে ধীরে মাছ, মাংস বা পুষ্টির উপর চাপ পড়ে। সন্তানের পাতে একটি ডিম তুলে দেওয়া আর সম্ভব হয় না। সপ্তাহে একদিন মাংস খাওয়ার রুটিন মাসে একদিন হয়ে যায়। আস্তে আস্তে হয়তো মাসেও খাওয়া হয় না। মধ্যবিত্তরা কালেভদ্রে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার বিলাসিতা ভুলে যান। এভাবে চাহিদা কমাতে কমাতে একদম মৌলিক চাহিদায় চলে আসেন অনেকে। প্রান্তিক মানুষের পেটপুরে খাওয়াও দায় হয়ে যায়।

সংসদে পাস হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব, তার কোনো পথনকশা নেই বাজেটে। সংসদে বাজেট পেশের চারদিন পর মূল্যস্ফীতি আরেকদফা বাড়ার খবর এসেছে। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি এখন ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, ৯ দশমিক ৯৪। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় সরকার সরকারি কর্মচারীদের ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় ৫ শতাংশ প্রণোদনা কতটা ঢাল হতে পারবে; সেটা বলা মুশকিল। তবে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের সাথে ৫ শতাংশ প্রণোদনা মিলে সরকারি কর্মচারীরা হয়তো কিছু সামাল দিতে পারবেন। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই তো দেশের মানুষ নয়।

আরও পড়ুন >>> আর কত চাপ সামলাবে? 

মাত্র ৫ ভাগ মানুষ সরকারি চাকরি করেন। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো মানে বেসরকারি চাকরিজীবী এবং অন্য মানুষদের অন্যায় প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেওয়া। বেসরকারি চাকরিজীবীদের আয় বাড়বে না, ব্যয় বাড়বে। সরকারি চাকরিজীবীরাও পুরো রক্ষা পাবেন না। বেতনর বাড়ার খবরে বাজারে আরেকদফা জিনিসপত্রের দাম বাড়বে, তাতে বাড়তি বেতনেও সামলানো মুশকিল।

বাজার এখন যেমন উত্তপ্ত হয়ে আছে, তাতে ৫ শতাংশ সরকারি চাকরিজীবীর ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি তাতে পানির ছিটার মতো মনে হবে। চট করেই মিলিয়ে যাবে। আসলে বেতন বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির সাথে পাল্লা দেওয়া যাবে না। নির্বাচনের বছরে ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে সরকারি কর্মচারীদের সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা হয়তো করা যাবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উপায় বের করতে না পারলে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হবে শুধু।

১৪ বছরে সরকার বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠেছে। পদ্মাসেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্যাটেলাইট, সাবমেরিন—বাংলাদেশ সত্যি বদলে গেছে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সবকিছু অর্থহীন হয়ে যাবে। সাঁতার না জানা শহুরে ভদ্রলোকের জীবনের মতো ষোলো আনাই মিছে হয়ে যাবে সব অর্জন।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ