করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারিতে ইউরোপ-আমেরিকার বহু শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ যখন বিপর্যস্ত, তখন বাংলাদেশ কোমর সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ যখন বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, পাট রপ্তানিতে প্রথম ও উৎপাদনে দ্বিতীয়, তৈরি পোশাক ও আউটসোর্সিংয়ে দ্বিতীয়, সবজি ও মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, ধান উৎপাদনে চতুর্থ; যখন পদ্মা সেতুর মতো বিশাল অবকাঠামো হয় নিজস্ব অর্থায়নে; যখন মেট্রোরেল বা এক্সপ্রেসওয়ের মতো অবকাঠামোয় সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন দৃশ্যমান—তখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান ঘিরে বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনাম বাংলাদেশে সহিংসতা, তাণ্ডব, পুলিশের গুলি ও টিয়ার গ্যাস, সড়ক ও রেলপথ অবরোধে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং হেফাজতের হরতাল ও দেশ অচল করে দেওয়ার হুমকি।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মতো একটি মাহেন্দ্রক্ষণে এসে আমাদের কি এসব নিয়ে আলোচনা ও তর্কের কথা ছিল? যখন অর্থনীতির নানা সূচকে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় সাফল্যে সারা বিশ্ব প্রশংসা করছে, তখন আমাদের গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার দেয়ালজুড়ে বিক্ষোভ ও সহিংসতার খবর।

যখন অর্থনীতির নানা সূচকে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় সাফল্যে সারা বিশ্ব প্রশংসা করছে, তখন আমাদের গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার দেয়ালজুড়ে বিক্ষোভ ও সহিংসতার খবর।

নয় মাসের যুদ্ধ, ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মদান এবং দুই লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছর পূর্তি বা সুবর্ণজয়ন্তীকে ঘিরে সারাদেশে দলমত নির্বিশেষে যে বিপুল উৎসব এবং গণমাধ্যমে সেই উৎসবের যে প্রতিফলন হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। বরং এই বিশেষ দিনটির আগে পরে রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এমন সব ঘটনা ঘটেছে, যা মোটেও কাঙ্ক্ষিত ছিল না। একদিকে করোনা, অন্যদিকে মোদিকে ‘না’—এই মিলে যা হয়েছে, তাতে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মতো একটি বিরাট গর্ব আর অহংকারের বিষয়টি ম্লান হয়ে গেছে।

রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হওয়া যেকোনো জাতির জীবনেই তাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর একটি মাইলস্টোন; সুবর্ণজয়ন্তীর সেই দিনটি মাহেন্দ্রক্ষণ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এই বিশেষ দিনটিকে ঘিরে, বিশেষ করে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন প্রতিহত করার নামে যা হয়েছে, তা একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদে ২৬ মার্চ শুক্রবার, নামাজের পরে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামসহ আরও একাধিক ইসলামিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের যে সংঘর্ষ হয়েছে, সেটির নেপথ্যে শুধুই মোদি বিরোধিতা ছিল নাকি আরও কিছু রয়েছে, তা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া জানা কঠিন।

আবার বায়তুল মোকাররমের এই ঘটনার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচিতে পুলিশ যে গুলি চালিয়েছে, সেটির আদৌ প্রয়োজন ছিল কি না; এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতি উৎসাহ ছিল কি না এবং এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা রয়েছে কি না—সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিবেশী ভারতের অবদান অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ১৯৭১ সালে প্রাণভয়ে পালিয়ে যাওয়া প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা এবং শেষ দিকে সরাসরি পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যে বিরাট কাজ করেছে, সেটি না হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের এই যুদ্ধটি নিঃসন্দেহে আরও প্রলম্বিত হতো। হয়তো আরও বেশি প্রাণহানি হতো। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হবে—এটিই স্বাভাবিক।

একদিকে করোনা, অন্যদিকে মোদিকে ‘না’—এই মিলে যা হয়েছে, তাতে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মতো একটি বিরাট গর্ব আর অহংকারের বিষয়টি ম্লান হয়ে গেছে।

নরেন্দ্র মোদির স্থলে এ মুহূর্তে অন্য কেউ থাকলে তিনিই আসতেন। এখানে ব্যক্তি মোদি কোনো বিষয় নন। কিন্তু তারপরও মোদির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। তার কারণও অজানা নয়। কিন্তু বিরোধিতা করে কি তার আগমন ঠেকানো গিয়েছে বা এটি কি আদৌ সম্ভব ছিল? বরং এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান শক্তিশালী দেশের সরকার প্রধানের ঢাকায় উপস্থিতিতে যে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ হয়েছে, সহিংসতা হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে মোদি বা ভারত সরকার কী মেসেজ পেল? বাংলাদেশে মোদি ও তার দল বিজেপির বিরুদ্ধে জনগণের একটি বিরাট অংশের ক্ষোভ রয়েছে? বাংলাদেশে আসলেই মৌলবাদী গোষ্ঠী বেশ শক্তিশালী?

তারা যে মেসেজই পাক, এটি কি বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছে? করেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে মহিমান্বিত করেনি। বরং ক্ষতি হয়েছে ভারতের কিছু কিছু গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনামে। তাদের দাবি, বাংলাদেশে এই বিক্ষোভ করেছে ‘পাকিস্তানপন্থিরা’। এই কথা কতটুকু সত্য, তা নিয়ে তর্কের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কারণ যারা মোদির আগমনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন, তারা সবাই পাকিস্তানপন্থি নন।

মোদি বিরোধিতা মানেই ভারত বিরোধিতা নয়; আবার ভারত বিরোধিতা মানেও পাকিস্তানপন্থি নয়। ফলে বিষয়গুলোকে এক করে দেখা বা চট করে উপসংহারে পৌঁছানোর সুযোগ নেই। তবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই, মোদি বিরোধিতার নামে যে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ এবং কোথাও কোথাও নৈরাজ্য হয়েছে তার পেছনে আওয়ামী বিরোধিতাও বেশ সক্রিয় ছিল।
রাজনীতি ও ভোটের মাঠে প্রতিপক্ষ থাকবেই। কিন্তু সেই বিরোধিতারও একটা সময় আছে। সরকার, আওয়ামী লীগ বা মোদি বিরোধিতার নামে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা ছিল কি না—সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

শুধু এই বিরোধিতা বা তাণ্ডবই নয়, সুবর্ণজয়ন্তীর আয়োজনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানানোয় পুরো উৎসব ছিল ভিআইপিকেন্দ্রিক। বিশেষ করে রাজধানীতে কোনো আয়োজনে সাধারণ মানুষের সে রকম অংশগ্রহণ ছিল না। বরং অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চলাচলের কারণে ১৭ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত পুরো ঢাকা শহরে ভয়াবহ যানজট আবার কখনো যানবাহন সংকটে নগরবাসী নাকাল হয়েছে।

সরকারি ভবনগুলোয় আলোকসজ্জা ছাড়া সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল না। তাছাড়া হঠাৎ করে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় মানুষের সমাগমকে সরকার নিরুৎসাহিতও করছে। সব মিলিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে ঘিরে যে বিপুল উৎসাহ এবং যেরকম একটি সর্বজনীন উৎসব হওয়ার কথা ছিল—দেশবাসী তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এই ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি হবে না; করোনার প্রকোপ কেটে যাবে এবং দলমত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে মাতবে—এই প্রত্যাশা।

আমীন আল রশীদ ।। সাংবাদিক